ফের ইহুদিদের উৎসবে বন্দুকবাজের হামলা। রক্তাক্ত অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্রসৈকত। এক আততায়ী-সহ নিহতের সংখ্যা ইতিমধ্যেই ১৬ ছাড়িয়ে গিয়েছে। গুলিবিদ্ধ অনেকেই হাসপাতালে শুয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। গোটা ঘটনাটিকে ‘শয়তানের কাজ’ বলে বিবৃতি দিয়েছেন অসি প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টোনিও অ্যালবানিজ়। কিন্তু কী কারণে ক্যাঙারু রাষ্ট্রে বসবাসকারী ইহুদিদের নিশানা করল দুই বন্দুকবাজ? এই নিয়ে প্রাথমিক তদন্তে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাতে পেয়েছে স্থানীয় পুলিশ।
তদন্তকারীদের দাবি, ইহুদি ধর্মের প্রতি প্রবল ঘৃণা থেকে এই হামলা চালিয়েছে দুই বন্দুকবাজ। আততায়ীরা আবার সম্পর্কে পিতা-পুত্র হওয়ায় পারিবারিক ভাবে তাঁদের মধ্যে ইহুদি বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে পড়ে বলে মনে করছে অসি পুলিস। এই ঘটনার নেপথ্যে ইসলামি কট্টরপন্থীদের কতটা হাত রয়েছে, তাও খতিয়ে দেখছেন তাঁরা। তবে সমুদ্রসৈকতে গণহত্যার মাধ্যমে আততায়ীরা ইহুদি রাষ্ট্র ইজ়রায়েলকে বার্তা দিতে চেয়েছেন বলেও তদন্তে উঠে এসেছে।
গত দু’বছরের বেশি সময় ধরে চলা গাজ়া যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে ওঠে গণহত্যার অভিযোগ। প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসকে নিকেশ করতে ভূমধ্যসাগরের কোলের উপত্যকাটির নিরীহ বাসিন্দাদেরও রেয়াত করেনি ইহুদি ফৌজ। লাগাতার তাঁদের উপর চলেছে বিমানহানা। ট্যাঙ্কের গোলায় গুঁড়িয়ে গিয়েছে হাসপাতাল। ফলে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে মৃত্যু। শুধু তা-ই নয়, ‘ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স’ বা আইডিএফ খাবার ও ওষুধ ঢুকতে দেয়নি বলে গাজ়ায় দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলেও দাবি করেছে একাধিক গণমাধ্যম।
গাজ়া যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই দুনিয়া জুড়ে ঊর্ধ্বমুখী হয় ইহুদি বিদ্বেষের সূচক। আমেরিকা-ইউরোপের একাধিক জায়গায় মিছিল করেন প্যালেস্টাইনপন্থীরা। ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দেখা গিয়েছে মানবতাবাদী সংগঠনের নেতা-নেত্রীদের। গত সেপ্টেম্বরে প্যালেস্টাইনকে অনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃতি দেয় ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডা-সহ একগুচ্ছ দেশ। সেই তালিকায় নাম ছিল অস্ট্রেলিয়ারও। এ ব্যাপারে প্রবল আপত্তি জানিয়েও আন্তর্জাতিক মহলে নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারেনি তেল আভিভ।
সূত্রের খবর, সেপ্টেম্বর থেকেই অস্ট্রেলিয়ায় মারাত্মক ভাবে বাড়তে থাকে ইহুদি বিদ্বেষ। ডিসেম্বরে পৌঁছে তাতে পেট্রল ঢালার কাজটি করেন ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্সের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াল জামির। সম্প্রতি যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজ়ার উত্তর দিকের বেইত হানুন এবং জ়াবালিয়া এলাকা পরিদর্শন করেন তিনি। এর পর সেখানে মোতায়েন সৈনিকদের নির্দেশ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘গাজ়াকে যে হলুদ রেখায় বিভক্ত করা হয়েছে, এখন থেকে সেই পর্যন্ত আমাদের নতুন সীমান্ত। এর জন্য বাহিনীকে অবস্থান ধরে রাখতে হবে।’’
আইডিএফ প্রধানের ওই মন্তব্যের পর দানা বাঁধে বিতর্ক। ইজ়রায়েলের প্রতিবেশী মিশরের অভিযোগ, এর মাধ্যমে দেশের সীমান্ত বৃদ্ধি করছে ইহুদি ফৌজ। ‘হলুদ রেখা’ পর্যন্ত কব্জা করে অর্ধেক গাজ়া ইজ়রায়েলের সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জ়ামির, যা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তৈরি করে দেওয়া শান্তিপ্রস্তাবের পরিপন্থী। অন্য দিকে তেল আভিভের যুক্তি, শর্ত মেনে হাতিয়ার ত্যাগ করছে না হামাস। ফলে ‘হলুদ রেখা’ থেকে বাহিনী প্রত্যাহার অসম্ভব।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, চলতি বছরের অক্টোবরে গাজ়ার ভাগ্য ঠিক করতে ট্রাম্পের নেতৃত্বে শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করে মিশর। সেখানে অবশ্য হাজির ছিল না যুযুধান ইজ়রায়েল এবং প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। সংশ্লিষ্ট বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের দেওয়া ২০ দফা শর্ত মেনে নেয় ইসলামীয় দুনিয়ার একগুচ্ছ দেশ। ট্রাম্পের শান্তিপ্রস্তাবে সায় দেয় ভারতও। মাত্র দু’মাসের মধ্যে তা পুরোপুরি ব্যর্থ হতে চলেছে বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল।
ট্রাম্পের দেওয়া ২০ দফা প্রস্তাব মেনে মিশরের শান্তি সম্মেলনে গাজ়া উপত্যকাকে কয়েকটি রেখায় ভাগ করে আন্তর্জাতিক মহল। তারই একটি হল ‘ইয়েলো লাইন’ বা হলুদ রেখা। এর ঠিক পিছনে রয়েছে লাল রঙের আর একটি রেখা। শান্তি বৈঠকে ঠিক হয়, ওই লাল রেখা পেরিয়ে যুদ্ধ পূর্ববর্তী অবস্থানে ফিরে যাবে ইহুদি ফৌজ। অন্য দিকে ওই প্যালেস্টাইন ভূমির নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে একটি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনী। আইডিএফ পিছোতে থাকলে ধীরে ধীরে গাজ়ায় ঢুকবে তারা। ট্রাম্পের দেওয়া এই প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত মেনে নেয় হামাস।
ডিসেম্বরের গোড়ায় গাজ়ার ‘গ্রাউন্ড জ়িরো’র পরিস্থিতি নিয়ে বিস্ফোরক দাবি করে তুরস্কের আনাডোলু-সহ পশ্চিম এশিয়ার একাধিক সংবাদসংস্থা। সেই প্রতিবেদনগুলিতে বলা হয়েছে, সংঘর্ষবিরতির পর টানা ১১ সপ্তাহ ধরে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী এলাকায় ইজ়রায়েলি সেনার হামলায় অন্তত ৩৫৭ জন নিরীহ প্যালেস্টাইনি নাগরিক নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৯০০। যদিও একে ‘মিথ্যা প্রচার’ বলে পাল্টা বিবৃতি দিতে দেরি করেনি আইডিএফ।
ইহুদি ফৌজের দাবি, হামাসের গুপ্ত ঠিকানাগুলিতে ‘সুনির্দিষ্ট হামলা’ চালানো হয়েছে। কোনও নিরীহ প্যালেস্টাইনবাসীকে হত্যা করা হয়নি। এর পাশাপাশি নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে গাজ়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীটির একাধিক ভিডিয়ো প্রকাশ করে আইডিএফ। সেখানে হামাসের যোদ্ধাদের স্বয়ংক্রিয় রাইফেল হাতে গাজ়ার বাজারে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গিয়েছে।
তুরস্ক ও কাতারের গণমাধ্যমগুলি জানিয়েছে যে, নভেম্বরের গোড়া থেকে গাজ়ায় মোতায়েন বাহিনী প্রত্যাহারের ব্যাপারে গতি কমায় ইজ়রায়েল। ‘হলুদ রেখা’য় পৌঁছোতে তাঁদের বেশ কয়েক দিন সময় লেগেছিল। আইডিএফের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জামিরের নির্দেশমতো ওই এলাকাকে ইহুদি রাষ্ট্রটি নিজেদের নতুন সীমান্ত বলে ঘোষণা করলে অর্ধেক গাজ়ার দখল চলে আসবে তেল আভিভের হাতে। সে ক্ষেত্রে অর্ধেক হয়ে যাবে ওই প্যালেস্টাইনভূমি। অন্য দিকে নেতানিয়াহু সরকার পাবে বিস্তীর্ণ উর্বর জমি।
‘হলুদ রেখা’কে নতুন সীমান্ত বানানোর পাশাপাশি গাজ়ার দক্ষিণ দিকের রাফা সীমান্তকে বর্তমানে পুরোপুরি বন্ধ করে রেখেছে ‘ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্স’। এত দিন এই রাস্তা ধরে মিশর থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী ঢুকত ওই প্যালেস্টাইনভূমিতে। আইডিএফের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেখানকার বাসিন্দাদের রাফা গিয়ে গাজ়া ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে দিচ্ছে আইডিএফ। কিন্তু এক বার কেউ চলে গেলে আর ফিরে আসতে দেখা যাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, গাজ়ার ব্যাপারে ইজ়রায়েলের এ-হেন ‘আগ্রাসী’ মনোভাব বিশ্বের অন্য প্রান্তে বসবাসকারী ইহুদিদের বিপদে ফেলেছে। অস্ট্রেলিয়ার সৈকতে হামলার নেপথ্যে সেটা একটা বড় কারণ হতে পারে। দুনিয়ার কোনও জায়গাই যে ইহুদিদের জন্য নিরাপদ নয়, এই আক্রমণের মাধ্যমে আততায়ী তা প্রমাণ করতে চেয়েছেন। ‘ক্যাঙারু রাষ্ট্র’-এর সিডনি এবং মেলবোর্ন দু’টি শহরে ইহুদিদের বাস সবচেয়ে বেশি। সব মিলিয়ে ১.২-১.৩ লাখ ইহুদি থাকে সেখানে।
গত ১৪ ডিসেম্বর সিডনির বন্ডি সমুদ্রসৈকতে ‘হানুকা’ উৎসবে মেতেছিলেন ইহুদিরা। সেখানে শামিল ছিলেন অন্তত হাজার জন। ভিড়ে ঠাসা ওই জায়গায় আচমকাই স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ঢুকে পড়ে দুই আততায়ী। ভিড় লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে তাঁরা। ফলে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ১৫ জনের। নিহতদের মধ্যে ১০ থেকে ৮৭ বছর বয়সিরা রয়েছেন। হামলার জন্য উৎসবস্থলকে বেছে নেওয়ার উদ্দেশ্য হল একসঙ্গে বহু ইহুদিকে নিকেশ করা। অতীতেও যা বারে বারে ঘটতে দেখা গিয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইজ়রায়েলে ঢুকে ভয়ঙ্কর হামলা চালায় প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। ইহুদি-ক্যালেন্ডার অনুযায়ী দিনটা ছিল ‘সিমচ্যাট তোহ্রা’ বা বর্ষশেষের দিন। ফলে উৎসবে মেতে ছিলেন ইজ়রায়েলের আম নাগরিক। ঠিক তখনই হামাস আক্রমণ শানানোয় প্রাণ হারান হাজারের বেশি নিরীহ বাসিন্দা। ২৫০-র বেশি মানুষকে পণবন্দিও করে নিয়ে যায় ওই প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী। তাঁদের প্রত্যেককেই জীবিত বা মৃত অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছে আইডিএফ।
১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর ইহুদিদের পবিত্র ইয়োম কিপ্পুর দিবসে ইজ়রায়েল আক্রমণ করে মিশর ও সিরিয়ার যৌথ বাহিনী। তাদের সমর্থন জানিয়েছিল একাধিক আরব রাষ্ট্র। দু’সপ্তাহ পাঁচ দিন ধরে চলা লড়াই শেষে দেখা যায় সিরিয়ার গোলান মালভূমির (গোলান হাইট্স) একটা বড় অংশ কব্জা করে ফেলেছে আইডিএফ। মিশরের সুয়েজ খালের পশ্চিম তীরের ১,৬০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার উপরেও ছিল তেল আভিভের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ।
১৫ ডিসেম্বর সকালে অসি পুলিশ জানায়, প্রায় ১০ মিনিট ধরে নির্বিচারে গুলি চালায় দুই বন্দুকবাজ। পরে তাঁদের মধ্যে একজনকে এনকাউন্টারে খতম করেন স্থানীয় উর্দিধারীরা। বছর ৫০-এর ওই ব্যক্তির নাম সাজিদ আক্রম। তাঁর নামে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ছিল। তাঁকে সঙ্গ দেন তাঁর ২৪ বছরের পুত্র নবিদ। তাঁকে গুরুতর জখম অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালে। নবিদকে কড়া পুলিশি প্রহরায় রেখেছে অসি প্রশাসন। এ ছাড়া দুই পুলিশ আধিকারিক-সহ হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৪০ জন।
বন্ডি হামলার আততায়ীরা পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বলে জানা গিয়েছে। পরে হামলার সময়কার একটি ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে এক যুবককে খালি হাতে এগিয়ে গিয়ে পিছন থেকে আততায়ীকে জাপটে ধরে তাঁর আগ্নেয়াস্ত্র কেড়ে নিতে দেখা গিয়েছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে দাবি, ওই যুবকের নাম আহমেদ আল আহমেদ। তিনি বন্ডি সৈকতে ফল বিক্রি করেন। ঘটনায় তিনিও আহত হয়েছেন এবং হাসপাতালে রয়েছেন।
পুলিশ জানিয়েছে, বন্ডি সৈকতের কাছে দু’টি বোমা সক্রিয় অবস্থায় রাখা ছিল। সেগুলিকে চিহ্নিত করে পরে নিষ্ক্রিয় করা হয়। জানা গিয়েছে, নিহত বন্দুকবাজ প্রৌঢ়ের কাছে ছ’টি বন্দুক ছিল। সেগুলিই হামলায় ব্যবহার করা হয়েছিল। কী ভাবে তিনি লাইসেন্স পেলেন, তা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।
গত এপ্রিলে জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে পাকিস্তান মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় পর্যটক-সহ মৃত্যু হয় ২৬ জনের। ওই ঘটনার সঙ্গে সিডনি সৈকতের গণহত্যার মিল খুঁজে পেয়েছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। পহেলগাঁওয়ে ধর্ম জিজ্ঞাসা করে পর্যটকদের মাথায় একে-৪৭ রাইফেল থেকে গুলি চালায় সন্ত্রাসীরা। এ ক্ষেত্রে মারাত্মক ভাবে ‘হিন্দু বিদ্বেষ’ কাজ করেছে বলে মনে করেন তাঁরা।