অফুরন্ত হিংসের জলজ্যান্ত গল্প

প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৮ সালে। আশ্চর্য সেই কাহিনির পরতে পরতে চমক। আশি বছর পেরিয়ে আজও বেস্টসেলার ‘রেবেকা’।প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৮ সালে। আশ্চর্য সেই কাহিনির পরতে পরতে চমক। আশি বছর পেরিয়ে আজও বেস্টসেলার ‘রেবেকা’।

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৮ ২০:৪৭
Share:

প্রেমের উপন্যাস তো অনেক আছে। কিন্তু হিংসের উপন্যাস? আছে বইকী, ‘রেবেকা’। নিজেকে নিয়ে যারা সদা-সঙ্কুচিত, আয়নার সামনে দাঁড়ালে আত্মগ্লানি ঘুলিয়ে ওঠে মনে, সুখ-সমাদরের কল্পনা করতে হলে যাদের অন্যের জীবন কল্পনা করতে হয়, তাদের জন্য এই বই। মানে মনুষ্যপ্রজাতির নব্বই পার্সেন্টের জন্য। নাকি ভুল হল— নিরানব্বই পার্সেন্ট?

Advertisement

সে যা-ই হোক, আশি বছর বইটা রয়েছে বেস্টসেলার তালিকায়। ১৯৩৮ সালে বেরিয়েই হিট। কুড়ি হাজার কপি প্রিন্ট হয়েছিল, এক মাসের মধ্যে ছাপতে হয়েছিল আরও কুড়ি হাজার। এখনও প্রতি মাসে হাজার চারেক কপি বিক্রি। এই সে দিন ব্রিটেনে সমীক্ষা হল, সওয়া দুশো বছরের জনপ্রিয় উপন্যাস কী কী, তাই নিয়ে। উঠে এল জেন অস্টেনের ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস,’ শার্লট ব্রন্টের ‘জেন আয়ার,’ জর্জ অরওয়েলের ‘নাইনটিন এইট্টিফোর,’ লি হার্পারের ‘টু কিল আ মকিংবার্ড।’ আর একটি নভেল। রেবেকা।

কে রেবেকা? সে বেঁচে নেই। পাঠক তাকে চেনে শুধু রোগা, বেঁটে, খেটে-খাওয়া এক মেয়ের বয়ানের মধ্যে দিয়ে। রেবেকার মৃত্যুর বছর না ঘুরতে যে বিয়ে করে রেবেকার বরকে। টুকরো টুকরো কথা জুড়ে তার সামনে ক্রমশ স্পষ্ট হয় রেবেকা — অভিজাত, ফ্যাশনদুরস্ত, গৃহসজ্জানিপুণা, উৎসব-সমারোহে প্রাণস্বরূপা, পাড়া-পড়শির নয়নের মণি। হিংসের তীব্রতায় রেবেকাকে নিঃশেষে মুছে দিতে চায় রোগা মেয়েটি। আবার প্রতি মুহূর্তে স্পর্শ করতে চায়। রেবেকার হস্তাক্ষর, জামাকাপড়, অজস্র চিহ্ন দেখে আর মেয়েটি ভাবে, তবে এই রকম ছিল সে। এই ভাবে কাঁধের উপর ওয়াটারপ্রুফ ঝুলিয়ে নিত, ফোন তুলে হুকুম দিত কাজের লোকেদের।

Advertisement

এই টানাপড়েন পাঠককে নিশ্বাস ফেলতে দেয় না। লেখক ডাফনে দ্যু মরিয়ে ইংরেজি সাহিত্যের খুব উঁচুদরের ইন্টেলেকচুয়াল লেখক, তা বলা চলে না। গভীর দর্শন, প্রগাঢ় প্রজ্ঞার জন্য তাঁর পরিচিতি নয়। কিন্তু আশ্চর্য তাঁর কাহিনির বিন্যাস, গল্পের মোড়ে-মোড়ে চমক তৈরির পারদর্শিতা। অতুলনীয় ক্ষমতা বাড়ি-ঘরকে প্রাণবন্ত করে তোলার। গল্পের এক প্রধান চরিত্র প্রাসাদপ্রতিম ‘ম্যান্ডারলি।’ পেল্লায় উঁচু রডোডেনড্রনের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা গাড়ি-রাস্তার শেষে বাড়ি। পশ্চিমের ঘরগুলো থেকে দেখা যায় সমুদ্র, পূর্বের উইং থেকে অপরূপ বাগান, ‘হ্যাপি ভ্যালি’। কলমের গুণে বৃষ্টি-ধোয়া অ্যাজেলিয়ার গন্ধ আসে পাঠকের নাকে। ম্যান্ডারলির মর্নিং রুম, ডাইনিং রুম, লাইব্রেরিতে ফোল্ডিং টেবিলে শুভ্র টেবিলক্লথ পেতে চা পর্ব, সে হল ইংরেজ আভিজাত্যের গোধূলিবেলা। ম্যান্ডারলি বাড়িটি ডি উইন্টার পরিবারের, কিন্তু সৌন্দর্য, গ্ল্যামারের জন্য গোটা কাউন্টির গৌরব।

সেই ম্যান্ডারলির মালিক, বিয়াল্লিশ বছরের সুপুরুষ, বদমেজাজি ম্যাক্সিমিলিয়ান ডি উইন্টার একুশ বছরের ইস্কুলছাত্রীপানা মেয়েকে বিয়ে করল। এই দ্বিতীয় স্ত্রী কাহিনির বক্তা, কিন্তু তার নামের উল্লেখ নেই কাহিনিতে। হয়তো তার ব্যক্তিত্বের অভাব বোঝাতেই। শস্তার জামা-জুতো, ন্যাতানো চুল, আড়ষ্ট স্বভাব, আদবকায়দা সম্পর্কে অজ্ঞতা নিয়ে বেচারি মরমে মরে আছে। কেবল ভাবে, সবাই পিছনে মুখ টিপে হাসছে। বলছে, ‘‘শেষে একে বিয়ে করল ডি উইন্টার? রেবেকার পরে?’’

‘রেবেকা’ উপন্যাসের আশি বছর পূর্তিতে প্রকাশিত বিশেষ সংস্করণ

রেবেকা। রেবেকা। যার কোনও ছবি নেই ম্যান্ডারলিতে, কিন্তু প্রতি মুহূর্তে সে আছে। তার রাতপোশাক ঝুলছে আলমারিতে, রুমালে তার সুরভি। বাড়ি-ঘরের সজ্জা, ডিনারের মেনু, সব রেবেকার নির্দেশ-মাফিক চলছে। বাড়ির প্রধান পরিচারিকা মিসেস ড্যানভার্স মালকিনের স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছে। নবাগতার প্রতি তার তীব্র বিদ্বেষ। ‘‘আমি কী দোষ করেছি?’’ প্রশ্ন করে নাজেহাল তরুণী। উত্তর আসে, ‘‘তুমি রেবেকার জায়গা নিতে চাও।’’ হিংসে। রেবেকা অনন্য, কিন্তু অতীত। দ্বিতীয় স্ত্রী যতই অলবড্ডে হোক, জীবনের নিয়মে সে জায়গা করে নেবে। রেবেকার রূপ-গুণে চিরমুগ্ধ ‘ড্যানি’-র কাছে কী অসহ্য সে চিন্তা! তরুণী স্ত্রীকে খোলা জানলার কাছে নিয়ে গিয়ে সে বলে, ‘‘তুমি কখনও ম্যান্ডারলির মালকিন হতে পারবে না। যা শেষ হবেই, তাকে শেষ করো। ঝাঁপ দাও নীচে।’’ মিসেস ড্যানভার্স ইংরেজি সাহিত্যে দাগ কেটে গিয়েছে।

দ্যু মরিয়ে গল্পটি লেখা শুরু করার সময়ে কিছু চরিত্র ভেবেছিলেন, আর ঠিক করেছিলেন যে ক্রমাগত ঘটবে ‘ক্র্যাশ ব্যাং’। সত্যিই একের পর এক ধাক্কায় প্রেমের উপন্যাস হয়ে ওঠে ক্রাইম থ্রিলার। ক্রমে স্পষ্ট হয়, রেবেকার সৌন্দর্য, সুরুচির পিছনে ছিল বাঁধনছেঁড়া লাম্পট্য। অভিজাত বিয়ে ছিল তার স্বেচ্ছাচারিতার পাসপোর্ট। ভিক্টোরীয় ধাঁচের স্বামীও তার ব্যক্তিত্ব আর বুদ্ধির কাছে হার মানতে বাধ্য হয়। মৃত্যুর পরেও স্বামীকে নিয়ন্ত্রণ করে চলে রেবেকা।

রেবেকার মৃত্যুরহস্য যে দিন জানা যায়, সেই রাতে আগুনে শেষ হয়ে যায় ম্যান্ডারলি। উপন্যাসের যা প্রথম বাক্য, ‘কাল রাতে স্বপ্ন দেখলাম, আমি ম্যান্ডারলিতে ফিরে গিয়েছি,’ তা আসলে সমাপ্তি। ম্যান্ডারলি, মিসেস ড্যানভার্স, আর এই প্রথম বাক্যটি, ‘রেবেকা’ পড়লে এই তিনটি কেউ ভুলতে পারে না। ‘রেবেকা’ থেকে ফিল্ম করেন আলফ্রেড হিচকক। সত্যি বলতে কী, দ্যু মরিয়ে-র ছোট গল্প ‘বার্ডস’ থেকে হিচকক যত ভাল ছবি করেছিলেন, ‘রেবেকা’ অত উৎকৃষ্ট হয়নি। ‘রেবেকা’র আনন্দ পেতে হলে বইটাতে না ফিরে উপায় নেই।

দ্যু মরিয়ের জীবনের সঙ্গে তাঁর নভেলের অনেক মিল। তাঁর প্রবল আকর্ষণ ছিল কর্নওয়ালের ‘মেনাবিলি’ নামে প্রাচীন একটি বাড়ির প্রতি। দীর্ঘ দিন ভাড়া নিয়ে ছিলেন, শেষে মামলায় হেরে ছেড়ে দিতে হয়। আর রেবেকা? রেবেকার মধ্যেও দ্যু মরিয়ের ছায়া রয়েছে। তাঁর টমবয় স্বভাব, বোট চালানোর নেশা, ছোট চুল, রেবেকার মতোই। ছায়া দাম্পত্য হিংসেরও। তাঁর স্বামীর প্রাক্তন প্রেমিকা ছিলেন জ্যান রিকার্ডো। পদবীর আদ্যাক্ষর R লিখতেন বড় করে, লেজটা লম্বা আর বাঁকানো। জ্যান আত্মহত্যা করেন, কিন্তু দ্যু মরিয়ে সন্দেহ করতেন যে স্বামী তাঁর প্রতি আকৃষ্ট। ওই বাঁকানো R হয়ে উঠেছে রেবেকার স্বাক্ষর। সেই স্বাক্ষর-লেখা একটি বইয়ের পাতা কুটিকুটি করে ফেলে দ্বিতীয় স্ত্রী। আগুন লাগায় টুকরোগুলোতে। R অক্ষরটা আগুনের শিখায় যেন আরও বড়, আরও কালো হয়ে ওঠে।

আশি বছর পূর্তিতে প্রকাশ পেয়েছে বইয়ের বিশেষ সংস্করণ। তার মলাটে সাদা কাপড়ের উপর সাদা সুতোয় এমব্রয়ডারি করা একটি অক্ষর, R। নির্লজ্জ, নিঃশঙ্ক রেবেকা বেঁচে আছে আজও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন