কা গে র ছা ব গে র ছা

মহাত্মা, মাছ আর পাগলের গল্প

ঠিক কোন সময় থেকে মনে রাখার ব্যাপারটা যে শুরু হয়ে যায়, তা আমরা কেউই তেমন ভাবে বলতে পারি না। অনেক দূরে সরে এসে কেন কত কিছুই যে আর মনে পড়ে না, আবার কেনই যে কত কিছু হঠাৎ ঘাই মেরে উঠে আসে, বোঝা খুব মুশকিল।

Advertisement

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৫ ০০:০২
Share:

ঠিক কোন সময় থেকে মনে রাখার ব্যাপারটা যে শুরু হয়ে যায়, তা আমরা কেউই তেমন ভাবে বলতে পারি না। অনেক দূরে সরে এসে কেন কত কিছুই যে আর মনে পড়ে না, আবার কেনই যে কত কিছু হঠাৎ ঘাই মেরে উঠে আসে, বোঝা খুব মুশকিল। জন্ম নেওয়ার পর থেকেই চোখের সামনে নানান ভাবে দৃশ্যেরা এসে হাজির হতে থাকে আর কখনও কখনও অত্যাশ্চর্য এক এরিয়াল মারফত মনের গভীরে ঢুকে পড়ে অপেক্ষা করতে থাকে দিন মাস বছর— কখনও রঙে ধরা দিতে, কখনও শব্দে, কখনও সিনেমার পরদায়। গভীর থেকে একেবারে ওপরে উঠে আসার মাঝখানে ঘটে অত্যদ্ভুত সব ম্যাজিক।

Advertisement

দিদি তখন অনেক ছোট। আরও ছোট দিদির কোল। সেই কোলের ওপর শুয়ে আছি আমি। হঠাৎ বাইরে অসম্ভব চিৎকার, কান্না আর হাজার হাত-পায়ের ছোটাছুটি। আমাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে দিদিও ছুটে গেল বাইরে, তার পর ব্যস আর কিছু মনে নেই। কয়েক বছর পর জেনেছিলাম, সেটা ছিল নাথুরাম গডসের হাতে মহাত্মা গাঁধীর মরে যাওয়ার দিন। সে দিন, এমনকী তার পরের দিনও মা কিছু রান্না করেননি, পিঠোপিঠি বাড়িগুলোর অবস্থাও তাই। বাবা রুগি দেখবেন কী, রুগিরাই বাবাকে দেখলে ভাল হয়। সক্কালবেলা রুটিওয়ালা সাইকেল করে ব্যাগ-ভর্তি পাউরুটি বিক্রি করতে আসত। পাউরুটির ওপর ছোট্ট একটা বিস্কুট বসানো থাকত। শুধু পাউরুটি খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছিল পাড়াপড়শি সবাই। মহাত্মা গাঁধীকে আমি চিনতাম না। পরের কয়েক দিন পাউরুটিওয়ালা এল না। পাউরুটির পিঠে লেগে থাকা সেই ছোট্ট বিস্কুটের জন্য আমার কষ্ট হত। হাসপাতালের ড্রেসার-কাকু, মানে রতনকাকুর মাথাটা একদম খারাপ হয়ে গেল। মাথা কামিয়ে, হাঁটুর ওপর সাদা ধুতি পরে, লাঠি হাতে, নাকের ওপর গোল চশমা ঝুলিয়ে ভোর থেকে হেঁটে বেড়াত পাড়ায় আর মাঝে মাঝে গেয়ে উঠত— প্রেমেরও পূর্ণিমা চাঁদ/ ফিরে আয় ফিরে আয়/ অন্ধকারের নদিয়ায়...

আর ছিল বিশাল বড় একটা চৌবাচ্চা। বাবার বাতিক ছিল, ছেলেমেয়েকে জ্যান্ত মাছ খাওয়াবেন। সাইকেল করে অনেক দূর দূর থেকে রোগী দেখে ফেরার পথে নানান জায়গা থেকে ছোট-মাঝারি জ্যান্ত মাছ নিয়ে এসে ওই চৌবাচ্চায় ছেড়ে দিতেন। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম, আর দেখতাম বাচ্চা-মাছেদের ল্যাজ নাড়া, ঠোঁট বন্ধ করা, ঠোঁট খোলা। এর কয়েক বছর পর শরীরের ভেতর রহস্যময় কিছু অনুভূতি টের পেতে শুরু করলাম। বুঝতেই পারতাম না কেন এমন হচ্ছে, কী-ই বা মানে এ-সবের। ফরিদপুর থেকে চলে এল বাবার এক তুতো-মাসির পরিবার। ওখানে নাকি আর থাকা যাচ্ছে না। বাবার ওপর দায়িত্ব বর্তাল মাসির দুই মেয়ের পাত্র খুঁজে দেওয়ার। ঢালাও বিছানায় আমরা সব ভাইবোন, সেই মাসি আর তার দুই মেয়ে ঘুমোতাম। হঠাৎ হঠাৎ মাঝরাত্তিরে কেউ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরত আমাকে, আর আমার নাকে এসে লাগত মাথার ঘন লম্বা চুলের ফাঁকফোকর থেকে বেরিয়ে আসা অদ্ভুত এক গন্ধ। আমার তলপেট থেকে উঠে আসত একটা রাগ। বহু দিন পর্যন্ত অচেনা অজানা কোনও এলানো চুলের দিকে চোখ পড়ে গেলেই সেই গন্ধ স্মৃতি হয়ে ফিরে আসত আমার কাছে। দুপুরবেলা সবাই যখন ঘুমে, আমি চৌবাচ্চার ওপর ঝুঁকে মাছেদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, ভাবতাম মাঝে মাঝে, এক একটা মাছ মুখোমুখি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে কানে কানে কী কথা বলে? হয়তো আমার ভেতর সদ্য জমতে শুরু করা রাগ আর ঘেন্নার কথাই বলত ওরা।

Advertisement

আমি সাপ ব্যাং ঘোড়া কুমির আরও অনেক কিছুর মাংস খেয়েছি, আর প্রাণের বন্ধু ইকবালের মা, স্কুলফেরত আমাদের দুজনকে পাশাপাশি বসিয়ে গোস্ত-ভাত মেখে খাইয়ে দিতেন। বলতেন, ঘরে গিয়া কইস না। কিন্তু শুয়োরের মাংস? তওবা তওবা।

আমার দিদিমারা, ঘরদোরপুকুরবাগান সব ছেড়েছুড়ে রাতারাতি পুরো সংসার উঠিয়ে ঢাকার পুরানা পল্টনের দালানবাড়ি ফেলে হাজরা রোডে ছোট্ট একটা একতলার ফ্ল্যাটে উঠে এলেন, সঙ্গে হানিফা। হানিফাকে ‘পাগল’ বলে ডাকত সবাই। ঢাকার কোন রাস্তায় যেন বারো বছরের হানিফাকে ভিক্ষে করতে দেখে দিদিমা সেই যে বাড়ি নিয়ে এসেছিলেন, তার পর থেকে পুরানা পল্টনের বাড়ির লোকজনই হয়ে উঠল হানিফার সব কিছু। মেজমামা, ছোটমামা আর ছোটমাসির থেকে বয়সে বড় ছিল পাগল। ছোটমামা আর মাসিকে কেউ কিছু বললে আর রক্ষে নেই, দিদিমাও বাদ যেতেন না। পাগলের চোখরাঙানির ঠেলায় সবাই তটস্থ থাকত। হাজরা রোডে সকাল-বিকেল তখন অনেক গরু অবাধে ঘুরে বেড়াত। এ দিকে সব ছেড়ে এসে কয়লা কেনার পয়সাটুকুও ছিল না দিদিমার কাছে। গরুদের পরই রাস্তায় নেমে পড়তাম আমরা— দিদিমা, আমি আর পাগল। আমার আর পাগলের চার হাতে একটা একটা করে ঝুড়ি। রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা টাটকা গোবরের দিকে তাকিয়ে চকচক করে উঠত দিদিমার চোখ, আর কিছু ক্ষণের মধ্যেই আমাদের ঝুড়ি ভরে উঠত গোবরে। তার সঙ্গে খড় মিশিয়ে দিদিমার হেঁশেলের ভাত ফোটানোর আগুন জ্বলত। পাগল মাঝে মাঝে কাউকে কিছু না বলে ঝুড়ি নিয়ে চলে যেত আরও দূরে, তেপান্তর ছাড়িয়ে হাজরা পার্কের আশেপাশের খাটালগুলোতে। হাজরা রোডের বাড়ির পেছনেই ছিল টিনের ছাউনি দেওয়া শুয়োরের আস্তানা। রাত বাড়লেই তাদের মালিকেরা গনগনে লোহার শিক পেছন থেকে মাথা অবধি ঢুকিয়ে দিত। মৃত্যুযাতনার সেই চিৎকার এখনও আমি মাঝে মাঝে শুনতে পাই। ভোরবেলা ঠেলাগাড়ি করে শুয়োরের মাংস চলে যেত বাজারে। কোত্থেকে মাটি ফুঁড়ে উঠে আসত অদ্ভুত কিছু লোক। তাদের হাতে টাকা গুঁজে দিলেই ঠেলাগাড়িগুলো ছাড় পেত। স্বাধীন ভারতবর্ষে হাতে গুঁজে কাজ পাওয়ার সেই শুরু। আশেপাশের আরও কয়েকটা বাড়িতে থাকতেন এ রকমই ছিন্নমূল কিছু পরিবার, যাদের আদ্যোপান্ত জুড়ে থাকত ভয়, আর ভয়ের তলায় চাপা পড়ে যেত সেই বীভৎস চিৎকার। এক দিন ভোরবেলা উঠে দেখি রাজপুত্র এসে দাঁড়িয়েছে, চিৎকার করে বলছে— এই গরম শিকগুলো তোমাদের পেছনে ঢুকিয়ে দেব!

স্কুলের ছুটি পড়লে যখনই চলে আসতাম হাজরা রোডে, আমার জায়গা ছিল দিদিমার পাশে। চৌকিতে দিদিমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে শুনতাম, বিড়বিড় করে দিদিমা বলে চলেছেন, ‘চইল্যা যামু গিয়া।’ আমি বলতাম, কোথায় চলে যাবে? ‘তর মনে নাই সেই বাড়িটা? তর মনে নাই সেই বড় বড় গাছগুলান? পুকুর? সেই মাছরাঙা পাখি? মনে নাই?’

আমার কিছুই মনে পড়ত না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন