ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
অস্বাভাবিক মোটা মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে নেহাত কম নয়। বিপুল এক শরীর নিয়ে এঁরা প্রতি দিন, প্রতি মুহূর্তে লড়াই চালান স্বাভাবিক পৃথিবীর সঙ্গে। কেউ নিজে হাতে পোশাকটুকুও পালটাতে পারেন না, কেউ সারা দিন একটা সোফা জুড়েই বসে থাকেন, দু’পা হেঁটে এক গ্লাস জলও আনতে পারেন না, আবার কেউ বিশেষ ভাবে তৈরি স্কুটার চালিয়ে প্রয়োজনীয় কেনাকাটাটুকু সারতে পারেন মাত্র, কারও আবার স্কার্টটাই তৈরি হয় বারো ফুট লম্বা কাপড় দিয়ে। প্লেনে উঠলে তাঁদের শুনতে হয় এই বিশাল বপুখানার জন্য পাশের যাত্রীর কী ভীষণ অসুবিধে হচ্ছে! কিছু দিন আগেই নিউ জার্সির এক বইয়ের দোকানের ম্যানেজার, ৩৮৫ পাউন্ডের ভদ্রলোককে, প্লেন থেকেই নামিয়ে দেওয়া হয়। কারণ, তিনি মাত্র একটা সিটের পক্ষে বড্ডই বেশি মোটা। তিনি যখন পিছনের একটা সিট থেকে প্রায় গোটা প্লেনটা হেঁটে হেঁটে নেমে যাচ্ছেন, তখন নাকি বুঝতে পারছিলেন, সহযাত্রীদের কী অসম্ভব অপমানজনক দৃষ্টি তাঁর সর্বাঙ্গে এসে বিঁধছে! তিনি বলছেন, এটা ছিল একটা ‘শেম ওয়াক’!
আসলে, এ এক অন্য দুনিয়া। ৩০০-৪০০-৫০০-৬০০ পাউন্ডের দুনিয়া। সেখানে ফ্যাশন নেই, উইকএন্ডে হুল্লোড় নেই, অ্যাডভেঞ্চার নেই, ট্রেকিং নেই। আছে শুধু তাল তাল চর্বির সঙ্গে নিত্য ওঠাবসা, আর অন্য ‘স্বাভাবিক’দের এক রাশ জঘন্য কৌতূহল, আর অপমানের শিকার হওয়া। অনেককে চিকিৎসার জন্যে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সিঁড়ি দিয়ে নামানো সম্ভব হয় না। তখন জানলা ভেঙে, ‘এয়ারলিফ্ট’ করে, তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়।
মুর্শিদাবাদের লোকমান হাকিম যেমন। গরিব খেতমজুরের এগারো মাসের ছেলের ওজন বেড়ে দাঁড়িয়েছিল একুশ কেজি। তার প্রতি দিনের খাবার ছিল পাঁচ লিটার দুধের সঙ্গে দেড় কেজি চালের ভাত মেশানো মণ্ড। এ হেন বিস্ময়-শিশুকে নিয়ে তখন তোলপাড় রাজ্য। শারীরিক পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য লোকমান এল কলকাতায়। সেখানেই আচমকা এক দিন সমস্ত কৌতূহলের মুখে দড়াম করে দাঁড়ি টেনে মারাও গেল সে। তার যে বিশাল খাবারের পরিমাণ তখন লোকের মুখে মুখে ফিরত, সেই খাবারই গলায় আটকে।
অবশ্য অতিক্রম করার গল্পও আছে। লিন্ডা পিয়ারসনের ওজন ছিল ছোটখাটো একটা গ্লাইডার এয়ারক্রাফ্ট-এর সমান। কুড়ি বছর স্নান করেননি। ভয় ছিল, তাঁর বিপুল দেহ বাথটবেই না আটকে যায়। তখন লিন্ডা-র ট্রাউজার্সের শুধু একখানা পা দিয়েই গলে যেতে পারতেন তাঁর ছিপছিপে স্বামী জেরি। তবে, গল্পটা বদলে গেল ২০১০ সালে সাইপ্রাস ঘুরতে যাওয়ার পরই। একে তো প্লেনে তাঁর উপযুক্ত জায়গার অভাবে পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা, তার ওপর সাইপ্রাসের গরমে মোটাসোটা শরীরের হা-ক্লান্ত দশা। দু’সপ্তাহ ধরে হোটেলবন্দি লিন্ডা দেখতেন, স্বামী তাঁকে ছেড়েই দিব্যি সাইটসিয়িং-এ বেরিয়ে পড়ছেন। আর তাঁর জন্য বরাদ্দ শুধুই রাতের অন্ধকার, চেহারা ঢেকে, মুখ লুকিয়ে ইতিউতি খাবারের সন্ধান। প্রতিজ্ঞা করলেন লিন্ডা, এই বিচ্ছিরি ওজনদার শরীর নিয়ে আর বেড়াতে যাওয়া নয়। ওজন কমাতেই হবে। সুতরাং, সার্জারি। অর্ধেকের বেশি ওজন ছেঁটে লিন্ডা এখন সপ্তাহান্তে নিয়ম করে নয়-দশ মাইল হাঁটেন, ট্রেকিংয়ে বেরোন, স্টাইলিশ পোশাকও পরেন।
২০০৮ সালে টেক্সাসের মাইরা রোজালেস পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিলেন, তিনি তাঁর বোনের ছেলেকে মেরে ফেলেছেন। বাচ্চাটাকে তুলতে গিয়ে হাত পিছলে তিনি তাঁর হাজার পাউন্ডের বেশি ওজন নিয়ে তার ওপর পড়ে যান। তাতেই সে থেঁতলে যায়। বিবৃতিতে কোনও খুঁত নেই। মাইরা সত্যিই তখন পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী মানুষ। কিন্তু অটপ্সি থেকে জানা গেল, মৃত্যুর কারণ মাথায় এক প্রচণ্ড আঘাত, প্রায় বিছানাবন্দি মাইরার পক্ষে যেটা করা অসম্ভব। ওই বিশাল হাত তিনি ভাল করে তুলতেই পারেন না। লোককে মারবেন কী করে? মাইরা নিজেও পরে স্বীকার করেন, বোনকে বাঁচাতেই এ গল্প ফেঁদেছিলেন। মাইরাও এখন অনেকটা ওজন কমিয়ে, অনেকেরই অনুপ্রেরণা!
তবে, উলটো ছবিও আছে। সেখানে পছন্দের মানুষ তার বাড়তি ওজন ছেঁটে ফেলায় হুতাশ ঝরেছে অন্যদের মধ্যে। গায়ক আদনান সামির সেই ‘লিফ্ট করা দে’-র মিষ্টি, গুল্লু চেহারাটাই যেন বেশি ভাল ছিল না? আবার ওজন ঝরিয়েই ডিভোর্সের চিঠি হাতে পেয়েছেন, এমন মানুষও আছেন। মেলিসা মরিস রাতারাতি ৫০০ পাউন্ড ঝরিয়ে ফেলার পরই দেখলেন, স্বামী ক্রিসের সঙ্গে সম্পর্কটা কেমন খারাপ হয়ে গিয়েছে। অ্যাদ্দিন মেলিসার ৬৭৩ পাউন্ডের শরীরটির দেখভাল, তাঁর বিপুল পরিমাণ খাবারের জোগান দেওয়া— একা হাতেই সামলাতেন ক্রিস। ক্রিস ক্রমশ হয়ে উঠছিলেন তাঁর ‘কেয়ারটেকার’, তাঁর প্রত্যেক মুহূর্ত যাপনের একমাত্র সঙ্গী। বউয়ের এই অসহায় সমর্পণ বেজায় উপভোগ করছিলেন ক্রিস। কিন্তু সুখটুকু গায়েব করে দিল গ্যাসট্রিক বাইপাস সার্জারি। মেলিসা ওজন কমে ১৭০ পাউন্ড। ঝরঝরে চেহারার বউকে নিয়ে ক্রিস পড়লেন বেজায় টেনশনে। সুন্দর, স্বাস্থ্যসতেজ শরীর ফিরে পাওয়ার পাশাপাশি আত্মবিশ্বাসও অনেকখানি বেড়েছে বউয়ের। স্বাধীন হতে শিখেছেন তিনি। সাহায্যের জন্য অহরহ ক্রিসের ডাক পড়ে না। সেই থেকেই সম্পর্কে টেনশন।
শুধু মেলিসাই নন, ওজন কমিয়ে পারিবারিক অশান্তির মুখে পড়ার তালিকায় থাকবে ক্রিস্টিন, জালিন-এর মতো অনেক মেয়ের নাম। এক সময় ছ’শো পাউন্ড পেরিয়ে যাওয়া এই মেয়েরা প্রচণ্ড ইচ্ছেশক্তি আর সাহসকে পুঁজি করে নিজের বিপুল শরীরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছেন। কিন্তু জিতে ওঠার পর আশ্চর্য হয়ে দেখেছেন, তাঁদের এত দিনের সঙ্গীরা কী অনায়াসে তাঁদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন! জালিন-এর স্বামী জারেথ কখনও এক প্লেট সালাদও বউয়ের জন্য কিনে আনেননি। বরং বলেছেন, ঘাসপাতা খাওয়ার ইচ্ছে থাকলে জালিন যেন নিজে বাগানে গিয়ে চরে খায়। জালিনের ওজন কমানোয় তাঁর ভয়ানক আপত্তি ছিল। জালিন সে কথা শোনেননি। সুতরাং, জারেথ চলে গিয়েছেন। কারণ, ৩১৬ পাউন্ড ওজন কমিয়ে ফেলা এই ‘রোগা বউ’য়ের মধ্যে কোনও আকর্ষণ তিনি খুঁজে পান না!
তবে, দাম্পত্যে যতই টুইস্ট আসুক না কেন, বিখ্যাত গায়ক থেকে বিলিওনেয়ারের ছেলে— সবাই এখন মোটা থেকে রোগা হওয়ারই আনন্দ খুঁজতে চান। কারণ, তাঁরা হয়তো মনে মনে জানেন এক নির্মম সত্যি— মোটা মানুষরা সুখে থাকে না। তাদের কিছুতেই থাকতে দেওয়া হয় না। সেখানে সবাই যে দুশো-তিনশো পাউন্ড ক্লাবের সদস্য, তা তো নয়। কিন্তু মেজ-সেজো-ন’মোটাদের জীবনেও স্বস্তি বড়ই কম। তারা যদি ভাবে, এই তো আমি মোটা হয়ে দিব্য আছি। আমার দেদার চকলেট, আইসক্রিম খাওয়ায় তো কোনও লুকনো টেনশন নেই, নিজেকে ফ্যাশনদুরস্ত দেখানোর কোনও পাহাড়প্রমাণ চাপ নেই। আমি হ্যাপিলি ‘ওবিস’। কিন্তু উঁহু। বাকিরা এমন ফুরফুরে মেজাজ বরদাস্ত করবে কেন? স্কুলে তার পাশে কেউ বসবে না, কেউ কক্ষনও তাকে খেলতে নেবে না, সে একখানা আইসক্রিমের দিকে হাত বাড়ালেই আগন্ডা তাচ্ছিল্যের হাসি ছুটে আসবে। কলেজে তার নিকনেম হবে, সে প্রোপোজ করলে হাসির হররা উঠবে। পৃথিবী এখন বাতলে নিয়েছে, স্লিম হওয়াই মানুষের মোক্ষ, আর মোটা হওয়া তার অক্ষমতা। যে যার মতো নিজের চেহারা নিয়ে থাক না— এই সভ্য অ্যাটিটুড একদম অদৃশ্য হয়ে গেছে! তাই মোটা-বিরোধী সাম্প্রদায়িকতা দিব্যি চলেছে। সব মোটাই রাস্তায় হাঁটার সময় অনুভব করেন, অনেক দৃষ্টি থেকে ব্যঙ্গ আর তাচ্ছিল্য তাঁর গায়ে ছুঁচের মতো ফুটছে! এটা ‘শেম ওয়াক’!
futi.chatterjee@gmail.com