বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইস্পাত উৎপাদনকারী সংস্থার কর্ণধার। তিনি অনাবাসী ভারতীয় ধনকুবের লক্ষ্মী মিত্তল। ইস্পাত সংস্থা আর্সেলর-মিত্তলের সর্বেসর্বা। ২১৪০ কোটি ডলারের সম্পত্তির মালিক। ফোবর্সের বিশ্বের ধনকুবেরদের তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে ১০৮ নম্বরে।
রাজস্থানে জন্মগ্রহণ করা লক্ষ্মী বর্তমানে ব্রিটেনে থাকেন। সেখানে থেকেই ব্যবসায়িক রমরমা। বহু বছর ধরে লন্ডন শহরই তাঁর ঠিকানা। ব্রিটেনের ধনকুবেরদের তালিকায় দীর্ঘ দিন ধরেই স্থায়ী নাম ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইস্পাত ব্যবসায়ীর। দীর্ঘ তিন দশক ধরে ইংল্যান্ডের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটেন ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ইস্পাতশিল্পের এই ‘মুকুটহীন সম্রাট’।
ব্রিটেনের লেবার পার্টির সরকারের একটি সিদ্ধান্তের কারণে ৩০ বছরের আস্তানা ছাড়তে চাইছেন অনাবাসী শিল্পপতি লক্ষ্মী মিত্তল। গত বছরেই ব্রিটেনের সরকারে বড়সড় পালাবদল ঘটেছে। ১৪ বছর পর কনজ়ারভেটিভ পার্টিকে হারিয়ে ক্ষমতার লাগাম হাতে উঠেছে লেবার পার্টির। এক বছরের পুরোনো সরকার করকাঠামোয় আমূল পরিবর্তন এনেছে।।
নতুন লেবার সরকার ‘নন-ডোম বা নন ডোমিসাইল’ করছাড় সম্পূর্ণ ভাবে বাতিল করেছে লেবার পার্টির সরকার। এ ছাড়াও আরোপ করা হবে উত্তরাধিকার কর। সরকারের নতুন কর নিয়মে চটেছেন বিত্তবান ব্রিটিশ ও ব্রিটিশ-ভারতীয়েরা। নন ডোমিসাইল করের আওতায় আগে বিদেশি নাগরিকেরা ব্রিটেনে যা আয় করতেন শুধুমাত্র তার ভিত্তিতেই কর দিতেন।
২২৬ বছরের সেই আইন পাল্টে দিয়েছে রক্ষণশীল লেবার পার্টির সরকার। তারা ইনহেরিটেন্স ট্যাক্স বা উত্তরাধিকার কর চাপিয়েছে বিত্তশালী ও ধনী নাগরিকদের উপর। যাঁরা ব্রিটেন ছাড়াও বিদেশে সম্পত্তি কিনে রেখেছেন তাঁদেরও নতুন আইনে মোটা টাকা কর দিতে হবে। করের পরিমাণ প্রায় ৪০ শতাংশ।
বামপন্থী মনোভাবাপন্ন লেবার পার্টির সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তির উপরে কর বসিয়েছে। এতে একেবারেই খুশি নয় পূর্বপুরুষদের থেকে পাওয়া বিপুল সম্পত্তির মালিক বিত্তবান ইংরেজ পরিবারগুলির একাংশ। সেই কারণে বিকল্প দেশ খুঁজে নিতে চাইছেন তাঁরা। উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্য পরিকাঠামোযুক্ত ভিন্রাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের।
এখানেই আপত্তি তুলেছেন লক্ষ্মী মিত্তল-সহ বহু অনাবাসী ভারতীয়। লক্ষ্মীর প্রশ্ন, কেন ব্রিটিশ নাগরিকদের বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সম্পত্তি ব্রিটেনের উত্তরাধিকার করের আওতায় আসবে? বিশ্বব্যাপী সম্পদের উপর উত্তরাধিকার করটিকে অনেকেই অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন।
১৯৯৫ সালে মিত্তল লন্ডনে চলে আসেন এবং দ্রুত ব্রিটেনের বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন। কেনসিংটন প্যালেস গার্ডেনে রয়েছে তাঁর প্রাসাদোপম সম্পত্তি। টেমসের পাড়ের শহরটির বিলাসবহুল বাড়িগুলির একটি হল মিত্তলের এই সম্পত্তি। লন্ডন ছাড়াও ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং এশিয়ায় একাধিক সম্পত্তির মালিকানা রয়েছে তাঁর হাতে।
লন্ডনের একটি অভিজাত এলাকায় অবস্থিত ‘তাজ মিত্তল’ হল মিত্তলের মালিকানাধীন সবচেয়ে মূল্যবান সম্পত্তি। ২০০৪ সালে ৬৬৫ কোটি টাকা দিয়ে কেনা হয়েছিল বাড়িটি। সেই সময় বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বাড়ি হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল এটি।
বাড়িটি ৫৫ হাজার বর্গফুট জুড়ে বিস্তৃত। তাজমহল যে খনির পাথর দিয়ে তৈরি হয়েছিল সেই একই পাথর দিয়ে তৈরি মিত্তলদের আবাস। বলরুম, একটি সুইমিং পুল ও ২০টি গাড়ি রাখা যাবে এমন পার্কিং লট রয়েছে এখানে। একটি সংবাদ প্রতিবেদন অনুসারে, লন্ডন ছেড়ে গেলেও মিত্তল এই সম্পত্তিটি বিক্রি করার পরিকল্পনা করছেন না।
যৌবনের উপবন লন্ডন ছেড়ে কি শেষে ভারতে প্রত্যাবর্তন করতে চান লক্ষ্মী? সেই সম্ভাবনা আপাতত নেই বলে সূত্রের খবর। পশ্চিম এশিয়ার দেশেই থিতু হতে চাইছেন ধনকুবের। মরুশহর দুবাইয়ে একটি প্রাসাদ কেনা রয়েছে তাঁর। সংযুক্ত আরব আমিরশাহির ‘না’ নামক একটি দ্বীপেও জমি কেনা রয়েছে তাঁর। দুবাই এবং সুইৎজ়ারল্যান্ডের মতো দেশগুলি লন্ডন বা ইউরোপের ধনকুবেরদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কারণ এই দেশ দু’টিতে লন্ডনের মতো উত্তরাধিকার করের কোনও প্রচলন নেই।
‘ইমপ্রোবেবল’-এর প্রতিষ্ঠাতা হরমন নারুলা এবং রেভোলুটের নিক স্টোরনস্কির মতো ধনী উদ্যোক্তারা ইতিমধ্যেই দুবাইয়ে চলে গিয়েছেন। ব্রিটেনে কর নিয়ে যে ভাবে অনিশ্চয়তা বাড়ছে তাতে সে দেশে ভবিষ্যতে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মত দেশত্যাগী ধনকুবেরদের।
শুধু ভারতীয় বংশোদ্ভূত উদ্যোগপতিরা নন, বিত্তবান ব্রিটিশ নাগরিকদের দেশত্যাগের হিড়িক বাড়ছে ব্রিটেনে। মাতৃভূমি ছেড়ে বিদেশকেই আপন করে নিচ্ছেন ধনকুবেররা! আর্থিক এবং রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের প্রভাবই দেশ ছাড়ার প্রবণতায় ইন্ধন জোগাচ্ছে বলে মত অনেকের। দেশত্যাগের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী দেশের তালিকায় দু’নম্বরে রয়েছে ব্রিটেন।
ব্রিটিশ সমীক্ষক সংস্থা ‘হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স’-এর সাম্প্রতিক সমীক্ষা জানাচ্ছে এই তথ্য। ‘হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স’ জানিয়েছে, এ বছর সারা বিশ্বের মোট ১ লক্ষ ৪২ হাজার সম্পদশালী দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। তাঁদের এই চিন্তাভাবনার নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ।
সমীক্ষকদের দাবি, মূলত উচ্চ করকাঠামো, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অপশাসন, অনুন্নত আইনশৃঙ্খলা এবং আর্থিক ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের ক্ষেত্রে সুযোগের অভাবের কারণে স্বদেশ ছাড়তে চাইছেন ধনকুবের লগ্নিকারী ও উদ্যোগপতিরা।
একসময় ধনীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল টেমস নদীর তীরে গড়ে ওঠা ব্রিটেনের রাজধানী। মোহিনী এই শহরের মায়ায় জড়িয়ে এখানে শিকড় গেঁথেছিল বহু ধনী অভিজাত পরিবার। ইংল্যান্ডের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর লন্ডন। স্থাপত্যের দিক থেকে এই শহরের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। বহু সংস্কৃতি ও ধারণার সঙ্গমস্থল। ৯০ লক্ষের বেশি মানুষের বাস এখানে।
বৈশ্বিক শহর হিসাবে পরিচিত লন্ডন সংস্কৃতি, সঙ্গীত, শিক্ষা, রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের আন্তর্জাতিক রাজধানী। লক্ষাধিক ইতিহাসবিজড়িত স্থান রয়েছে এখানে। প্রায় দু’হাজার বছরের পুরোনো এই শহরের আকর্ষণ নাকি কমছে বিত্তবানদের কাছে। ইংল্যান্ডের রাজধানীর মুকুট থেকে খসে পড়েছে একটি পালক। বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ ধনী শহরের তকমা হারিয়েছে লন্ডন। একসময় লন্ডন ছিল বিশ্বের ধনীতমদের আবাসস্থল। সেই লন্ডন ছেড়ে যাচ্ছেন তাঁরা। এই সংখ্যাটা কয়েকশোয় সীমাবদ্ধ নেই।
সমীক্ষকদের দাবি, ব্রিটেন ত্যাগ করতে পারেন ১৬ হাজার ৫০০ জন ধনকুবের। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে যায় আটলান্টিকের দ্বীপরাষ্ট্র। এই বিচ্ছেদের পোশাকি নাম ‘ব্রেক্সিট’। বিশ্লেষকদের দাবি, ইইউ ছাড়ার ক্ষতিকর আর্থিক প্রভাব এ বার ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছে সেখানে। বাড়ছে আর্থিক অনিশ্চয়তা। শেয়ার সূচকের সে ভাবে হচ্ছে না কোনও বৃদ্ধি। ফলে দিন দিন সম্পত্তি কমছে বিত্তবান লগ্নিকারী ও উদ্যোগপতিদের।
ব্রিটিশ সমীক্ষক সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে দেশত্যাগী বিত্তবানদের বড় অংশই সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে পাকাপাকি ভাবে বসবাস করতে ইচ্ছুক। চলতি বছরে প্রায় ৯,৮০০ জন ধনকুবেরকে পেতে পারে ওই আরব মুলুক। সূত্রের খবর, এঁদের বেশির ভাগ আবু ধাবি, দুবাই বা শারজায় থাকতে পছন্দ করছেন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর থেকেও বেশি বিত্তবান লন্ডন ছেড়েছেন। সবচেয়ে বেশি কোটিপতিকে হারানো শহর হিসাবে তালিকার শীর্ষে রয়েছে ব্রিটিশ রাজধানী। গত এক দশকে লন্ডন তার ১২ শতাংশ ধনী বাসিন্দাকে হারিয়েছে।
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ১১ হাজারেরও বেশি বিত্তবান ব্রিটিশ রাজধানী ছেড়েছেন। ধনীদের লন্ডন ছাড়ার প্রবণতা কয়েক বছর ধরেই চলছে। তবে তা এখন উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছে বলে প্রকাশিত হয়েছে রিপোর্টে।
‘নিউ ওয়ার্ল্ড ওয়েল্থ’-এর প্রধান গবেষক অ্যান্ড্রু অ্যামোইলসের মতে, বিত্তশালীদের লন্ডন ত্যাগ করার একাধিক কারণ রয়েছে। প্রযুক্তিগত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এশিয়া এবং আমেরিকার ক্রমবর্ধমান আধিপত্য বেশ কয়েক জন উদ্যোগপতিকে আস্তানা পরিবর্তনের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে।