ছবি: মণীশ মৈত্র
• ২০ অগস্ট, ২০১৪
দিল্লিটা কেমন কাঠ কাঠ, না? মুম্বই-কলকাতার মতো নয়। কাজের জন্য যেটুকু থাকতে হয় থাকি, শেষ হলেই পালাই-পালাই করি। সে যত রাতের ফ্লাইট হোক!
ছত্তরপুরের ফার্ম হাউসে শুটিং ছিল। ফিরে দেখি, মনোজের টেক্সট! লিখেছে, ‘প্লিজ স্টে ব্যাক। নিতিন গডকড়ী ওয়ান্টস টু মিট ইউ। টুনাইট নাইনিশ?’ মনে মনে ভাবলাম, ‘মিট’ আবার কী? কী বলবেন তো জানি। যেন ওঁরা পণ করেছেন, রাজনীতিতে নামিয়েই ছাড়বেন! মনোজের আবদারও ফেলা যায় না। এত দিনের বন্ধু। তা ছাড়া এত বড় মন্ত্রী, বিজেপি-র এত উচুঁ সারির নেতা দেখা করতে চাইছেন, বার বার এড়িয়ে যাওয়াটাও ভদ্রতা নয়! দোনামনা করে হ্যাঁ করে দিলাম।
মনোজই নিয়ে গেল হোটেল থেকে। লাল ইটের তৈরি একটা বাংলোর গেটের সামনে পৌঁছে বলল, ‘রূপাজি, এই হল ২ নম্বর মতিলাল নেহরু মার্গ। গডকড়ীজির বাড়ি।’ উলটো দিকের বাড়িটা নাকি মনমোহন সিংহের। ওটা তিন নম্বর। ডান পাশের রাস্তা পেরিয়ে দশ নম্বর জনপথ। সাধে বলে পাওয়ার করিডর! কেমন যেন একটা ক্ষমতা-ক্ষমতা ব্যাপার ও-পাড়ায়! সকাল থেকে ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছিল। তখনও থামেনি। সাড়ে আটটাতেই আশপাশ থমথমে। পরিচালকদের বাড়িতে রাতবিরেতে কত্ত বার স্ক্রিপ্ট শুনতে গেছি! মন্ত্রীর বাড়িতে এই প্রথম। স্ক্রিপ্টও জানি না, শট দেব কী ভাবে! একটু অস্বস্তি লাগছিল।
বৈঠকখানায় ঢুকে দেখি, তখনও সাত আট জন বসে আছেন। সকলেই মন্ত্রীর সাক্ষাৎপ্রার্থী। আধ ঘণ্টা মতো বসতে হল। তার পর নিজেই বেরিয়ে এসে ডেকে নিলেন ভদ্রলোক। মাঝারি গড়নের মানুষটা। হাফস্লিভের ওপর একটা ওয়েস্ট-কোট পরা। বললেন, ‘সরি, একটু বসতে হল আপনাকে।’ বললাম, না না, আপনি ব্যস্ত মানুষ। ‘তা রূপাজি, বাংলা কেমন আছে?’ বললাম, সব খবরই তো আপনারা রাখেন, টোটাল মেস! আইনের শাসন বলে কিচ্ছু নেই! ‘তা হলে দেরি করছেন কেন?’ হেসে ফেললাম। কী ব্যাপারে? বললেন, ‘আচ্ছা, ও কথা আজ থাক। কাল সকালে প্লিজ আর এক বার আসুন। ও সব তখন হবে। আজ চলুন একসঙ্গে ডিনার করি।’ এমন করে বললেন, ‘না’ বলা যায় না। খাওয়ার টেবিলে ওঁর স্ত্রী আর মেয়েও দিব্যি গল্প জুড়ে দিয়েছিল। যেন কত দিনের চেনা! ভদ্রলোকও বেশ মজা করতে পারেন। বললেন, ‘ভেবে দেখুন, বাংলার দুঃশাসনগুলোকে শায়েস্তা করতে হবে কিন্তু!’ কথা ছিল, দশ মিনিটের জন্য যাব। বেরোলাম রাত ১১টা নাগাদ!
• ২১ অগস্ট
আজ আর কোনও রাখঢাক রাখলেন না, বললেন, ‘কিছু ভাবলেন?’ কী ভাবব? ‘মানে, আপনার মতো ভাল মানুষরা যদি রাজনীতিতে না আসেন, তা হলে চলবে? কী! চলবে, বলুন?’ বললাম, তা ঠিক! রাজনীতিতে ইদানীং ভাল লোকের বড্ড অভাব। ‘তা হলে?’ বললাম, আসলে ব্যাপারটা এমন নয় যে আমি জন্ম থেকেই বিজেপি। আবার, এমনও নয় যে ছোটবেলা থেকে পলিটিক্সের পোকা রয়েছে আমার মধ্যে! তবে হ্যাঁ, চার পাশে যা হতে দেখছি, রাগ তো হচ্ছেই। ভীষণ রাগ হচ্ছে!
উনি মুচকি হাসলেন। বললেন, ‘শুধু চার দেওয়ালের মাঝে রাগারাগি করে কী লাভ বলুন?’ বললাম, ঠিকই। সে জন্যই হয়তো মাঝে মাঝে ইচ্ছেটা উঁকি দেয়! তবে ও পর্যন্তই। নইলে যেটুকু সোশ্যাল ওয়ার্ক করি তা নিয়েই তো খুশি। তা ছাড়া ফিল্মের কমিটমেন্টও তো আছে অনেক। উনি বললেন, ‘দেখুন, ফিল্মের কমিটমেন্ট শত্রুজিরও ছিল, স্মৃতিরও ছিল। এখন দেখুন ওঁরা কেমন মন দিয়ে রাজনীতির কাজ করছেন। আপনার মধ্যে যে জেদটা দেখতে পাচ্ছি, এটাই বড় ব্যাপার। সো প্লিজ গিভ ইট আ থট।’
পরের অংশ পড়তে ২ ক্লিক করুন
• ২৩ অগস্ট
সকাল থেকে অনেকগুলো মিটিং ছিল। গত দু’দিনের ব্যাপারটা যেন ভুলে মেরে দিয়েছিলাম। কাজের মধ্যে থাকলে যা হয়। সন্ধেয় স্নান সেরে বারান্দায় গিয়ে বসতেই দিল্লির সব ঘটনা যেন ফ্ল্যাশব্যাকে ভিড় করে এল! এ বার কি একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার?
আসলে রাজনীতির অফার তো এই প্রথম নয়! গুজ্জুর কথা মনে পড়ে গেল। আমাদের মহাভারত সিরিয়ালে যুধিষ্ঠিরের রোল করা গজেন্দ্র নব্বইয়ের গোড়ার দিকেই বিজেপি-তে জয়েন করেছিল। মহাভারতের পরেও ওর সঙ্গে যোগাযোগ বরাবরই ছিল। ২০০১ নাগাদ এক দিন হঠাৎই ফোন করে বলে, ‘বিজেপি আপনাকে নিয়ে ইন্টারেস্টেড!’ প্রধানমন্ত্রীর অফিসে এক ভদ্রলোক নাকি এ ব্যাপারে ফোনে কথা বলতে চাইছেন। কী যেন ভদ্রলোকের নামটি বেশ! যা! ভুলে গেছি। দেখাও করতে বলেছিল। আমি তো হেসে খুন! কাটিয়ে দিয়েছিলাম।
সেই হল শুরু। ও, না না। তারও আগের একটা গল্প আছে। মহাভারতের শুটিং চলতে চলতেই এক বার অফার দিয়েছিল কংগ্রেস। ’৮৯ সাল নাগাদ হবে। প্রীতীশ নন্দী আর মহেশ ভট্ট ফোন করে বলেছিলেন, কংগ্রেসে জয়েন করবে রূপা? মনে আছে পর পর দু’দিন দুজনে আলাদা করে ফোন করে কত বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। মহেশজি বলেছিলেন, ‘ভোটে না দাঁড়াও, ওদের ক্যাম্পেনে হেল্প করে দাও।’ মুম্বই থেকে ফোন করে জানাতেই মা বলেছিল, ‘তুই খেপছস নাকি রে রূপি!’
তখন ব্যাপারটা একদম পাত্তা দিইনি। আসলে অত তাড়াতাড়ি মহাভারতের এত বড় সাকসেস, এত পপুলারিটি। মহাভারতের কাজটাও লম্বা চলবে। তা ছাড়া মেন্টাল মেক-আপটাও তখন রাজনীতির মতো ছিল না। শুটিং-এর পরেও সমস্ত ভাবনা জুড়ে থাকত আমার কাজ, আমার কমিটমেন্ট, আরও ভাল করার জেদ।
খাবার টেবিলে নিতিন গডকড়ীর প্রস্তাবের কথাটা মা-কে বলেই দিলাম। প্রথমটায় বুঝতেই পারেনি। পরে বলল, ‘তর কি মাথা খারাপ হইল! যেইডা করছিস, হেইডাই কর। শরীরডার দিকে খেয়াল নাই! খালি চরকিপাক খাচ্ছস!’ মা এটাই বলবে, জানতাম। কিন্তু আমি কী করি!
• ১০ সেপ্টেম্বর
কোত্থেকে যে এরা গন্ধ পেয়ে যায় কে জানে! তিন দিন ধরে ফোন করছে, ‘রূপাদি তোমার নতুন ছবিটা নিয়ে একটা ইন্টারভিউ দাও না গো!’ কেমন যেন মনে হচ্ছিল, পলিটিক্স নিয়ে প্রশ্ন করবে না তো?
যেমনটা ভাবা! বাড়িতেই ডেকেছিলাম। জানতে চাইল, ‘ছবির চরিত্রটা নাকি রাজনীতিকের?’ বললাম হ্যাঁ। হিন্দি ছবি। বাবুমশাই বন্দুকবাজ। ক্যারেক্টারটাও জম্পেশ! ডাকসাইটে জাঁদরেল মহিলা রাজনীতিক। একদম আজকালকার নেত্রী। পলিটিক্সের জন্য যা যা করতে হয়, সেটা করে। দরকারে মুখ খারাপ করে, রোয়াবও ভীষণ! লোকে বলে বড়দি। ক্যারেক্টারটা নেগেটিভ নয়, বাট শি ইজ গ্রে!
বলল,‘তার মানে অনস্ক্রিন বুঝিয়ে দিচ্ছ বাস্তবে রাজনীতিকরা কেমন হওয়া উচিত নয়। আবার ইদানীং সোশ্যাল ওয়ার্ক নিয়েও খুব ব্যস্ত! রাজনীতিতে নামছ নাকি গো?’ উত্তরটা আমার নিজেরই জানা ছিল না। এড়িয়ে গিয়ে বললাম, সেই বিশ বছর ধরেই তো নানা পার্টির অফার রয়েছে। আর সোশ্যাল ওয়ার্কটা আজ হুট করে তো নয়, সেও অনেক দিন হয়ে গেল।
‘আদর্শের দিক থেকে কোনও একটা দলের প্রতি ঝোঁক রয়েছে কি?’ হয়তো ডিপ্লোম্যাটিক হতে পারতাম! কেন জানি না, ভেতর থেকে রাগটা বেরিয়েই এল! সপাট বলে দিলাম, দেখো, এটুকু জানি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কোনও দিন হাত মেলাতে পারব না। কারণ একটাই। ওঁর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কী কথা বলে ক্ষমতায় এসেছিলেন, আর এখন দেখো কী কাণ্ডটাই না করছেন!
যাক গে। যা বলেছি, ঠিক বলেছি। একশো বার বলব। কিন্তু সেটা কথা নয়, আসল প্রশ্নটা ও শেষে করল। মুখে দুষ্টু হাসি ঝুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি আচ্ছে দিনের স্বপ্ন দেখছ?’ বললাম, আচ্ছে দিনের স্বপ্ন তুমি দেখো না? আমরা সবাই দেখি।
আসলে লোকসভা ভোটের সময়ই প্রার্থী করতে বিজেপি এত ঝুলোঝুলি শুরু করেছিল, দিল্লি, মুম্বই, কলকাতার এত মানুষকে দিয়ে ফোন করাতে শুরু করেছিল, তার পর আর খবর চাপা থাকে! মনোজটাই নাটের গুরু। ‘অগলে জনম মোহে বিটিয়া হি কিজো’-র শুটিংয়ের সময় থেকে ওকে চিনি। প্রযোজক সঞ্জয় তিওয়ারি আলাপ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ওদের পরিবার দিল্লিতে কয়েক পুরুষ ধরে আইনের পেশার সঙ্গে জড়িয়ে। সেই থেকে বন্ধুত্ব। পরে জেনেছি, মনোজের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে রাজনাথ সিংহের সঙ্গে। লোকসভা ভোটের সময় সাঁকোটা ও-ই নাড়িয়েছিল। হুট করে বলল, আপনি প্রার্থী হয়ে যান প্লিজ! রাজনাথজি খুব চাইছেন। এই সিট নিন, ওই সিট নিন, যেটা ইচ্ছে বেছে নিন! লাগাতার ফোন করত। নিদেনপক্ষে এক বার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা তো করুন! যেন ‘ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে!’ এখনও সমান জেদে লেগে আছে। নিশ্চয়ই ওর পিছনেও লেগে আছে বিজেপি!
• ২ অক্টোবর
আজ অষ্টমী। পুজোয় প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘোরা অবশ্য কোনও দিনই আমার পোষায় না। কালও অনেক রাত পর্যন্ত বাড়িতে আড্ডা চলেছে। দুপুরে স্নানটান সেরে বাড়িতেই পুজো করলাম। আজ কাগজ আসবে না। টিভিটা খুলে দেখি প্রধানমন্ত্রী রাস্তায় নেমে ঝাড়ু দিচ্ছেন! ভাবা যায়! আগে কখনও হয়েছে এমন! আমার একটা বন্ধু অবশ্য বলল, গিমিক! কিন্তু তা-ই কি? না কি চার পাশে খারাপ জিনিস দেখতে দেখতে এতটাই নৈরাশ্যবাদী হয়ে গেছি আমরা? আমার কিন্তু বেশ ভাল লাগছে। ভদ্রলোক যে কথাগুলো বলছেন, কোথায় যেন কানেক্ট করতে পারি আজকাল। স্বচ্ছতা, উন্নয়ন, শিল্প— এইগুলোই কি আমাদের আসল দাবি নয়? ইস, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির তর্কও যদি এ সব নিয়ে হত!
আসলে খিদেটা আমার অনেক দিনের। ফেস্টিভ্যালের জন্য কত বার বিদেশে গেছি, প্রতি বারই মনে হত, এই দেশগুলো এমন ছবির মতো সুন্দর, পরিষ্কার। আমাদের হয় না কেন? কেউ কেউ বলে এত জনসংখ্যার চাপ ও-সব দেশে নেই, তাই ওদের পক্ষে দেশটা ঝকঝকে রাখা সোজা। আমার কিন্তু মনে হয়, এগুলো অজুহাত। এটা আসলে একটা অভ্যাস, অ্যাটিটুড টুওয়ার্ডস সোসাইটি। এই মানুষটা কিন্তু ঠিক কথাই বলছেন। পজিটিভ ভাবনা রয়েছে ওঁর মধ্যে।
এই রে! আমি কি ঝুঁকে পড়ছি মোদীর দিকে!
পরের অংশ পড়তে ৩ ক্লিক করুন
• ২৩ অক্টোবর
রামুকে নিয়ে বারান্দায় প্রদীপগুলো সাজিয়ে রাখছিলাম। দু’হাত জোড়া। এরই মধ্যে বিকেলে ফোন করল মনোজ, ‘রূপাজি, হ্যাপি দিওয়ালি!’ আমিও শুভেচ্ছা জানালাম। বলল, ‘ডোন্ট ওরি! নো মোর পলিটিক্স টুডে। জাস্ট দিওয়ালি উইশ করতে ফোন করলাম। আর কী চলছে?’ ইনিয়েবিনিয়ে সব খোঁজখবর নিল ঠিকই। কিন্তু বুঝলাম, আসলে টাচ-টা রেখে যাচ্ছে। আমিও যেন ধন্দে পড়ে গেছি। যা সব হতে দেখছি, মাঝে মাঝে মনে হয়, ধুর, ঠিকই তো বলছেন ওঁরা! এ বার নেমে পড়লেই তো হয়। এই তো গতকালই বোধহয় টিভিতে দেখলাম, কালীপুজোর চাঁদা না দেওয়ায় দুর্গাপুরে একটা কোম্পানির ডিরেক্টরকে কী মার মেরেছে এক তৃণমূলের কাউন্সিলর! কোনও মানে আছে!
কিন্তু বিজেপি? আসলে বরাবরই আমি বামপন্থী মানসিকতার ছিলাম তো! একটা সময় পর্যন্ত কেমন একটা স্নেহ কাজ করত ওঁদের প্রতি। কিছু ভুল করলেও মনে হত, নিজের ভাই তো, ডেকে দু’ঘা দেব, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু পরে দেখলাম, এক্কেবারে সব বেনোজল ঢুকে গেছে! বুদ্ধদেব মানুষটা বড় ভাল। কিন্তু উনি একা কী করবেন? যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তার আগেই রাশ আলগা হয়ে গেছিল। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সময়টা কলকাতায় ছিলাম না, টানা দু’বছর মুম্বইতে ‘অগলে জনম...’-এর শুটিং করেছি, সেই সঙ্গে রেডিয়োতে ‘হ্যালো রূপা’ করেছি। দিনে প্রায় ১৬ ঘণ্টা কাজ করতাম। এখানে ফিরে দেখলাম, সব লন্ডভন্ড। আর এখন সিপিএমের তো এমনিই মাজা ভাঙা। তাও সেই কোন আদ্যিকালের ধারণা নিয়ে বসে আছে! বিজেপি-কে তবু ভালো বলতে হয় যে, উন্নয়নের কথা বলছে, মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্যের কথা বলছে! একটা ডিরেকশন আছে।
হ্যাঁ করে দিই তাহলে। না কি, আর ক’দিন দেখব!
• ২৮ নভেম্বর
উফ, গায়ের জ্বালা যেন জুড়োচ্ছে না! মনে হচ্ছে নিজের চুল ছিঁড়ি! নিরীহ মানুষগুলোকে ঠকিয়ে টাকা লুটেপুটে নিয়েছে! এখন সিবিআই যেই তদন্তে নেমেছে, ধরপাকড় করছে, বলেন কিনা বাংলার সংস্কৃতি আক্রান্ত! চলো মিছিলে হাঁটি। সত্যি! আদ্যন্ত ভণ্ড এক মহিলা! বলি, বাংলার সংস্কৃতি কে শেষ করছে শুনি! মুখ্যমন্ত্রীর নাকি এই মুখের ভাষা! ‘বাঁশ’! ‘শালা’! ছি ছি!
গত পরশু সকালে অরিন্দমের টেক্সট-টা এসেছিল। অরিন্দম শীল। লিখেছে, ‘আগামী ২৮ নভেম্বর, শুক্রবার নন্দনে জমায়েত। সেখান থেকে অ্যাকাডেমি অবধি প্রতিবাদ মিছিল। কোনও রাজনৈতিক ব্যানারে নয়। বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতির ওপর আঘাত ও চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল হতে... পথে এ বার নামো সাথী। প্লিজ এসো।’ আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। লিখলাম, কীসের আঘাত, কে আঘাত হানল সংস্কৃতির ওপর? কীসের চক্রান্ত? উত্তর নেই।
তার পর টিভি দেখে বুঝলাম। হাঃ! যাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর গা সেঁটে থাকতেন, সেই অর্ধেক সেলেব্রিটি দেখি চুপচাপ কেটে পড়েছেন! কেউ কেউ শহরের বাইরে চলে গেছেন শুনলাম, ছুতো দেখিয়ে। বাকিদের জোর করে শুটিং বন্ধ করিয়ে ধরে এনেছে। ওঁদের মুখই বলে দিচ্ছিল। ওঁরাই বা কী করবেন! দিদির মিছিলে পা না মেলালে তো কাল থেকে কাজ বন্ধ। রুটি-রুজিও বন্ধ।
এর পরেও গা রি-রি করবে না! ও দিকে গাঁ-গঞ্জে ওঁর ভাইরা তাণ্ডব নৃত্য করছে। আর উনি নিজের ফায়দার জন্য লোককে মিছিলে নামাচ্ছেন। বাংলাকে শেষ করে দিল এক্কেবারে!
রাগ চেপে না রাখতে পেরে দু’তিন জন বন্ধুকে ফোন করছিলাম। মা শুনে চটে গেল! বলল, ‘তর ওপর ভুবনের ভার? তর ভয়ডর নাই। ওরা তরে ছেড়ে দেবে?’ কী করবে? আমি ভয় পাই নাকি! যত সব চোর-ছ্যাঁচোড়!
• ৩০ ডিসেম্বর
অচেনা নম্বর! ল্যাপটপে আগামী শিডিউলগুলো চেক করছিলাম তাই ধরিনি। দ্বিতীয় বার ফের রিং হতে ফোনটা তুললাম। ও-পার থেকে বললেন, ‘আমাকে আপনি চিনবেন কিনা জানি না। আমি পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি-র সাধারণ সম্পাদক শমীক ভট্টাচার্য বলছি।’ বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ শমীকবাবু, আপনাকে আমি চিনি। টিভিতে দেখেছি, আপনি খুব যুক্তি দিয়ে কথা বলেন।
ইদানীং খবরের চ্যানেলগুলো রোজ মন দিয়ে দেখি। রাজনীতিতে যদি কখনও নামি, পারিপার্শ্বিক, দেশ, বিদেশ সমস্ত ব্যাপারে চোখ কান খোলা রাখাটাই প্রথম শর্ত হওয়া উচিত। যাক সে কথা। জানতে চাইলাম, বলুন কী ব্যাপার। বললেন, ‘ফোনে বলব না। কাল এক বার আপনার সঙ্গে দেখা করা যায়? আমার সঙ্গে রাহুলদা-র কথা হয়েছে। পার্টি প্রেসিডেন্টও শুনলাম জানেন ব্যাপারটা। ওঁরাই বলেছেন, আপনার সঙ্গে দেখা করতে।’ বললাম, আপনি বেলা ১১টা নাগাদ আসতে পারবেন?
• ৩১ ডিসেম্বর
দেখলাম পাংচুয়াল। ১১টা তো ১১টা! এমন লোকেদের ভাল লাগে। কোনও গৌরচন্দ্রিকা করলেন না, বললেন, ‘আপনার সঙ্গে নিতিনজির কয়েক বার কথা হয়েছে শুনলাম।’ বললাম, কয়েক বার ঠিক নয়, দু’বার। ‘আপনি রাজি তো! সামনে একটা ভাল দিন আছে, তাই আমরা ভাবলাম ও দিনই যদি….’ জানতে চাইলাম, ভাল দিন মানে কবে? বললেন, ‘সাত তারিখ।’ মানে এই সাত তারিখ? তার মানে তো একদম ঘাড়ের ওপর! বললাম, দাঁড়ান দাঁড়ান, এক বার ডায়েরিটা দেখে নিই। ওই দিন কলকাতায় আছি কি না। তা ছাড়া ফাইনাল কল আমি এখনও নিতে পারিনি।
উনি যেন আমার ধন্দটায় গুরুত্ব দিতে চাইলেন না। যেন বুঝতে পারলেন, আমি এক রকম সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছি। হেসে বললেন, ‘সাত তারিখটাই ফাইনাল। অরুণজি কলকাতায় আসছেন। উনি থাকাকালীন জয়েন করলে ব্যাপারটা ভাল হয়। রাহুলদার সঙ্গে পার্টি প্রেসিডেন্টের কথা হয়ে গেছে। জেটলিজিও রাজি। শুধু আপনার ক্লিয়ারেন্স থাকলেই….’
একেবারে হ্যাঁ বললাম না। বললাম, দেখুন আমি খামখা ঝুলিয়ে রাখা পছন্দ করি না। দু’দিন সময় দিন। আমি জানিয়ে দেব। আমিই আপনাকে ফোন করব। আসলে কিছু ফিল্মের কমিটমেন্ট আছে তো। শুটিংয়ের সব ডেট ঠিক হয়ে আছে। ওগুলো চেঞ্জ করলে ওরা সমস্যায় পড়ে যাবে। তা ছাড়া কোনও কিছু হাফ-হার্টেড ভাবে করার বান্দা তো আমি নই। দু’দিন রাজনীতি করলাম, মাঝে দুটো ছবির শুটিংও করে নিলাম, একটু আউটডোরে বেড়িয়ে এলাম— এ সব করব না। করলে মন দিয়েই করব। টোয়েন্টি ফোর সেভেন! উনি বললেন, ‘ঠিক আছে, এক বার জয়েন করে নিন। তার পর পেন্ডিং কাজগুলো সেরে ফুল-ফ্লেজেড নেমে পড়ুন।’
শমীকবাবু বেরিয়ে যেতেই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ওখানে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলে যেন উত্তর পাওয়া যায় ও-পার থেকে। সামনে গাছ ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না তো! কোনও শব্দও নেই। মন যেন বলল, এ বার হ্যাঁ করে দে রূপা!
পরের অংশ পড়তে ৪ ক্লিক করুন
• ২ জানুয়ারি, ২০১৫
আমাকে আর ফোন করতে হল না। রাহুলবাবু নিজেই ফোন করেছিলেন কিছু ক্ষণ আগে। বললেন, ‘নমস্কার, রাহুল বলছি। স্টেট বিজেপি প্রেসিডেন্ট। আপনার ব্যাপারটা তা হলে ফাইনাল করে দিচ্ছি। তবে প্লিজ মিডিয়াতে এখনই বলবেন না। ওটা সারপ্রাইজ থাক। ঠিক সময়ে আমরা খবরটা ছাড়ব।’
‘হাওড়ার শরৎ সদনে প্রোগ্রামটা রেখেছি। ওখানেই আমাদের ট্রেডার সেলের মিটিংয়ে আপনাকে জয়েন করাব। টাইমটা বিকেলের দিকেই হবে। তবে ফাইনাল টাইমটা পরে ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হবে।’
• ৬ জানুয়ারি
দু’দিন ধরে বাড়ির লোকজন ঘ্যানঘ্যান করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। তুই কোন আক্কেলে হ্যাঁ করে দিলি! সোনা তো হেসে খুন। বলল, ‘তুই রাজনীতি করবি? তোর মতো ঠোঁটকাটা মেয়েকে দিয়ে রাজনীতি হবে! মুখের ওপর কোথায় কী বলে দিবি! তার পর দেখবি, তোকে বের করে দেবে।’ দাদাও সায় দিল,‘পলিটিক্সের একটা গ্রামার আছে রূপা। ও সব তুই জানিস?’ মা-র কথা ছেড়েই দিলাম। কিছু বলতে গেলেই গজগজ করছে।
ভাবছিলাম, ঠিক সিদ্ধান্ত নিলাম তো! ছোটবেলায় কোনও দিনও ভাবিনি সিনেমা করব। যোগমায়া দেবী কলেজে পড়ার সময় এক বার মৃণালবাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট শ্রীপান্থদা বাসে ফলো করছিলেন। পিছু পিছু হেঁটে এসে বলেছিলেন, আপনি অভিনয় করবেন? কোথাকার কে জানি না, দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, আপনি যাবেন, না লোক ডাকব! পরে সেই সিনেমাতেই নামলাম। কী লজ্জার ব্যাপার। শ্রীপান্থদা আজও দেখা হলে বলেন, বলিহারি রূপা, আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।
কিন্তু রাজনীতি? আমি পারব তো? আশপাশের ঘটনা নিয়ে রাগ, ঘেন্না ছিলই। কিন্তু ঝোঁকের বশে হ্যাঁ করে দিলাম কি! কাল তা হলে বিজেপি-র ফ্ল্যাগটা হাতে নেব? না কি, ‘সরি’ লিখে কাটিয়ে দেব! সাত-সতেরো ভাবতে ভাবতেই দেখি গডকড়ীজির ফোন। বাবা, এত রাতে! স্ট্রেঞ্জ! ‘রূপাজি, সরি, এত রাতে ফোন করলাম।’ বললাম, না না, ঠিক আছে। বললেন, ‘কনগ্র্যাচুলেশন্স! অ্যান্ড ওয়েলকাম টু বিজেপি।’ হেসে বললাম, আমি তো এখনও জয়েন করিনি। উনি বললেন, ‘ঘড়িতে দেখুন, একটা বেজে গেছে। টুডে ইজ সেভেন্থ। অ্যান্ড আই অ্যাম দ্য ফার্স্ট হু কনগ্র্যাচুলেট ইউ।’ ও, তাই তো! কিন্তু লোকজন যেন কনফিউজ করে দিচ্ছে। ‘সে তো করবেই। ফিল্মে যখন নেমেছিলেন, তখন কনফিউজ করেনি? কিন্তু আপনার ডিসিশন আপনারই। আপনি পারবেন।’
ফোনটা পেয়ে কেমন যেন আত্মবিশ্বাসটা বেড়ে গেল। পারব। পারবই।
• ৭ জানুয়ারি
সাদা খোলে হালকা অরেঞ্জ পাড়ের শাড়িটা কাল রাতে বের করে রেখেছিলাম। তিনটেয় প্রোগ্রাম। তৈরি হচ্ছিলাম, রামু এসে বলল, ‘দিদি, টিভিটা খুলুন দেখি! আপনাকে দেখাচ্ছে শুনলাম!’ দেখি ব্রেকিং নিউজ চলছে, ‘বিজেপি-তে যোগ দিচ্ছেন রূপা গঙ্গোপাধ্যায়।’ অন্য একটা চ্যানেলে স্ক্রল, ‘মহাভারতের দ্রৌপদী এ বার বিজেপি-তে।’
সিনেমায় ব্রেক পেয়েছিলাম আঠাশ বছর আগে। সে দিনের আনকোরা রূপাকে যেন হঠাৎই দেখতে পেলাম আয়নায়! প্রথম বার শট দেওয়ার মতোই ভিতরে তিরতির করছে উত্তেজনা। পরক্ষণেই মনে হল, না, ইতস্তত করার বিলাসিতা চলবে না। বেয়াদবি বন্ধ করতে গেলে নিজেকেই শক্ত হতে হবে। সত্যিই তো, রাজ্যটা বেয়াদবদের আখড়া না হয়ে উঠলে রাজনীতিতে নামার দরকারই ছিল না।
রামুকে বললাম, তুই থাক। স্করপিয়ো-টা বের করে, নিজেই ড্রাইভ করে গেলাম। এমনিতেই শরৎ সদনের দিকটায় খোঁড়াখুড়ি চলছে। তার ওপর বিজেপি-র ব্যবসায়ী সেলের মিটিং, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী আসবেন, জট পাকিয়ে গেছিল। ঢোকার মুখে সানগ্লাসটা খুলে রেখে কাচটাও নামিয়ে দিলাম। দূর থেকে দেখতে পেয়েই, অনেকে মিলে, ‘রূপা গাঙ্গুলি জিন্দাবাদ!’ ওঃ! থইথই করছে বিজেপি সমর্থক! গোটা চত্বর গেরুয়া! চকিতে যেন রোমাঞ্চ খেলে গেল শরীরে! মঞ্চের, আসরের, সিনেমার তুলনায় এই উন্মাদনা অন্য রকম। অনেক খোলা, গনগনে।
শমীকদা গেটেই দাঁড়িয়েছিলেন। ওঁকে আগেই বলে রেখেছিলাম, প্রথম দিনই আমাকে কিছু বলতে অনুরোধ করবেন না প্লিজ। প্রথম ক’দিন আমি বুঝে নিতে চাই, শিখে নিতে চাই। অরুণ জেটলি এলেন মিনিট পনেরো পর। ব্যাকস্টেজের ব্যাপার নেই। উনি পাশে এসে দাঁড়াতেই স্লোগান, চিৎকারের ঠেলায় যেন ছাদ ফেটে যায়-যায়! বললেন, ‘আপনাকে অনেক দিন থেকেই চিনি। মহাভারতে আপনার অভিনয় অসাধারণ লেগেছিল। অ্যান্ড আই নো ইউ উইল সাকসিড ইন পলিটিক্স টু! আপনি ঠিক ও ভাবেই বাংলার মানুষের মন জিতে নেবেন।’ তার পর বিজেপি-র দলীয় পতাকাটা আমার হাতে তুলে দিলেন। ইয়েস, দ্যাট ওয়াজ দ্য মোমেন্ট! ও হ্যাঁ, সিদ্ধার্থনাথ সিংহ আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে একটা ভাল বিশেষণ জুড়লেন, ‘নেশন- স্টপার অন সানডেজ।’
বাড়ি ফেরার পথে খুব এক্সাইটেড লাগছিল। ভাবা যায়! এ ক’দিনে বিজেপি কেমন জেগে গেছে! আমিও যেন সংক্রামিত হয়ে গেছি ঘণ্টা খানেকেই। বাড়ি ফিরে ফোনে পর পর কতকগুলো ইন্টারভিউও দিলাম। বললাম, ‘রাস্তা কঠিন, জানি। কিন্তু রাজ্যে হিংসা ও ঘৃণার যে রাজনীতি চলছে, তা বন্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করব।’
এবিপি আনন্দে একটা লাইভ ইন্টারভিউ ছিল। ওরা জানতে চাইল, ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে কবে রাজনীতি ছাড়ব?
রূপাকে তা হলে চেনেনি!
অনুলিখন: শঙ্খদীপ দাস
(চলবে)