ছবি: মণীশ মৈত্র
বাবা-মায়ের সঙ্গে লং ড্রাইভে চন্দননগরে মামাবাড়ি গেল ঈশান। তিন দিনের প্রোগ্রাম। মামাবাড়ি পৌঁছে ঈশান দেখল, ছোটমামার স্প্যানিয়েল কুকুরের চার-চারটে ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চা হয়েছে। ওদের বয়স মাত্র দশ দিন। গা লোমে ভরা। ধবধবে সাদার ওপর হলুদ-কালো ছোপ ছোপ। ছোট ছোট নিষ্পাপ চোখ। ঘরময় তারা খেলে বেড়াচ্ছে। একে অন্যের সঙ্গে খুনসুটিও করছে। ঈশানও ওদের সঙ্গে খেলায় মত্ত হয়ে পড়ল। নতুন বন্ধু পেয়ে তারাও বেশ খুশি। ঈশানের কোলেও উঠে পড়ল নির্দ্বিধায়। ওদের ভারী পছন্দ হল ঈশানের।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঈশানের সঙ্গে ওদের এমন বন্ধুত্ব হয়ে গেল যে, রাতে মাকে ছেড়ে ওরা ঈশানের সঙ্গেই বিছানায় ঘুমোতে শুরু করল। মা ওদের দূর থেকে লক্ষ রাখত এবং পাহারা দিত। ক’দিনের মধ্যেই কুকুরগুলো ভীষণ প্রিয় হয়ে উঠল ঈশানের। তিন দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর এ বার কলকাতায় ফেরার পালা ঈশানদের। কিন্তু ওদের ছেড়ে আসতে মন চায় না ওর। ঈশান বাবার কাছে বায়না ধরল, কুকুরগুলোকে ওদের কলকাতার বাড়িতে নিয়ে যাবে। ছেলের প্রস্তাব শুনে বাবা তো রেগে আগুন। তিনি কোনও দিনই ছেলের কোনও অন্যায় আবদার মেনে নেন না। রাগ সংবরণ করে বললেন, একদমই নয়। এক বার বাড়িতে নিয়ে গেলে ওদের ওপর মায়া পড়ে যাবে। তখন ওদের ফেলে কোথাও বেড়াতে যেতে পারবে না। তার ওপর ওদের যত্নে রাখতে হয়। পরিচর্যা করতে হয়। ভীষণ আদরের হয় ওরা। আমাদের সেই সময় কোথায়? তা ছাড়া ছোট্ট ফ্ল্যাট আমাদের। কোথায় থাকবে ওরা? বিকেলবেলা কে-ই বা ওদের বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাবে? সুতরাং, তোমার এই আবদার মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। বড় হচ্ছ। একটু বোঝার চেষ্টা করো।
বাবার অসম্মতিতে ছেলের মুখ ভার। কিন্তু ঈশানের মায়ের কুকুরগুলোকে ভীষণ পছন্দ। তিনি মনে মনে ভেবেই রেখেছেন, দু’একটাকে বাড়ি নিয়ে গেলে মন্দ হয় না। এ বিষয়ে তিনি ঈশানের ছোটমামার সম্মতিও নিয়ে রেখেছেন। এখন ঈশানের বাবার সম্মতির অপেক্ষা। তাই সুযোগ বুঝে তিনি ঈশানকে সমর্থন করে বললেন, সারা দিন তো বাড়িতেই থাকি। কোথায় বা যাই? ছেলেটা যখন নিতে চাইছে, নিলেই হয়। আমিই না হয় ওদের সামলাব। আমার একাকিত্বও কাটবে। ঈশানের মায়ের কথায় খানিকটা বেকায়দায় পড়ে গিয়ে ঈশানের বাবা বললেন, তোমার একাকিত্ব কাটাবার জন্য নিশ্চয়ই চার-চারটে কুকুরের দরকার নেই। একটাই যথেষ্ট।
তাতেই রাজি ঈশান। সবচেয়ে মিষ্টি কুকুরটা বগলদাবা করে গাড়ি করে বাড়ি ফিরল ও। বাড়ি ফেরার পর থেকে টমিকে কাছছাড়া করতেই চায় না ঈশান। আদরে আদরে মাকে ছেড়ে আসার কষ্ট অনেকটাই ভুলিয়ে দিল ঈশান। টমিও সব সময় ঈশানের সঙ্গে থাকতেই ভালবাসে। পড়ার সময় ঈশানের পাশে চুপটি করে বসে থাকে। ঈশান স্কুলে গেলে ঈশানের মায়ের কাছে থাকে টমি। দিনে দিনে ঈশানের মা টমিকে ভীষণ ভালবেসে ফেলেন। টমিও সারা দিন ঈশানের মায়ের পায়ে পায়ে ঘোরে। কোলে ওঠার জন্য চিৎকার করে। ঈশানের মা খাইয়ে না দিলে খাবেই না। বড্ড আদুরে হয়েছে টমি। টমির এই আদুরেপনা মোটেই পছন্দ নয় ঈশানের বাবার। মাঝে মাঝে ঈশানের বাবার কাছে একটু-আধটু ধমক-টমক খেলে মা ছেলে মিলে আদর করে মানভঞ্জন করে টমির।
ইদানীং টমি ঈশানের থেকেও ঈশানের মায়ের কাছে থাকতেই বেশি ভালবাসে। দিনের বেশির ভাগ সময়টা টমির ঈশানের মায়ের সঙ্গে কাটে। তাই একটা আকর্ষণ গড়ে ওঠা মোটেই আশ্চর্যের নয়। টমিকে সময় দিতে গিয়ে দিন দিন স্কুলের টিফিনের মান কমতে শুরু করেছে ঈশানের। পরোটা, চাউমিন তো দূরের কথা, ব্রেড-বাটারও এখন মিলছে না। বেশির ভাগ দিনই কেনা খাবার। হয় কেক নাহয় পেস্ট্রি। একঘেয়ে টিফিন খেতে আর ভাল লাগে না ঈশানের। এখন স্কুল ড্রেস নিজেই পরে নেয় ঈশান। স্কুল থেকে ফিরে নিজেই স্নান সেরে, চুল আঁচড়ে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে যায় সুবোধ বালকের মতো। সন্ধেবেলায় ঈশানের হোমওয়ার্ক মা করিয়ে দিতেন। সেটাও প্রায় বন্ধ হতে চলেছে। সব সময় টমি মায়ের কাছে থাকে। সেই জন্য মনে মনে খানিকটা ক্ষুব্ধ ঈশান।
এক দিন সন্ধেবেলা মায়ের কাছে পড়তে বসার সুযোগ পেল ঈশান। কারণ, পর দিন স্কুলে ইতিহাসের পড়া ধরবেন আন্টি। মা জানেন, ইতিহাসের নামে ছেলের জ্বর আসে। কিন্তু টমি ঈশানের মায়ের সঙ্গে এমন আদিখ্যেতা আরম্ভ করল যে, মা বহু চেষ্টা করেও ঈশানকে সে ভাবে পড়াতেই পারলেন না। যথারীতি স্কুলে পড়া না পারার জন্য প্রচণ্ড ধমক খেতে হল ঈশানকে।
প্রতি দিন দুপুরে ঈশানের ভাত মেখে দেন মা। হঠাৎ এক দিন মা বললেন, এখন যথেষ্ট বড় হয়েছ, ভাত নিজে মেখে নাও। আমার সময় নেই। টমিকে স্নান করাতে হবে। খাওয়াতে হবে। মনে খুব কষ্ট পেল ঈশান। যখন দেখল, মা টমিকে নিজের হাতে দুধভাত খাইয়ে দিচ্ছেন, তখন ঈশান আর নিজেকে সামলাতে পারল না। তার মায়ের সমস্ত ভালবাসাই টমি কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু টমিকে তো মামাবাড়ি থেকে সে নিজেই বাবার কাছে বায়না করে নিয়ে এসেছিল। টমিকে
সে সত্যিই ভালবাসে। টমি কিন্তু ইদানীং ঈশানের কাছে বেশি ক্ষণ থাকতে চায় না। ঈশানের সঙ্গে টমির দূরত্ব বেড়েছে। মায়েরও।
রাত্রিবেলা মায়ের কাছেই ঘুমোয় ঈশান। আদর করে মা মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেন ঈশানকে। টমি সোফায় শোয়। কয়েক দিন হল টমিকে ঘুম পাড়িয়ে মায়ের আসতে এত দেরি হচ্ছে যে, ঈশান ঘুমিয়ে পড়ছে। কষ্ট করে জেগে থাকলেও আগের মতো আর মা ঈশানের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন না। টমির দেখভাল আর আবদার সামলাতেই ঈশানের মায়ের সমস্ত এনার্জি শেষ হয়ে যায়। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েন।
এই ভাবে চলছিল দিন। হঠাৎ এক দিন টমি অসুস্থ হয়ে পড়ল। কিছুতেই সুস্থ হচ্ছে না দেখে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল টমিকে। দেখেশুনে ডাক্তার ওষুধ দিলেন। ওষুধ খেয়ে খানিকটা সুস্থ হলেও টমির শরীরটা বেশ দুর্বল হয়ে পড়ল। ফলে, সে আরও ন্যাওটা হয়ে পড়ল ঈশানের মায়ের। শেষ পর্যন্ত রাতে ঈশানের শোবার জায়গাটাও কেড়ে নিল টমি। ঈশানের বদলে মায়ের কাছে টমি রাতে শুতে শুরু করল। মনে মনে কষ্ট পেলেও টমির অসুস্থতার কথা ভেবে মুখে কিছু বলল না ঈশান। অগত্যা অন্য ঘরে বাবার সঙ্গে রাতে শোওয়ার ব্যবস্থা হল ঈশানের। রাতে শুয়ে ঘুম আসে না ঈশানের। মায়ের কথা মনে পড়ে। মায়ের আদর, স্নেহ, শাসন, অনুশাসনের বিভিন্ন ঘটনা মনে করে তার বুক আনন্দে ভরে ওঠার পাশাপাশি, ঘুমের সময় মাকে পাশে না পাওয়ার দুঃখেও তার চোখ দুটো জলে ভরে উঠল।
দিনে দিনে অবস্থার অবনতি হওয়ায় আবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল টমিকে। ওষুধের পাশাপাশি ডাক্তার বললেন, টমিকে অন্তত কিছু দিনের জন্য ওর মায়ের কাছে রাখতে হবে। মায়ের আদরেই ও সুস্থ হয়ে উঠবে। তাই শুনে ভীষণ মনখারাপ হয়ে গেল ঈশানের মায়ের। তিনি কিছুতেই টমিকে কাছছাড়া করতে চান না। তিনি টমিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই ফেললেন। ঈশানেরও কষ্ট হল। সে ভাবল, এই ভাবে মা জড়িয়ে ধরে কত দিন তাকে আদর করেনি!
টমির শারীরিক সুস্থতার জন্য ডাক্তারের সিদ্ধান্ত মেনে নিতেই হল। মামাবাড়িতে ফোন করে বিষয়টা জানানো হল। স্থির হল, পর দিন ভোরবেলায় ঈশানের বাবা যাবেন টমিকে ওর মায়ের কাছে পৌঁছে দিতে। সেই মতো ড্রাইভারও ঠিক করা হল। গাড়ির পিছনের সিটে ঈশানের বাবা টমিকে কোলে নিয়ে বসলেন। টমির মুখ জুড়ে বিষাদের ছায়া। ঈশানের মা আঁচলে মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে আর সামলাতে না পেরে তিনি ঈশানকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদে ফেললেন। সে কান্না আর থামেই না। ঈশানের চোখ থেকেও কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। অনেক দিন বাদে মাকে কাছে পেয়ে ঈশান মাকে আর ছাড়তেই চায় না। মায়ের উত্তাপে ও স্পর্শে সাড়া শরীর জুড়ে ভালবাসার শিহরন জেগে উঠল ঈশানের। মা বুকভরে আদর করলেন ছেলেকে। ঈশান ফিরে পেল পুরনো মায়ের হারানো স্নেহ। মনমরা ছেলের মুখে হাসি ফুটিয়ে মায়ের মনেও প্রশান্তির অনুভূতি। ঈশান মনে মনে ভাবল, আমার মা, শুধু আমার। অন্য কারও নয়। মায়ের ওপর সম্পূর্ণ অধিকার শুধু আমারই। টমি চলে গিয়েছে। ভালই হয়েছে। টমি তো নিজের মায়ের কাছেই ফিরে গিয়েছে। মাকে
কাছে পেয়ে টমিও নিশ্চয়ই আমার মতো খুশি হবে। মামাবাড়িতে টমি ভালই থাকবে। ঈশানের চোখ বেয়ে আবার গড়িয়ে পড়ল জল। টমিকে হারানোর নয়। মাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দাশ্রু।