ধারবাকিতে চলছে গোটা বিশ্ব। ফলে প্রতি দিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পৃথিবীর ঋণের বোঝা। আমজনতা থেকে সরকার— এ ক্ষেত্রে সকলেই একই পথের পথিক। এ-হেন ঋণের ফাঁদ ঘিরে আর্থিক বিশ্লেষকেরা প্রকাশ্যে এনেছেন চাঞ্চল্যকর তথ্য। তাঁদের দাবি, আয়ের চেয়ে অনেক বেশি ঋণ নিয়ে ফেলেছে গোটা দুনিয়া। খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে বহু দেশ যাদের দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং একাধিক সমীক্ষক সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের মোট ঋণের পরিমাণ ৩২৪ লক্ষ কোটি ডলারে পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু মজার বিষয় হল, দুনিয়ার সমস্ত দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি (গ্রুস ডোমেস্টিক প্রোডাক্টস) একত্রিত করলে তার অঙ্ক দাঁড়াবে ১১১.৩ লক্ষ কোটি ডলার। অর্থাৎ আয়ের চেয়ে ২৯১ শতাংশ বেশি ঋণ নিয়ে ফেলেছে তারা। এই পরিসংখ্যান যে যথেষ্ট উদ্বেগজনক, মানছেন তাবড় আর্থিক বিশ্লেষকেরাও।
বিশ্বের প্রতিটা দেশ দু’রকম ভাবে ঋণ নিয়ে থাকে। একটি হল, অভ্যন্তরীণ ঋণ। অপরটির নাম জাতীয় ঋণ। অভ্যন্তরীণ ঋণ নিজের দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক থেকে নিতে হয়। উদাহরণ হিসাবে কোনও সমাজকল্যাণ বা পরিকাঠামোমূলক উন্নয়ন প্রকল্পের কথা বলা যেতে পারে। সেগুলি চালানোর জন্য প্রায়শই রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই) থেকে ধার নিয়ে থাকে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার। প্রকল্পের কাজ চলাকালীন বা শেষ হওয়ার বেশ কয়েক বছর পর তা ধীরে ধীরে মিটিয়ে দেয় প্রশাসন।
এখানে উল্লেখ্য, সরকার এই ধরনের ঋণ নিলে আরবিআইয়ের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ককে টাকা ছাপতে হয়। সেই টাকা প্রশাসনের হাতে তুলে দেয় তারা। তবে এখানে একটা সমস্যা রয়েছে। প্রতিটা ক্ষেত্রে ঋণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক টাকা ছাপা শুরু করলে ঘরোয়া বাজারে অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। সে ক্ষেত্রে মুদ্রাস্ফীতির খাদে গিয়ে পড়তে পারে অর্থনীতি। আর তাই সরকারের হাতে ঋণের অর্থ তুলে দিতে আরও দু’টি পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধারের টাকা জোগাড় করতে সিকিউরিটি বন্ড এবং ট্রেজ়ারি বিল নিয়ে আসে সরকার। এর মাধ্যমে বাজারের লগ্নিকারীদের থেকে টাকা তোলে প্রশাসন। বিনিময়ে তিন থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ পেয়ে থাকে তারা। এখানে ঋণগ্রহণকারী যে হেতু খোদ সরকার, তাই সিকিউরিটি বন্ড বা ট্রেজ়ারি বিলে টাকা ধার দিতে বিনিয়োগকারীদের সে ভাবে আপত্তি থাকে না। এই লগ্নিকারী কিন্তু সাধারণ নাগরিক থেকে শিল্পপতি, যে কেউ হতে পারেন।
সিকিউরিটি বন্ড বা ট্রেজ়ারি বিলকে বরাবরই সুরক্ষিত একটি বিষয় বলে গণ্য করা হয়েছে। এর মাধ্যমে এক দিকে যেমন বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা তুলতে পারে সরকার, অন্য দিকে ঋণগ্রহণকারীদের সামনে থাকে বাৎসরিক আয়ের সুযোগ। কারণ, সিকিউরিটি বন্ড বা ট্রেজ়ারি বিল সাধারণত ৫০ থেকে ৬০ বছরের মেয়াদে জারি করে সরকার। এই সময়সীমার মধ্যে সুদের টাকা পেতেই থাকেন লগ্নিকারীরা।
এ ছাড়া বাজার থেকে টাকা তুলতে সরকারের হাতে রয়েছে স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্প। ভবিষ্যত জীবনকে সুরক্ষিত করতে এতেও বহু মানুষ টাকা রাখেন। সেই অর্থ বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যবহার করে প্রশাসন। বিনিময়ে সুনির্দিষ্ট হারে লগ্নিকারীদের সুদ দিয়ে থাকে তারা। এতে সুদের হার সাধারণ ভাবে কম রাখা হয়। শুধু তা-ই নয়, স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্প শেয়ার বাজারের ওঠানামার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ফলে এতেও দু’তরফে লাভবান হওয়ার সুযোগ পেয়ে থাকে আমজনতা এবং সরকার।
আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, অভ্যন্তরীণ ঋণের ক্ষেত্রে দেশের মধ্যেই এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অ্যাকাউন্টে ঘুরতে থাকে টাকা। কখনও সিকিউরিটি বন্ড থেকে কোষাগারে আসা অর্থ চলে যায় কোনও উন্নয়নমূলক প্রকল্পে। আবার সেখান থেকে উপার্জিত টাকায় মেটানো হয় অন্য কোনও খরচ। আর তাই এই ধরনের ঋণে ঝুঁকির মাত্রা অনেকটাই কম।
তবে কোনও দেশ, বিশ্ব ব্যাঙ্ক, আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আইএমএফ) বা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের মতো প্রতিষ্ঠান থেকেও ধার নিতে পারে সরকার। অভ্যন্তরীণ ঋণের চেয়ে এটা অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, এই ঋণের টাকা কোনও অবস্থাতেই না মিটিয়ে পার পাবে না প্রশাসন। দ্বিতীয় সমস্যার জায়গা হল, সংশ্লিষ্ট দেশটির মুদ্রার দাম কমে বা বেড়ে গেলে, সেই ধাক্কাও সামলাতে হবে ঋণগ্রহণকারী সরকারকে।
২০২৫-’২৬ আর্থিক বছরের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ভারতের উপরে রয়েছে ২.২৩ লক্ষ কোটির ঋণের বোঝা। কিন্তু এর মধ্যে ২.১৫ লক্ষ কোটির ধার হল অভ্যন্তরীণ ঋণ। এই টাকার সিংহভাগ কোনও না কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে দিয়ে রেখেছে কেন্দ্র। অর্থাৎ টাকা নেওয়া ও দেওয়া উভয় দিকেই রয়েছে সরকার। পরিসংখ্যান বলছে নয়াদিল্লির মোট ঋণের প্রায় ৯৪ শতাংশ অভ্যন্তরীণ। বাকিটা বৈদেশিক ঋণ, যা নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই রয়েছে।
গত বছরের জুনে বিশ্বব্যাপী আমজনতার নেওয়া ঋণ সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। সেখানে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে এই ঋণের অঙ্ক বাড়তে বাড়তে ৯৭ লক্ষ কোটিতে পৌঁছেছে। ২০০০ সালে এই পরিমাণ ছিল ১৭ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত প্রায় আড়াই দশকে বিশ্বব্যাপী ঋণের পরিমাণ ৫ গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্টে বলা হয়েছে, শেষ ১০ বছরে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সরকারি ঋণ। উন্নত দেশগুলির তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলি বেশি ঋণ নিয়েছে। এই ঋণের ৩০ শতাংশ ২০০০ সাল আসার আগেই ওই দেশগুলি নিয়েছিল বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, উন্নয়নশীল দেশগুলি মূলত শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয় ঠেকাতে ঋণ নিয়ে থাকে। এই খাতে নেওয়া ঋণের এক-তৃতীয়াংশই বকেয়া রয়েছে বলে জানিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলির জনসংখ্যা ৩৩০ কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে। এই রাষ্ট্রগুলির প্রতি তিনটির মধ্যে একটি শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যে বিপুল টাকা খরচ করে। এই খাতে তাদের খরচের পরিমাণ বার্ষিক সুদের চেয়ে অনেকটাই বেশি বলে রিপোর্টে উঠে এসেছে।
উন্নয়নশীল দেশগুলির নেওয়া ঋণের পরিমাণ শুধুমাত্র ২০২৩ সালেই ২৯ লক্ষ কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী নেওয়া মোট ঋণের ৩০ শতাংশ। ২০১০ সালে এই পরিমাণ ১৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের দাবি, বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশের কর কাঠামো শক্তিশালী নয়। এর ফলে উন্নয়নমূলক কর্মসূচির জন্য সরকারের হাতে পর্যাপ্ত টাকা থাকছে না। ফলে ঋণের উপরেই সরকারকে নির্ভর করতে হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির দ্বিতীয় কারণ হল অর্থের অবমূল্যায়ন। বিশ্ব অর্থনীতিতে ডলার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি লেনদেনের মাধ্যম। কিন্তু আর্থিক মন্দা থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তন ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে ডলারের দামে পতন দেখা গিয়েছে।
তৃতীয়ত, বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশই ডলারের থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। নিজেদের দেশের অর্থেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চালাতে চাইছে তারা। তালিকায় রয়েছে ভারত, রাশিয়া ও চিনের মতো শক্তিধর রাষ্ট্র। এর ফলেও ডলারের দাম ও চাহিদা দিন দিন কমছে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট অনুযায়ী, আফ্রিকার দেশগুলি আমেরিকার চেয়ে গড়ে চার গুণ আর জার্মানির চেয়ে গড়ে আট গুণ বেশি হারে ঋণ নিয়ে থাকে। এই প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিও গুতারেজ় বলেছেন, ‘‘ঋণের টাকাতেই উন্নয়নমূলক কাজ করতে পছন্দ করে আফ্রিকার অধিকাংশ দেশ। তাদের কাছে সরকারি অর্থ ও ঋণ সমার্থক।’’
রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ২০১১ সালে উচ্চ হারে ঋণ নেওয়া দেশের সংখ্যা ছিল ২২। এই সংখ্যা ২০২২ সালে একলাফে বেড়ে ৫৯-এ পৌঁছে গিয়েছে। এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলির নামই এ ক্ষেত্রে সবার আগে রয়েছে।