একটা ভয় কষ্ট লজ্জা

বইমেলা ধুলো তখন পার্ক স্ট্রিট এলাকাকে মজিয়ে রাখত। বাচ্চা মেয়ে থেকে নারী হয়ে ওঠার পথে তখন। আর এই সময়টায় খামখাই নিজেকে যেন একটু লম্বা মনে হয়। যাহা জানার তাহা আমিই জানি, আমি ছাড়া কেহ জানে না— ভাবখানা ঠিক এমন।

Advertisement

সঞ্চারী মুখোপাধ‌্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
Share:

বইমেলা ধুলো তখন পার্ক স্ট্রিট এলাকাকে মজিয়ে রাখত। বাচ্চা মেয়ে থেকে নারী হয়ে ওঠার পথে তখন। আর এই সময়টায় খামখাই নিজেকে যেন একটু লম্বা মনে হয়। যাহা জানার তাহা আমিই জানি, আমি ছাড়া কেহ জানে না— ভাবখানা ঠিক এমন।

Advertisement

এক বইমেলায়, কেবল একখানি বই কিনে মেলার মাঠেই আড্ডায় বসেছি। এক ভদ্রলোক ছিলেন স্বল্পপরিচিত। আগে এক দিন সামান্য হাসি-বিনিময়, আর সেই দিনই প্রথম কথাবার্তা হয়েছে। তিনি বেশ কয়েকটি বই কিনেছেন। আমার পাশেই বসেছেন।

কিছু ক্ষণ পর আমার একটু অস্বস্তি শুরু হল। কারণ ওঁর বইগুলোর ঠিক ওপরেই আমার বইটা রাখা। একটু বিরক্ত হলাম। কী ধরনের ভদ্রতা! অন্যের বই নিজের বইয়ের ওপরে রেখেছেন। একটু পরে নিশ্চয়ই বলবেন, ওটা ওঁরই বই। আমার আর আড্ডায় মন বসছে না। কী করে আমার বইটা ওঁর থেকে নেব, ভেবে ভেবে বদহজম হওয়ার জোগাড়। আর কী বলব, মনের কুডাক একদম সত্যি হয়ে গেল। আড্ডা ভাঙব-ভাঙব সময় দেখি, উনি ঠিক আমার বইটা বাগিয়ে উঠে পড়ছেন। আমিও বীরাঙ্গনা, বললাম, ‘আপনার বোধ হয় ভুল হচ্ছে, ওটা আমার বই।’ উনি তো যারপরনাই অবাক ও হতভম্ব। আমতা আমতা করে বললেন, ‘না মানে, ইয়ে, আমি কিনলাম এই বইটা।’ আমিও ছোড়নেওয়ালা পার্টি নই। বললাম, ‘কী হয়েছে তাতে। ভুল হতেই পারে। কিন্তু এই বইটা আমার। আমি কিনে এনে বসার সময় পাশে রেখেছিলাম। আপনি বোধ হয় ভুল করে ওটা নিজের বইয়ের সঙ্গে গুছিয়ে ফেলেছেন।’ আমি যে কত মোলায়েম, তা দেখানোর জন্য গলায় বেশি করে মধু ঢেলে দিয়েছি তখন।

Advertisement

ভদ্রলোক একটু ক্যাবলা হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। কিছু আর বললেন না। তবু বইটা দেওয়ার সময় তাঁর মুখটা কেমন নিবে গেল। বিড়বিড় করে বললেন, ‘আমি যে কিনলাম, কোথায় গেল বইটা।’

আড্ডা ভাঙার পর আমি দিদিকে ওর বন্ধুর স্টলে খুঁজতে গেলাম। বাড়ি ফিরব। স্টলে ঢুকে দেখি দিদির হাতে একটা বই। আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল। জিজ্ঞেস করলাম ‘ওটা কী বই রে? কিনলি?’ দিদি বলল, ‘না, তুই তো কিনলি তখন। আমায় ধরতে বললি।’ ব্যস! ধরণী, মেট্রোরেল, পাতাল, পাশের পুকুর— কোনও একটা আমার জন্য একটু ফাঁক হয়ে যাও প্লিজ। ছিছি, এ আমি কী করলাম! নিজের বুরবক কনফিডেন্সের জোরে অন্যের বই ছিনিয়ে নিলাম। ভদ্রলোক কী ভাবলেন! ভাল পোশাক পরা, মিঠে কথা বলা মেয়ে আসলে একটা বই-চোর!

ছুট লাগালাম আড্ডাস্থলে। ভোঁ-ভাঁ। তবু কয়েকটা স্টলে খুঁজেপেতে দুটো বন্ধুকে জোগাড় করে বললাম, ‘প্লিজ এই বইটা ওই ভদ্রলোককে দিয়ে দিবি?’ বইটা ওদের হাতে কোনও মতে গুঁজে দ্রুত পলায়ন।

কিন্তু এপিসোড এখানেই শেষ নয়। চার-পাঁচ দিন পরে বইমেলা গিয়েছি। ও মা! একটা স্টলে ঢুকতেই দেখি সেই ভদ্রলোক। আলতো করে কাটিয়ে যাব ভাবছি, হঠাৎ আমায় দেখতে পেয়ে, ‘শুনুন শুনুন।’ আর শুনুন, আমি তখন দৌড়ের পথে। তবু উনি আমায় ধরে ফেললেন, বলতেও ছাড়লেন না, ‘কী হয়েছে তাতে। ভুল হতেই পারে। আমি বইগুলো কিনে আপনার পাশে রেখেছিলাম। আপনি ভুল করে আপনার ভেবেছিলেন।’ ‘ভুল’ কথাটায় অহেতুক জোর ছিল, বুঝতে ভুল হয়নি। আমার কান ভোঁ-ভোঁ করছে, কোনও মতে ‘সরি’ সেরে বিদায় নিলাম। কিন্তু বেশ বুঝলাম গোটা বইমেলা আমার নির্বুদ্ধিতায় হাসছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement