হ্যারি পটারের সিনেমার ৯ পূর্ণ ৩/৪ নম্বরের মতো একটি প্ল্যাটফর্মের অস্তিত্ব রয়েছে ‘মাগল’দের দুনিয়াতেও। সেই স্টেশনে রয়েছে একটি গুপ্ত প্ল্যাটফর্ম। যদিও লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়েছে সেই প্ল্যাটফর্মটি। ব্যবহারও করতে দেওয়া হয় না সকলকে।
নিউ ইয়র্কের গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশন। বিশ্বের বৃহত্তম রেলওয়ে স্টেশনের খেতাবটিও পেয়েছে এই স্টেশন। প্রতি দিন অগণিত মানুষের যাতায়াত এই স্টেশনে। এটি ব্যস্ততম স্টেশনও বটে। শুধুমাত্র আকার বা বিপুল সংখ্যক যাত্রীর যাতায়াত নয়, এই প্রাচীন রেলস্টেশনের নির্মাণকার্য মুগ্ধ করে দেশ-বিদেশ থেকে আসা ভ্রমণার্থীদের।
ভারতের কোনও ব্যস্ত রেলস্টেশনের কথা উঠলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভিড়ে ঠাসা ট্রেনের আনাগোনা, হইচই চিৎকার, যাত্রীদের ব্যস্ততা, ঠেলাঠেলি। নিউ ইয়র্ক সিটির গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল টার্মিনালের চিত্র কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এই রেলস্টেশনটি এতটাই বিশাল এবং প্রাসাদের মতো যে, এর অত্যাশ্চর্য সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য প্রতি দিন এক বার হেঁটে যেতে মন চাইবে। শতাব্দীপ্রাচীন এই রেলস্টেশন স্থাপত্যের দিক থেকেও স্বতন্ত্র।
৪৮ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই স্টেশনটি একটি স্থাপত্যের বিস্ময়। এর বিশালত্ব এতটাই যে বিশ্বের বৃহত্তম রেলওয়ে স্টেশন হিসাবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডটি রয়েছে এর ঝুলিতেই।
স্টেশনটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৯০৩ সালে। শেষ হয় ১৯১৩ সালে। টানা ১০ বছর ধরে কাজ চললেও সেই নির্মাণকাজ এখনও সম্পূর্ণ ভাবে শেষ হয়নি বলেই জানা যায়। গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল টার্মিনালটি আনুষ্ঠানিক ভাবে ১৯১৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি চালু করে দেওয়া হয়।
দিনটি ছিল রবিবার। রাত ১২টা ০১ মিনিট বাজতেই বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের শেষে সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় এই স্টেশন। উদ্বোধনের দিনে দেড় লক্ষেরও বেশি মানুষ ভিড় জমিয়েছিলেন সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী থাকতে।
বিশাল এই রেলস্টেশনে পা রাখলে মনে হবে সময় ভ্রমণ করে পুরনো কোনও প্রাসাদে উপস্থিত হয়েছেন। এর জাঁকজমক দেখলে মনে হবে মধ্যযুগের কোনও রাজকীয় প্রাসাদের ভিতরে ঢুকে পড়েছেন। স্টেশনটি তিন স্থাপত্য সংস্থা রিড অ্যান্ড স্টেম, ওয়ারেন এবং ওয়েটমোরের মিলিত প্রয়াস। এর নকশা বা গঠনটি বোজ়-আর্টসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসাবে ধরা হয়ে থাকে। বিউক্স-আর্টস হল একটি ফরাসি শব্দ যা স্থাপত্য এবং সূক্ষ্ম শিল্প উভয়কেই বোঝায়।
স্টেশনের প্রধান কনকোর্সে ১২টি সোনালি নক্ষত্রপুঞ্জ এবং আড়াই হাজার তারা সমেত একটি অত্যাশ্চর্য ‘সিলিং ম্যুরাল’ রয়েছে, যা দর্শনার্থীদের চোখে স্টেশনটিকে আরও মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে। এর জাঁকজমক এতটাই বেশি যে তা রাজকীয় প্রাসাদকেও ছাড়িয়ে যায়।
গ্র্যান্ড সেন্ট্রালের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ কনকোর্সে অবস্থিত চারমুখী ওপাল ঘড়িটি। এর মূল্য ভারতীয় মুদ্রায় ৮৭ কোটি টাকারও বেশি। দর্শনার্থী এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে এই বিশেষ জায়গাটি কারও জন্য অপেক্ষা করার একটি পছন্দের জায়গা।
স্টেশনের টার্মিনালে মোট ৪৪টি প্ল্যাটফর্ম রয়েছে, যা বিশ্বের অন্য যে কোনও রেলস্টেশনের চেয়ে বেশি। এর সমস্ত প্ল্যাটফর্ম মাটির নীচে অবস্থিত। টার্মিনালটি উপরের স্তরে ৩০টি ট্র্যাক এবং নীচের স্তরে ২৬টি ট্র্যাক রয়েছে। সাইডিং এবং একটি রেল ইয়ার্ড-সহ মোট ৬৭টি ট্র্যাক রয়েছে। মেট্রো ও ট্রেন মিলিয়ে প্রতি দিন প্রায় ৬৬০টি ট্রেন স্টেশন দিয়ে যাতায়াত করে।
শুধুমাত্র যাতায়াতের জন্য নয়, গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশনটি অন্যতম বিখ্যাত এর পর্যটন আকর্ষণের জন্য। এই টার্মিনালটিকে জাতীয় ঐতিহাসিক ল্যান্ডমার্ক হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং এর অত্যাশ্চর্য সৌন্দর্যের কারণে এটি আমেরিকার সবচেয়ে বেশি পরিদর্শন করা স্থানের মধ্যে একটি।
বহু হলিউডি সিনেমায় ব্যবহার করা হয়েছে স্টেশনটিকে। এখানে রয়েছে অনুষ্ঠানগৃহ, রয়েছে লাইব্রেরি এবং টেনিস ক্লাবও। স্টেশনটিতে রয়েছে বিখ্যাত হুইস্পারিং গ্যালারিও। এখানে এলে লোকেরা হল জুড়ে ফিসফিসানি শুনতে পান।
প্রতি দিন গড়ে দেড় লক্ষ মানুষ এখানে যাতায়াত করেন।
মজার বিষয় হল, গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল টার্মিনালে ওয়াল্ডর্ফ অ্যাস্টোরিয়া হোটেলের নীচে একটি গোপন প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। এই প্ল্যাটফর্মটি আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজ়ভেল্ট হোটেল থেকে গোপনে বেরিয়ে আসার জন্য ব্যবহার করেছিলেন। তবে, ট্র্যাক ৬১ নামে পরিচিত এই গোপন প্ল্যাটফর্মটি দিয়ে নিত্যযাত্রীরা যাতায়াত করতে পারেন না। সেই অনুমতি নেই জনসাধারণের।
গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল টার্মিনাল দিয়ে প্রতি দিন বিপুল সংখ্যক যাত্রী যাতায়াত করেন। ছাতা থেকে শুরু করে মানিব্যাগ, এখানে প্রতি বছর ১৯ হাজারেরও বেশি জিনিসপত্র হারিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যায়। জিনিসপত্র উদ্ধারের জন্য প্রতি দিন যাত্রীরা ভিড় করেন সেখানকার কার্যালয়ে।