২০১৭ কেমন যাবে? না, নরেন্দ্র মোদী বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নয়। এমনকী আপনার-আমারও নয়। ও সব বলে দেওয়ার জন্য রাশিফলের কারবারিরা আছেন। এ বছরটা বিশ্ববিজ্ঞানের কেমন যাবে? কী কী ঘটতে পারে গবেষণার দুনিয়ায়, তার তালিকা পেশ করেছে বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় দুই মুখপত্র— ‘নেচার’ এবং ‘সায়েন্স’। ভবিষ্যদ্বাণীর তালিকা দুই পত্রিকায় দু’রকম। তবে মিলও আছে। দুটো বিষয়ে। প্রথম অবশ্যই ডোনাল্ড ট্রাম্প কুর্সিতে বসার পর মার্কিন বিজ্ঞান-গবেষণার আকাশে অশনি সংকেত। আর দ্বিতীয়? দুই পত্রিকাই জানাচ্ছে, এ বছর হয়তো নিশ্চিত খবর মিলবে সৌরমণ্ডলের নবম গ্রহের। আবার হয়তো সত্যি হবে ‘নয়ে নবগ্রহ’।
এগারো বছর আগে গ্রহের মর্যাদা হারিয়েছিল প্লুটো। অনেককে কাঁদিয়ে। ভূগোল-বিজ্ঞানের বই নতুন করে ছাপতে হয়েছিল। নবম গ্রহের অস্তিত্ব প্রমাণিত হলে হয়তো আবার পুরনো হবে নতুন বই। তা হোক, তবু শোক ভুলবেন অনেকে। নবম গ্রহ তাই স্বাগত। তার ইঙ্গিতও মিলেছে সম্প্রতি। বাকি শুধু অস্তিত্বের নিশ্ছিদ্র প্রমাণ। অবশ্য, গ্রহ আবিষ্কার সহজ নয় মোটে।
অন্ধকার আকাশের বুকে তার খোঁজ এক দীর্ঘ উপাখ্যান। প্রাচীন মানুষ রাতে ঊর্ধ্বপানে তাকিয়ে লক্ষ করেছিল ছয় আলো। প্রায় স্থির নক্ষত্ররাশির মাঝে যারা চলমান। চাঁদ, বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি আর শনি। এর সঙ্গে দিনের সূর্য যোগ করলে সংখ্যা সাত। গ্রিসের মানুষ ওদের নাম দিয়েছিল ‘প্লানেত’। অর্থাৎ পরিব্রাজক। তখনকার তালিকায় পৃথিবী গ্রহ নয়, কারণ সে নাকি ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে। তাকে ঘিরে আর সব। নিকোলাস কোপারনিকাস সে ভ্রান্তিবিলাস দূর করার পর পৃথিবীর জায়গা নিল সূর্য। গ্রহের নতুন সংজ্ঞা হল, যারা সূর্যের চার দিকে ঘোরে। সাতের তালিকা থেকে সূর্য ও চাঁদ বাদ গিয়ে ঢুকল পৃথিবী। হল ছয়।
খালি চোখে আকাশ দেখলে পৃথিবী সমেত গ্রহের সংখ্যা ওই ছয়ে আটকে থাকত। দূরবিনের আবিষ্কার বাড়িয়ে দিল দৃষ্টি ক্ষমতা। দেখা গেল, শনির পরে আছে আর এক গ্রহ। সূর্য থেকে শনির প্রায় দ্বিগুণ দূরত্বে মোটামুটি বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরছে। অত দূরে, তাই খালি চোখে দেখা যায়নি আগে। দূরবিনে চোখ রেখে রাতের আকাশ দেখছিলেন জার্মান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ, শখের জ্যোতির্বিজ্ঞানী উইলিয়াম হারশেল। ১৩ মার্চ, ১৭৮১। মিথুন রাশির দিকে তাকিয়ে হারশেল অবাক। হলুদ-সবুজ রঙের একটা চাকতি যেন! ধূমকেতু নাকি? না কি কোনও তারা? তারা হলে তা স্থির থাকবে নিশ্চয়ই। আর ধূমকেতু হলে, চলমান হলেও তার আকার পালটাবে, লেজ দেখা যাবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, তার কক্ষপথ হবে ভীষণ চ্যাপটা বৃত্তের (উপবৃত্তাকার) মতো। তার বদলে ওই আলোর বিন্দু তো ঘুরছে প্রায় বৃত্তাকার পথে!
হারশেল তাঁর আবিষ্কার ঘোষণা করায় চার দিকে শোরগোল পড়ে গেল। দেশে দেশে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা রাতের আকাশের পুরনো মানচিত্র খুলে বসলেন। জানা গেল, বেশ কয়েক জন আগেও দেখেছে ওই আলোর বিন্দু। কিন্তু চিনতে ভুল করেছে। তাকে ভেবেছে নক্ষত্র। ভুল ভাবনা বিজ্ঞানে চিরকাল অপাঙ্ক্তেয়। যদিও নতুন গ্রহের কক্ষপথ খোঁজায় এবং তা গণনায় যোগ দিলেন অনেকে, তবু তার আবিষ্কর্তা হিসেবে চিহ্নিত হলেন হারশেল। যিনি মুখ্যত ছিলেন গায়ক। গান গাইতেন কয়্যারে। নেহাত শখে আকাশ দেখা। বোন ক্যারোলিন এ ব্যাপারে দাদার সাহায্যকারী। যে দূরবিনে নতুন গ্রহ আবিষ্কার, ভাই-বোন মিলে তা বানিয়েছিলেন বাড়িতেই।
গ্রহ-আবিষ্কর্তা হিসেবে হারশেল বনে গেলেন হিরো। গায়ক-কেরিয়ারে ইতি। ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জ দিলেন নাইটহুড। ২০০ পাউন্ড বৃত্তি। অবজারভেটরি উঠে এল উইন্ডসর দুর্গে। সে সব নাহয় হল, নতুন গ্রহের নাম কী হবে? ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নতুন গ্রহকে বলতে লাগলেন ‘প্লানেট হারশেল’। রীতি মেনে নাম। ধূমকেতুর নাম যদি রাখা হয় আবিষ্কর্তা স্মরণে (এই যেমন হ্যালি’স কমেট), তা হলে গ্রহের বেলায় সে রীতি মানতে আপত্তি কোথায়? স্বয়ং হারশেলের পছন্দ হল না ওই নাম। রাজার দাক্ষিণ্যে তিনি এতটাই গদগদ যে, নতুন গ্রহকে বললেন ‘জর্জিয়ান সাইডাস’ (‘জর্জীয় স্বর্গীয় বস্তু’)। তর্ক উঠল, স্বর্গীয় বস্তুর নাম কোনও এক দেশের রাজার স্মরণে দেওয়া যায় কি না। অনিশ্চয়তা চালু রইল ষাট বছর। তা নিরসন করলেন আর এক জন। জার্মানিতে জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত এক জার্নালের সম্পাদক, যোহান এলার্ট বোড। তাঁর পরামর্শ: নতুন গ্রহের নাম হোক ‘ইউরেনাস’। কেন? বাহ্ রে, প্রাচীন অ্যালকেমিস্টরা গ্রহের নাম রাখতেন নানা ধাতুর নামে। আর ওই গ্রহ আবিষ্কারের আট বছর পরে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে জার্মান রসায়নবিদ মার্টিন হাইনরিখ ক্লাপ্রোথ খুঁজে পান নতুন ধাতু— ইউরেনিয়াম।
১৮২১। ইউরেনাস আবিষ্কারের পর কেটেছে চল্লিশ বছর। ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যালেক্সি বুভার্দ ইউরেনাসের কক্ষপথ বিচার করছেন। করতে গিয়ে পড়লেন ফাঁপরে। কারণ, সূর্যের চার পাশে গ্রহের চলার যে পথ বাতলেছেন আইজাক নিউটন কিংবা জোহানেস কেপলার, তা মেনেই তো চলছে ওরা। এ দিকে গণনা বলছে, গ্রহের কক্ষপথ হওয়া উচিত এক রকম। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তা অন্য রকম। দুই বড় গ্রহ বৃহস্পতি আর শনির আকর্ষণ নিশ্চয়ই টানছে ইউরেনাসকে। সে হিসেব গণনাতে ঢুকিয়েও ব্যাখ্যা করা গেল না ওই গ্রহের কক্ষপথ। তবে কি ভুল নিউটন বা কেপলারের সূত্র? নাকি মহাশূন্যে ছড়িয়ে আছে ধোঁয়ার মতো কোনও মাধ্যম, যা বাধা দিচ্ছে ইউরেনাসের গতি?
আরও পড়ুন: এই শহর প্রেমিকের, এই শহর গুপ্তচরের
দুজন সমাধান দিলেন রহস্যের। এক জন ব্রিটিশ। জন কাউচ অ্যাডাম্স। অন্য জন ফরাসি। আরবাঁ জাঁ-যোসেফ লেভেরিয়ার। ওঁরা বললেন, নিশ্চয়ই অলক্ষে থেকে ভেলকি দেখাচ্ছে ইউরেনাসের চেয়েও দূরের এক গ্রহ। দুজনে গণনা করে বের করলেন, কোথায় থাকা উচিত সে গ্রহের। তার পর নিজের দেশের সরকারি মানমন্দিরের অধিকর্তাদের অনুরোধ জানালেন, রাতের আকাশে কোন জায়গায় খুঁজলে মিলবে সে গ্রহের দেখা। বলা বাহুল্য, সম্ভাব্য অবস্থান গণনা করতে দুজনেই কাজে লাগালেন নিউটন-কেপলারের ফরমুলা। ব্রিটিশ এবং ফরাসি মানমন্দিরের অধিকর্তারা কিন্তু ওঁদের আর্জি শুনলেন না। লেভেরিয়ারও নাছোড়। যোগাযোগ করলেন জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী যোহান গটফ্রিড গাল-এর সঙ্গে। যিনি পেপার লিখলে পড়তে পাঠান লেভেরিয়ারকে।
১৮৪৬। ২৩-২৪ সেপ্টেম্বর, মধ্যরাত। লেভেরিয়ারের পরামর্শ মেনে গাল ও তাঁর সহকারী হাইনরিখ লুই দ্য’আরেস্ট দূরবিন তাক করলেন আকাশে নির্দিষ্ট জায়গায়। কী আশ্চর্য! দেখা গেল, ওখানে সত্যিই ঘাপটি মেরে বসে এক গ্রহ। নেপচুন। সমুদ্রের দেবতা। এই আবিষ্কার বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক বিরাট সাফল্য। গণনা-নির্ভর আগাম অনুমান এবং পরে তার সত্যতা প্রমাণ। আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের এটাই নিয়ম। তত্ত্ব বা গণনা-নির্ভর অনুমান যদি বাস্তবে সত্যি প্রমাণ হয়, তবে সেই তত্ত্ব বা গণনা সম্পর্কে সন্দেহ-অবিশ্বাস মুছে যায়। নেপচুন গ্রহ আবিষ্কারে যেমন সমর্থিত হল নিউটন ও কেপলার প্রবর্তিত তত্ত্ব। এ ভাবে বাস্তব সত্যের আগাম আভাস পেশ করায় জ্যোতির্বিজ্ঞানী মহলে কদর বাড়ল লেভেরিয়ােরর। তাঁর কৃতিত্ব চমৎকার এক মন্তব্যে ব্যাখ্যা করলেন দমিনিক ফ্রাঁসোয়া জাঁ আরাগো। এই গণিতজ্ঞ এবং পদার্থবিদ (যিনি ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন) বললেন, ‘লেভেরিয়ার আকাশে নতুন গ্রহ আবিষ্কার করলেন কলমের ডগা দিয়ে!’
নেপচুন আবিষ্কারে শেষ হল না গল্প। কয়েক দশক পর জানা গেল, একা নেপচুনের উপস্থিতিতে মিটছে না ইউরেনাসের কক্ষপথের গোলমাল। তা হলে কি আছে আরও কোনও গ্রহ? দুই আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী এগিয়ে এলেন রহস্য সমাধানে। এক জন উইলিয়াম পিকারিং। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি আকাশে এক জায়গায় দূরবিন তাক করতে বললেন সহকর্মীদের। মিলল না কিছু। তার পর আর এক জায়গায়। সেখানেও ভোঁ-ভাঁ। এর পর নামলেন এক শখের জ্যোতির্বিজ্ঞানী। পারসিভাল লোয়েল। ধনকুবের। আরিজোনা প্রদেশে ফ্ল্যাগস্টাফ শহরের পাশে নিজের খরচে বানিয়েছিন মানমন্দির। লোয়েল বিশ্বাস করেন, মঙ্গল গ্রহে বাস করে বুদ্ধিমান জীব। তারা চাষবাসও করে। সেচের জল নাকি সরবরাহ করে নালা কেটে। দূরবিনে সে সব নালা নাকি দেখতেও পাওয়া যায়। এমন দাবি করে অচিরে সতীর্থদের ব্যঙ্গবিদ্রুপের শিকার হলেন লোয়েল। মান বাঁচাতে কিছু করা দরকার। লোয়েল নামলেন অজানা গ্রহ সন্ধানে। অজানা, তাই সে গ্রহের নাম দিলেন ‘প্ল্যানেট-এক্স’। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কাজ অসমাপ্ত রেখে মারা গেলেন লোয়েল। তাঁর মানমন্দির চালিয়ে যেত কাজ, কিন্তু বাদ সাধলেন তাঁর স্ত্রী কনস্ট্যান্স সাভেজ লোয়েল। প্রয়াত স্বামীর উইলের ব্যাখ্যা নিয়ে কোর্টে গেলেন তিনি।
১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে মামলা শেষ হলে প্ল্যানেট-এক্স খোঁজা শুরু। পরের বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সফল হলেন মানমন্দিরের ২৪ বছর বয়সি এক কর্মী। ক্লাইড টমবাও। সাফল্যের খবর চেপে রাখা হল প্রায় এক মাস। ঘোষণা করা হল ১৩ মার্চ তারিখে। কারণ ওটা লোয়েলের ৭৫-তম জন্মদিন। আর ইউরেনাস আবিষ্কারের ১৪৯-তম বর্ষপূর্তি। প্ল্যানেট-এক্স-এর নাম কী হবে? লোয়েলের বিধবা স্ত্রীর ইচ্ছে, ‘লোয়েল’ কিংবা ‘কনস্ট্যান্স’। মানমন্দিরের কর্মীরা বাছলেন ‘প্লুটো’। যিনি কিনা নরকের দেবতা। অবশ্য মানমন্দিরের কর্মীদের পছন্দ ওই নামের দুটো অক্ষর। পি এবং এল। পারসিভাল লোয়েল-এর আদ্যক্ষর তো ও দুটোই! নামের পরামর্শ অবশ্য এসেছিল অক্সফোর্ডের এক স্কুলছাত্রীর কাছ থেকে।
আবিষ্কারের শুরু থেকেই প্লুটো নিয়ে ঝামেলা। লোয়েল বলেছিলেন, প্ল্যানেট-এক্স’এর ওজন হবে পৃথিবীর দশ গুণ। যত দিন গিয়েছে, উন্নত পর্যবেক্ষণে ওই ওজন কমে ধার্য হয়েছে পৃথিবীর দশ ভাগের এক ভাগ, একশো ভাগের এক ভাগ, এমনকী পাঁচশো ভাগের এক ভাগ। ওজনের সঙ্গে ব্যাসও কমেছে। পৃথিবীর সমান ১৩০০০ কিলোমিটার থেকে ২৫০০ কিলোমিটার। বুধ গ্রহ কিংবা পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদের চেয়ে প্লুটো আকারে ছোট। এ দিকে আবার প্লুটোর নিজের উপগ্রহ খ্যারন আকারে প্লুটোর অর্ধেক। যদিও সৌর পরিবারে অন্য গ্রহের উপগ্রহেরা গ্রহদের ব্যাসের একশো ভাগের এক ভাগ। ও সব ছাড়াও প্লুটোর কক্ষপথ একটু যেন আলাদা। আটটা গ্রহের কক্ষপথ যদি একটা তল হয়, তবে প্লুটোর কক্ষপথ ওই তলের সঙ্গে ১৭ ডিগ্রি তেরছা। ফলে সূর্য প্রদক্ষিণকালে প্লুটো এক বার ওই তলের ওপরে, আর এক বার নীচে যায়। কতটা? এ সব ক্ষেত্রে মাপের একক হল অ্যাস্ট্রনমিকাল ইউনিট (এইউ) বা সূর্য থেকে পৃথিবীর গড় দূরত্ব। ১৪৯,৫৯৭,৮৭০ কিলোমিটার ৭০০ মিটার। প্লুটো ঘুরতে ঘুরতে এক বার সৌরতলের ৮ এইউ ওপরে, আর এক বার ১৩ এইউ নীচে যায়। প্লুটো সত্যিই দলছুট।
তাকে গ্রহের পর্যায়ে ফেলা যায় কি না, সে নিয়ে ধন্দ অনেক পুরনো। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে মঙ্গল আর বৃহস্পতির মধ্যে অসংখ্য ছোট গ্রহ বা গ্রহাণুর খোঁজ মেলে। ওদের কি গ্রহ বলা হবে? যদি তা বলা হয়, তবে সৌর পরিবারে গ্রহের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ১,৩৫,০০০! শুরু থেকে জানা ছিল প্লুটোর ঠিকানা ‘কাইপার বেল্ট’। ডাচ-আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেরার্ড কাইপার স্মরণে সৌর পরিবারের যে এলাকা চিহ্নিত। নেপচুনের পর পেল্লায় একটা বলয় অঞ্চল। সূর্য থেকে নেপচুনের দূরত্ব ৩০ এইউ। কাইপার বেল্ট তার পর ২০ এইউ বিস্তৃত। হাজার হাজার বস্তু ওই বলয়ে গিজগিজ করছে। ওদের সাধারণ নাম ‘কাইপার বেল্ট অবজেক্ট’ (কেবিও)। তো হাজার হাজার কেবিও সবাই গ্রহ?
প্রশ্নটা বড় আকারে সামনে এল ২০০৫ সালে। যখন ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি-র জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাইকেল ব্রাউন ও তাঁর দুই সহযোগী শ্যাড ট্রাজিলো আর ডেভিড র্যাবিনোওয়াইৎজ আবিষ্কার করলেন এক কেবিও— ‘জেনা’। জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল ‘জেনা: ওয়ারিয়র প্রিন্সেস’ স্মরণে। নাম চূড়ান্ত হল না, হতে সময় লাগবে, তাই সতীর্থদের মধ্যে ওই নাম চালু করলেন ব্রাউন। নাম ঠিক করতে সময় লাগবে কেন? লাগবেই তো, এই আবিষ্কার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সমস্যায় ফেলে দিল যে! দেখা গেল, জেনা আকারে প্লুটোর চেয়ে বড়। তো প্লুটো গ্রহ হলে জেনা সে তকমা পাবে না কেন? দলছুট প্লুটো— এবং গ্রহাণু— নিয়ে পুরনো অসন্তোষ মাথাচাড়া দিল। এ কারণে যে, নাসা তড়িঘড়ি ব্রাউন ও দুই সহযোগীর আবিষ্কারকে ঘোষণা করে বসল দশ নম্বর গ্রহ। প্ল্যানেট-এক্স’এর এক্স রোমানে দশই বোঝায়। ‘জেনা’ নামের প্রথম ইংরেজি অক্ষরটি এক্স। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বুঝলেন, গ্রহের সংজ্ঞা বড় জ্বালাচ্ছে।
জ্বালাতন দূর করতে হবে। ২০০৬ সালে অগস্টে চেক প্রজাতন্ত্রের প্রাহা শহরে আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রনমিকাল ইউনিয়ন-এর সম্মেলনে ধার্য হল গ্রহের নতুন সংজ্ঞা। গ্রহের মর্যাদা পাবে সে বস্তু, যা (১) নক্ষত্রের চার দিকে ঘোরে; (২) এত ভারী যে, মাধ্যাকর্ষণের চাপে ঠেসেঠুসে প্রায় গোলাকৃতি হয়েছে। (৩) কক্ষপথের আশেপাশের ছোটখাটো বস্তু নিজের দেহে মিশিয়ে সে পথ পরিষ্কার করেছে। তা হলে প্লুটো আর জেনা? ওরা চিহ্নিত হল ‘বামন গ্রহ’। কারণ, ওরা তৃতীয় শর্ত পূরণে অক্ষম। ওদের কক্ষপথের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে ডজন ডজন বস্তু। অ্যাস্ট্রনমিকাল ইউনিয়নের সম্মেলনের আগে যেহেতু ধন্দ ছিল জেনা-র স্টেটাস (গ্রহ না বামন গ্রহ) নিয়ে, তাই নামও চূড়ান্ত হয়নি। সম্মেলনের পরে চূড়ান্ত হল তা। কী নাম পেল জেনা? ‘এরিস’। ঝগড়া-ঝামেলার গ্রিক দেবী। সার্থক নাম! ঝামেলা মেটার পর জেনা ওরফে এরিস আবিষ্কারের নেতা মাইকেল ব্রাউন লিখে ফেললেন একখানা বই। ‘হাউ আই কিল্ড প্লুটো অ্যান্ড ইট হ্যাড ইট কামিং’। তিনি প্লুটোর ‘হত্যাকারী’, তবে সে নিজেই নিজের কপাল পুড়িয়েছে।
মজার ব্যাপার, প্রাচীন নবম গ্রহের ওই হত্যাকারীই এখন নবীন নবম গ্রহের ইঙ্গিত দিয়ে আবার খবরের শিরোনামে। ঘটনাচক্রে ব্রাউন যেন এগারো বছর আগের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছেন। পোয়েটিক জাস্টিস ছাড়া কী-ই বা বলা যায় একে?
কানাঘুষো শোনা গিয়েছিল ২০১১ সালে। ৪৫০ কোটি বছর আগে সৌরমণ্ডলের জন্মকালীন সময়ের পরিস্থিতি বিচার করে (গ্রহগুলোর জন্মকাহিনি জানতে যা অবশ্যকর্তব্য) এক দল জ্যোতির্বিজ্ঞানী বললেন, হিসেব মিলছে না। সৌর-পরিবারে চারটে ‘জায়েন্ট প্ল্যানেট’ বা ‘বড় গ্রহ’ (বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস এবং নেপচুন) রয়েছে, অথচ থাকা উচিত পাঁচটা। তা হলে সেই পঞ্চম গ্রহ নজরে পড়ছে না কেন? সে কি রয়েছে বহু দূরে, এমন জায়গায় যে, দূরবিনেও চোখে পড়ছে না? প্রশ্নের সমর্থন মিলল ২০১৪ সালে। শ্যাডউইক ট্রাজিলো (জেমিনি অবজারভেটরি, হাওয়াই) এবং স্কট শেপার্ড (কারনেগি ইনস্টিটিউশন, ওয়াশিংটন) এক পেপার ছাপলেন ‘নেচার’ পত্রিকায়। এটা দাবি করে যে, নতুন এক কেবিও খুঁজে পেয়েছেন ওঁরা, যা ‘সেডনা’-র মতো। ২০০৩ সালে ব্রাউন এবং ট্রাজিলো (তখন তিনি ব্রাউন-এর ছাত্র) ‘সেডনা’ নামে কেবিও-র সন্ধান পেয়েছিলেন। সেডনা-র দোসর খুঁজে পাওয়ার পর আর কয়েকটা কেবিও-র সঙ্গে ওদের কক্ষপথের চরিত্র দেখে ট্রাজিলো এবং শেপার্ড সন্দেহ করলেন কক্ষপথের ওই বিশেষ চরিত্র ওখানে কোনও বড় গ্রহের কারসাজি।
ব্রাউন ভাবলেন, প্রাক্তন ছাত্রের অনুমান মিথ্যে প্রমাণ করবেন। কারণ, তাঁর দৃঢ় ধারণা, সৌর-পরিবারে পূর্ণাঙ্গ গ্রহের সংখ্যা আটের বেশি নয়। ক্যালটেক-এ তাঁর সহকর্মী কনস্টানটিন ব্যাটিগিন-এর সঙ্গে গবেষণায় নামলেন ব্রাউন। সেডনা এবং আরও পাঁচটা কেবিও-র কক্ষপথ কম্পিউটারে বিশ্লেষণ করলেন দুজনে। এবং রীতিমত অবাক হলেন। ওদের কক্ষপথগুলো বিশেষ নিয়মে বাঁধা। অধিকাংশ কেবিও-র কক্ষপথ (প্লুটোর কথা আগে বলেছি) সূর্যের আটটা গ্রহের কক্ষপথের কাল্পনিক তল থেকে হেলে রয়েছে। সেডনা এবং ওই পাঁচ কেবিও-র বেলাতেও তাই। মানে, ওরা আটটা গ্রহের কক্ষপথের এক বার উপরে এবং এক বার নীচে নামে। তা করতে হলে কাল্পনিক কক্ষতল ভেদ করতে হয়। কিন্তু, লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, সেডনা এবং পাঁচ কেবিও প্রত্যেকে ওই কক্ষতল ভেদ করে বিশেষ সময়ে। যখন ওদের দূরত্ব সূর্য থেকে সবচেয়ে কম। প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই এমনটা হওয়ার কথা নয়। সেডনা এবং কেবিও-গুলোর কোনওটা সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী অবস্থানে গ্রহের কক্ষতল ভেদ করতে পারত। কোনওটা মাঝারি দূরবর্তী থাকার সময়। সবাই কেন তল ভেদ করে সূর্যের সবচেয়ে কাছে থাকার সময়?
ব্যাপারটা কত অদ্ভুত, তা বোঝাতে ব্যাটিগিন এক উদাহরণ টেনেছেন। যা এ রকম: ধরা যাক, আপনি একটা পয়সা নিয়ে টস করলেন দশ বার। দেখলেন, পর পর দশ বার হে়ড। এক বারও টেল নয়। আপনার ভুরু কোঁচকাবেই। ভাববেন, এমনটা কেন ঘটছে? তা হলে কি পয়সার মধ্যে রয়েছে গলদ? টেল-এর দিকটা বেশি ভারী বলে সব সময় ওটা মাটির দিকে থাকছে? সেডনা এবং পাঁচ কেবিও-র কক্ষপথের বৈশিষ্ট্য (শুধু একটার কথা বলা হল, লক্ষণ আরও আছে) কম্পিউটারে বিশ্লেষণ করে ব্রাউন এবং ব্যাটিগিনের সিদ্ধান্ত: কাইপার বলয় অঞ্চলে প্রচণ্ড ভারী কোনও বস্তু তার মহাকর্ষের প্রভাব খাটাচ্ছে সেডনা এবং পাঁচ কেবিও-র ওপর। সে বস্তু কী? সৌর-পরিবারে নবম গ্রহ।
গবেষণার ফলাফল জানিয়ে ব্রাউন এবং ব্যাটিগিন পেপার ছেপেছেন ‘অ্যাস্ট্রনমিকাল জার্নাল’-এ। ‘এভিডেন্স ফর আ জায়েন্ট প্ল্যানেট ইন দি সোলার সিস্টেম’। যা ছাপা হয়েছে গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে। কেমন সে নবম গ্রহ? দুই জ্যোতির্বিজ্ঞানীর অনুমান, ওটা সুপার-আর্থ। পৃথিবীর দশ গুণ ভারী। সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে ৩,৭৫০ কোটি কিলোমিটার দূরত্বে। অর্থাৎ, সূর্য থেকে পৃথিবীর প্রায় ২৫০ গুণ দূরত্বে। কত সময় লাগছে নবম গ্রহের সূর্য প্রদক্ষিণ করতে? আমাদের হিসেবে ২০,০০০ বছর!
হ্যাঁ, এখনও পর্যন্ত নবম গ্রহ দাঁড়িয়ে আছে ‘সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স’ বা, সোজা কথায়, পরোক্ষ প্রমাণের ওপর। প্রত্যক্ষ প্রমাণ মিলবে, যদি তা দেখা যায় দূরবিনে। এত দূরে তার অবস্থান যে, তা থেকে সূর্যের প্রতিফলিত আলো পৃথিবীর দূরবিনে ধরা কঠিন। তুলনা টেনে ব্যাটিগিন বলেছেন, ‘নবম গ্রহ দেখা মানে পৃথিবীতে বসে চাঁদে একটা লাইট বাল্ব খুঁজে পাওয়া। তবে, কোথায় সেই গ্রহ থাকতে পারে, তা আমরা গণনা করেছি। খোঁজার কাজ এতে ত্বরান্বিত হবে আশা করি।’ ব্রাউনও আশাবাদী। ভূপৃষ্ঠে বসানো বা মহাশূন্যে পাঠানো দূরবিনগুলোর কোনওটা থেকে নিশ্চয়ই শিগগির দেখা যাবে নবম গ্রহ। ব্রাউন অবশ্য চান নবম গ্রহের সন্ধানে উপগ্রহ পাঠাতে। বলেছেন, ‘দাবিটা আকাশকুসুম নয়।’ ওঁর মত সমর্থন করেছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্রেগ লঘলিন। বলেছেন, ‘নক্ষত্রেরা অনেক দূরে। ওখানে তো যাওয়া যাবে না। সূর্যের দূরতম গ্রহ অভিযানে গেলে মন্দ কী!’