মাদক মাফিয়াদের ত্রাসে কাঁপছে গোটা দেশ। নিত্যদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা। পরিস্থিতি সামাল দিতে মার্কিন ফৌজকে ‘ঘরে ফেরাতে’ উদ্যোগী হন স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধান। আর ঠিক তখনই বাদ সাধল আমজনতা। বিদেশি বাহিনীর মোতায়েন কিছুতেই মানবে না তাঁরা। গণভোটে সে কথা সরকারকে জানিয়ে দিতেই ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘আধিপত্যের’ স্বপ্ন।
দক্ষিণ আমেরিকার (পড়ুন লাতিন আমেরিকা) প্রশান্ত মহাসাগরের কোলের দেশ ইকুয়েডর। এর এক দিকে পেরু, অপর দিকে রয়েছে কলম্বিয়া। বর্তমানে মাদক মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যে একরকম ত্রাহিমাম দশা সেখানকার আমজনতার। পরিস্থিতি মোকাবিলায় মার্কিন ফৌজের সাহায্য নেওয়ার সিদ্ধান্ত একরকম নিয়েই ফেলেন সেখানকার প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল নোবোয়া। সেই লক্ষ্যে সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে গণভোটের আয়োজন করেন তিনি। ১৭ বছর আগে তা জারি করছিল তাঁরই পূর্বতন এক বামপন্থী সরকার।
গণভোটের ফলাফল সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পক্ষে থাকবে বলে নিশ্চিত ছিলেন ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট। কিন্তু, গত ১৬ নভেম্বর নির্বাচনী গণনায় ভুল ভাঙে তাঁর। দেখা যায় দেশের ৬৫ শতাংশ বাসিন্দা এ ব্যাপারে ‘নেতিবাচক’ রায় দিয়েছেন। রাজনৈতিক ভাবে সেটা ছিল নোবোয়ার জন্য বড় ধাক্কা। যদিও ফলপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই হার স্বীকার করে এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) পোস্ট দেন তিনি। লেখেন, ‘‘সরকার ইকুয়েডরের জনগণের ইচ্ছাকে সম্মান করে। যাবতীয় সমস্যা মোকাবিলায় লড়াই চালিয়ে যাবে প্রশাসন।’’
সংশ্লিষ্ট গণভোটে ১.৪ কোটি নাগরিককে যোগ দেওয়ার সুযোগ দেয় ইকুয়েডরের সরকার। সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পাশাপাশি ব্যালটে ছিল আরও তিনটি প্রশ্ন। সেগুলি হল, রাজনৈতিক দলগুলির জন্য সরকারি তহবিল বন্ধ করা, আইন প্রণেতাদের সংখ্যা হ্রাস এবং নতুন সংবিধানের জন্য নির্বাচিত সংস্থা তৈরি করা কতটা যুক্তিযুক্ত? এই তিন প্রস্তাবের ক্ষেত্রেও ‘নেতিবাচক’ জবাব দিয়েছে লাতিন আমেরিকার দেশটির বাসিন্দারা।
২০২৩ সালের নভেম্বরে দ্বিতীয় বারের জন্য ইকুয়েডরের ক্ষমতায় আসেন নোবোয়া। মাদক মাফিয়াদের খতম করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রেসিডেন্ট ভোটের প্রচারে ঝড় তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু, কুর্সি পাওয়ার পর এ ব্যাপারে একচুলও এগোতে পারেননি ব্যবসায়ী পরিবারের বছর ৩৭-এর ওই রাজনীতিবিদ। ফলে এ বছরের জানুয়ারিতে ৪৭তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ নিলে তাঁর কাছে সাহায্যের জন্য ছোটেন ‘অসহায়’ ড্যানিয়েল।
ইকুয়েডর প্রেসিডেন্টের এ-হেন মার্কিন-প্রীতির নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, দীর্ঘ দিন ধরে মাদক সমস্যায় ভুগছে আমেরিকাও। যুক্তরাষ্ট্রের অন্তরে ওই নেশার ‘বিষ’ পাচারে হাতযশ রয়েছে মেক্সিকো, কলম্বিয়া এবং ভেনেজ়ুয়েলার মাফিয়াদের। দ্বিতীয়ত, পূর্বতন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের তুলনায় এ ব্যাপারে কড়া পদক্ষেপ করছেন ট্রাম্প। সম্প্রতি তাঁর নির্দেশে ক্যারিবীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরে মাদক চোরাচালান সন্দেহে বেশ কয়েকটি জলযানে ড্রোন এবং বিমান হামলা চালিয়েছে আমেরিকার নৌবাহিনী।
লাতিন আমেরিকান রাষ্ট্রটিতে মাদক মাফিয়াদের সমস্যা নতুন নয়। গত শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে সেখানকার মান্তা বিমানঘাঁটিতে মোতায়েন হয় মার্কিন ফৌজ। পরবর্তী বছরগুলিতে ইকুয়েডরের ওই এলাকাটিকে কেন্দ্র করে একাধিক মাদকবিরোধী অভিযান চালায় যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী। ফলে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে ছিল মাফিয়াদের ‘গ্যাং ওয়ার’ এবং চোরাচালান। ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলে সেই অবস্থা ফেরাতে উদ্যোগী হন নোবোয়া। কিন্তু গণভোটে তা মানেনি তাঁরই দেশের নাগরিকেরা।
১৯৭৮ সালে মানাবি প্রদেশের মান্তায় যৌথ ব্যবহারের সুবিধাযুক্ত একটি বিমানঘাঁটি গড়ে তোলে ইকুয়েডর বায়ুসেনা। ৭৫৫ হেক্টর জমিতে তৈরি ওই ছাউনির এক দিকে রয়েছে আলফারো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। বাকি অংশ ব্যবহার করে লাতিন আমেরিকার রাষ্ট্রটির বিমানবাহিনী। গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে হঠাৎ করেই চরম আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়ে তারা। ফলে বাধ্য হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করে ইকুয়েডরের সরকার। দু’তরফে সমঝোতার তারিখটা ছিল ১৯৯৯ সালের ৩১ মার্চ।
সংশ্লিষ্ট চুক্তিতে মান্তার বিমানঘাঁটির প্রায় ৩৮ হেক্টর জায়গা ১০ বছরের জন্য মার্কিন ফৌজকে লিজ় দেন ইকুয়েডরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জামিল মাহুয়াদ। গোটা এলাকাটির তা ছিল প্রায় পাঁচ শতাংশ। এর মাধ্যমে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে চেয়েছিলেন তিনি। যদিও অচিরেই ওই চুক্তি নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েন জামিল। জানা যায়, কোনও রকম ভাড়া ছাড়া মান্তার বিমানঘাঁটিতে সাড়ে চারশোর বেশি সৈনিক রাখতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র।
চুক্তির শর্তগুলি জানাজানি হতেই সেনা অভ্যুত্থানের মুখে পড়ে ক্ষমতা হারান মাহুয়াদ। যদিও তাতে মান্তায় বিমানঘাঁটিতে মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রবেশ আটকায়নি। প্রাথমিক ভাবে সেখানে ৩০০ জন সৈনিক মোতায়েন করে যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন কমান্ড বা সাউথকম। শুরু হয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় কড়া নজরদারি এবং ‘ঘাতক’ মাদকবিরোধী অভিযান। তাতেও রক্তে ভিজেছিল ইকুয়েডরের মাটি।
লাতিন আমেরিকান রাষ্ট্রটির মাদক মাফিয়ারা প্রতিবেশী কলম্বিয়ার গ্যাংগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে মূলত কোকেন পাচার করে থাকে। সাদা পাউডারের মতো দেখতে এই মারাত্মক নেশার দ্রব্যটির কাঁচামাল হল কোকা নামের গাছের শুকনো পাতা, যা বিপুল পরিমাণে উৎপন্ন হয় কলম্বিয়ায়। এ-হেন কোকেন চোরাচালানের জন্য প্রশান্ত মহাসাগরের জলপথকেই বেছে নিয়েছে দুষ্কৃতীরা। আর তাই মান্তায় থাকাকালীন ইকুয়েডরের উপকূলভাগে সামরিক বিমান থেকে ব্যাপক নজরদারি চালাত আমেরিকা।
ইকুয়েডর ও কলম্বিয়ার মাদক মাফিয়াদের কোমর ভাঙতে ই-৩ এডব্লিউএসিএস রেডার বিমান এবং পি-৩ ওরিয়ন সামুদ্রিক টহলদারি বিমান ব্যবহার করেছিল সাউথকম। মাফিয়াদের দ্রুত গতির নৌকাগুলি চিহ্নিত করতে তা দারুণ ভাবে কাজে এসেছিল। প্রায় ৬,৪০০ কিলোমিটার লম্বা উপকূলভাগে নিরন্তর টহলদারিতে পরবর্তী সময়ে নিম্নমুখী হয় কোকেন পাচারের সূচক। এই পদ্ধতিতে ৬০ শতাংশ মাদক আটকাতে সক্ষম হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ফৌজ। প্রায় ৭০০ টনের কাছাকাছি কোকেন বাজেয়াপ্ত করে তারা, যার বাজারমূল্য ছিল ৩,৫০০ কোটি ডলার।
এ-হেন মাদকবিরোধী অভিযানে আমেরিকাকে কম বদনাম কুড়োতে হয়নি। কিছু দিনের মধ্যেই মান্তায় মোতায়েন মার্কিন ফৌজের বিরুদ্ধে ওঠে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ। কোকেন পাচারকারী সন্দেহে নিরীহ মৎস্যজীবীদের তাঁরা খুন করছেন বলেও অভিযোগ করে বেশ কয়েকটি সংগঠন। ২০০৭ সালে আরও জটিল হয় পরিস্থিতি। সে বছর ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী হটাও’ ডাক দিয়ে ক্ষমতায় আসেন কট্টর ওয়াশিংটনবিরোধী হিসাবে পরিচিত বামপন্থী নেতা তথা অর্থনীতিবিদ রাফায়েল কোরেয়া।
মান্তা বিমানঘাঁটিতে আমেরিকার সৈনিকদের উপস্থিতিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ হিসাবেই দেখেছিলেন ইকুয়েডরের ওই বামপন্থী নেতা। ফলে ২০০৮ সালে দেশের ভিতরে বিদেশি ফৌজের মোতায়েনের উপর সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে কোরেয়ার সরকার। সে বছরের সেপ্টেম্বরে তা পাশ করে লাতিন আমেরিকার রাষ্ট্রটির পার্লামেন্ট। ২০০৯ সালের ভোটে বামেরা পরাজিত হলেও ওই নিয়ম আর কখনও বদলানো যায়নি। ফলে ধীরে ধীরে সেখান থেকে পাততাড়ি গোটায় সাউথকম।
২০০৯ সালের ২৯ জুলাই ওয়াশিংটনকে দ্রুত বাহিনী প্রত্যাহার করতে বলে ইকুয়েডরের বিদেশ মন্ত্রক। ওই বছরের অগস্টের মধ্যেই দেশটির উপকূল এলাকায় সামরিক বিমানে নজরদারি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় মার্কিন ফৌজ। যদিও দক্ষিণ আমেরিকার দেশটি থেকে সৈনিক এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষা সরঞ্জামগুলিকে সরিয়ে নিতে সাউথকমের সময় লেগেছিল আরও এক মাস। ১৮ সেপ্টেম্বর পুরোপুরি ভাবে ওই ঘাঁটি খালি করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
মান্তা থেকে মার্কিন ফৌজ সরতেই হু-হু করে ঊর্ধ্বমুখী হয় কোকেন পাচারের সূচক। পাশাপাশি, সেখানকার মাফিয়া গ্যাংগুলির মধ্যে শুরু হয়ে যায় এলাকা দখলের লড়াই। বর্তমানে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে। ইকুয়েডর সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম ছ’মাসে দেশ জুড়ে ৪,৬১৯টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, সাম্প্রতিক সময়ে যা সর্বোচ্চ।
কিন্তু, তা সত্ত্বেও কেন মার্কিন ফৌজের অন্তর্ভুক্তি চাইছে না ইকুয়েডরের জনগণ? গণমাধ্যমের কাছে এর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন আমেরিকার জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল শিফটার। তাঁর কথায়, ‘‘ঘন ঘন নীতি বদলের কারণে ট্রাম্পের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে গিয়েছে। কেউ তাঁকে বিশ্বাস করছেন না। লাতিন আমেরিকান রাষ্ট্রটির গণভোটের ফলাফল সেই ছবিই তুলে ধরেছে।’’
শিফটার মনে করেন, জনগণের রায়ে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। আর সেটা হল, সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতার প্রতি ইকুয়েডরবাসীর ভালবাসা। কোনও কিছুর বিনিময়ে এই দু’টিকে হারাতে চান না তাঁরা। অন্য দিকে মাদকের শক্ত ঘাঁটিগুলিকে ভাঙতে ক্রমাগত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট নোবোয়া। এর জন্য ঘন ঘন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হচ্ছে তাঁকে, যা আগামী দিনে আরও বাড়বে বলেই মনে করছে বিশেষজ্ঞমহল।