যখন থিম গড়ি

আমি জন্মেছি তমলুকের একটা গ্রামে। একেবারে অজ পাড়াগাঁ। পিছিয়ে পড়া এলাকা। কিন্তু আমার গরিব ঘরকে কখনওই আমার অভাবের সংসার বলে মনে হয়নি। বরং সেখানেই আমি পেয়েছি সাত রাজার ধন। আমার মাটির বাড়িতে যে বিরাট জানলা ছিল, তা দিয়ে অনেক দূরের আলখেত, ধেনো জমি দেখা যেত।

Advertisement

গৌরাঙ্গ কুইল্যা

শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
Share:

এ বছরের ত্রিধারা। ছবি সৌজন্য: শুভদীপ মণ্ডল অধিকারী

আমি জন্মেছি তমলুকের একটা গ্রামে। একেবারে অজ পাড়াগাঁ। পিছিয়ে পড়া এলাকা। কিন্তু আমার গরিব ঘরকে কখনওই আমার অভাবের সংসার বলে মনে হয়নি। বরং সেখানেই আমি পেয়েছি সাত রাজার ধন। আমার মাটির বাড়িতে যে বিরাট জানলা ছিল, তা দিয়ে অনেক দূরের আলখেত, ধেনো জমি দেখা যেত। দেখা যেত পুকুরধারের ঝুপসি গাছের নীচে ভাঙাচোরা কুঁড়েঘর। একান্নবর্তী পরিবার ছিল আমাদের। সারা দিন খাটাখাটনির শেষে, বাড়ি ফিরে সবাই মিলে যখন নিকানো মাটিতে বসে তৃপ্তি ভরে খাবার খেতাম, দরজার বাইরে অনেকখানি আকাশে লক্ষ লক্ষ তারা জ্বলত। সেটাকেই আমার মনে হত সত্যিকারের উৎসব!

Advertisement

খুব অল্প বয়সে কাজ করতে শুরু করেছিলাম। সাইনবোর্ডে লিখতাম, সিনেমার হোর্ডিং আঁকতাম। তখন থেকেই যেটাই করতাম, লোকের চোখে পড়ত। খুব উৎসাহ পেতাম সে সব প্রশংসায়। এক দিন সুযোগ পেলাম পুজোয় কাজ করার। তমলুকের বড় উৎসব হল কালীপুজো। সেটায় আমি এক বার থার্মোকল দিয়ে মণ্ডপ গড়লাম। প্যান্ডালটা নজর কাড়ল, খুব শোরগোল হল। এর পরই আমি টাটায় বড় পুজো করতে গেলাম। আট লক্ষ টাকা বাজেটের পুজো! এমন অনেক ক’টা বিরাট পুজোয় নানা ধরনের কাজ করেছি। একশো ফুট উঁচু প্যান্ডাল! এই সব কাজের গোটা দায়িত্বটা ছিল আমার কাঁধে। তার ছক কষা, মাপ নেওয়া থেকে প্যান্ডালের কাঠামো দাঁড় করানো— সব কিছু! এর পরই কলকাতা থেকে ডাক আসে।

২০০১ সালের পুজোয় কলকাতায় দুটো কাজ করি আমি। বাবুবাগানের জুট-এর প্যান্ডাল, আর কসবা বোসপুকুর শীতলা মন্দিরের ভাঁড়ের মণ্ডপ। দুটোই সে বার সুপারহিট হল! সেই সময় ‘এশিয়ান পেন্টস শারদসম্মান’-এর ভীষণ জাঁক। সেই প্রাইজ পেলাম আমরা। কসবার প্যান্ডাল দেখতে এত মানুষ এলেন, লাইন চলে গেল এক দিকে বালিগঞ্জ, অন্য দিকে বাইপাস। কিন্তু সে বার থিম-শিল্পী হিসাবে আমার নাম যায়নি। এই দুটো পুজোতেই আমি কাজ করেছিলাম বন্দন রাহা-র সঙ্গে। ব্যানার-পোস্টারে নাম ছিল তাঁর। তাতে অবশ্য আমার কোনও আক্ষেপ নেই। কারণ তখন আমি নতুন। আমাকে কলকাতায় নিয়ে এসে খ্যাতির রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছিলেন তিনিই।

Advertisement

এ বার এই কাজ দেখে, বাবুবাগানের কমিটির কাছে, ডিসি (ডেভেলপমেন্ট কমিশনার) হ্যান্ডিক্রাফটস-এর এক অফিসার একটি চিরকুট রেখে যান। তাতে ফোন নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছিল। সেই নম্বরে ফোন করতেই অফিসে ডেকে পাঠালেন তাঁরা। বললেন, এত ভাল কাজ করেন আপনি, দিল্লির ন্যাশনাল কম্পিটিশনে যাচ্ছেন না কেন? আপনি পুরস্কার জিতলে তো বাংলারই সম্মান বাড়বে। ওঁদের কথা শুনে, আমি প্রতিযোগিতার জন্য তৈরি হতে শুরু করলাম। প্রচুর মাথা ঘামিয়ে, খেটেখুটে, শুকনো পাতা ও পাট মিলিয়ে একটা আর্টওয়ার্ক বানালাম। কিন্তু কাজটা নিয়ে যখন আমি প্রতিযোগিতায় নাম দিতে গেলাম, আশ্চর্য ব্যাপার, কেউ মানতেই চাইল না যে ওটা আমি বানিয়েছি! প্রমাণ চাইল, ওটা আমার কাজ। আমি তো থ! আমার সৃষ্টি যে আমারই, এর আবার কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ হয় নাকি? আপনমনে যখন কাজ করছি, তখন কি প্রতিটি ধাপের ভিডিয়ো রেকর্ডিং করে রাখতে হবে, নাকি কোনও কেউকেটা মানুষকে সকাল সন্ধে এসে অ্যাটেস্ট করে সার্টিফিকেটে সই করে করে যেতে হবে? কিন্তু যতই বোঝাই, ভবি ভোলার নয়। তাই অনেক মানুষের অনেক সাহায্য সত্ত্বেও সে বার দিল্লি গিয়েও ফিরে আসতে হল আমাকে। পরের বছরই আমি নামলাম আটঘাট বেঁধে এবং রাষ্ট্রপতির পুরস্কার জিতলাম।

তার পর থেকেই পুজোর সময় এগিয়ে এলে, নাওয়া-খাওয়া তো দূর, চোখের দু’পাতা এক করারও সময় পাই না। একই বছরে এক সঙ্গে পাঁচটা মেগা-পুজো সামলেছি, এমন নজিরও আছে। এ বারেও চারটে পুজোর ভাবনা-পরিকল্পনা-সৃজনে ছিলাম আমি। ভবানীপুর অবসর-এ করলাম: পরির দেশ। ত্রিধারা-য় থিম ছিল: লক্ষ্য যখন শিকারি। হরিদেবপুর ৪১ পল্লিতে বিষয় ছিল: সংসার মায়াজালে। ইলেকট্রিসিটি এসে আমাদের সমাজকে বদলে দেওয়ার আগে, আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল যারা, তাদের প্রতি ‘ট্রিবিউট’ ছিল এই পুজো। যেমন হাতপাখা, রুমাল, হ্যারিকেন, মেঝেতে বসে খাওয়া, লুডো খেলা— এই সব আর কী। বড়িশা ক্লাবের বিষয় ছিল: মহাজাগতিক। পৃথিবী প্রকৃতি ও ভূমিকে ব্রহ্মা বিষ্ণু ও মহেশ্বর রূপে উপস্থাপন করে, দেখালাম, আমাদের দুনিয়াটা বাইরে থেকে ভারী সুন্দর দেখতে, কিন্তু অন্তরে তার সবই ছারখার হয়ে গিয়েছে। এমন দুঃসময়ে মা আসছেন। তাঁর কাছ থেকে একটু পজিটিভ এনার্জি সংগ্রহ করাই হোক আমাদের লক্ষ্য।

চারটে বিষয় চার রকমের। কিন্তু আমার কাছে সব থিমেরই প্রাণকেন্দ্র এক। একটু আনন্দ, একটু ভাল লাগা। আমি বলি, ‘ইতিহাস-ভূগোল নয়, জীবনযন্ত্রণার গল্প প্রতিটি সংসারেই রয়, উৎসব হোক শুধুই আনন্দময়।’ মানুষ তো সংসারের একশো রকম জটিলতা আর জীবনের যন্ত্রণা থেকে একটু রেহাই পেতেই উৎসবে মেতে ওঠে। তাই পুজোর সময় মানুষকে আতঙ্ক, যুদ্ধ, দীনতা দেখাতে ইচ্ছা হয় না।

পুজোর সময় মানুষকে যে আনন্দ আমি দিই, গোটা বছর ধরে তার রসদ একটু একটু করে সংগ্রহ করে রাখি। প্রতি দিন গাড়ি করে যাওয়া-আসার পথে অনেকটা সময় শুধু বসে থাকতে হয় আমাকে। চারপাশের রাস্তা-বাড়ি-প্রকৃতি দেখতে দেখতে এসে ভাবনা আসে আমার মাথায়।

পুজোর ঠিক সাড়ে তিন মাস আগে থেকে মাঠে নেমে যাই আমরা। প্রথমে থিম ভাবা হয়, তার পর এক্সপেরিমেন্ট শুরু করি। প্রথমে ছোট করে একটা মডেল বানিয়ে দেখি।

কেমন দেখাবে, কত সময় লাগবে, কোন কোন মেটেরিয়াল সংগ্রহ করতে হবে— বুঝে নিই। আমার সংস্থার ছেলেদের নিয়ে ওয়ার্কশপ হয়। তার পর তাদের টিমে ভাগ করে দিই। প্রতিটা পুজোর জন্য আলাদা টিম। সেই টিমের প্রতিটি ছেলে আমার হাতে গড়া, তারা অসম্ভব করিৎকর্মা। প্রত্যেকে জুতো-সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, সব জানে। যে বাঁশ বাঁধে, সে-ই ওয়েল্ডিং করে, সে-ই আবার ঠাকুরও রং করে। সবাই দেখে অবাক হয়ে যায়। যে পাড়ায় ঠাকুর হচ্ছে, সেখানেই তাঁবু বেঁধে বা ক্লাবঘরে থেকে যায় টিমের ছেলেরা। ওখানেই রান্না করে খাওয়া, ওখানেই শোওয়া। এ ভাবে হইচই করে কাজ করে ওরা। তবে প্রতিমা গড়ি আমি নিজে।

একটু-আধটু মুশকিল হয়ই। বর্ষা এসে বাগড়া দেয়। প্রতি বার অবসরের মণ্ডপের মধ্যে জল জমে যায়। তার মধ্যেই মাচা বেঁধে কাজ চলে। নীচে জল জমে আছে, তার ওপরে চলেছে ঠাকুর গড়া।

আমার একটা অদ্ভুত অভ্যাস আছে। আমি উদ্যোক্তাদের কখনও থিম বলি না। যাঁরা আমাকে ডাকেন, তাঁরা প্রত্যেকে এই স্বভাবটির সঙ্গে পরিচিত। তাই, তাঁরা জিজ্ঞাসাও করেন না কী করছি। কোনও কৌতূহল দেখান না। এ নিয়ে অনেক মজার কাণ্ডও হয়েছে। এ বারে ত্রিধারায়, নিশ্চয়ই দেখেছেন, মণ্ডপটা অনেকটা শিকারির বাড়ির মতো দেখতে ছিল। কী করে লুক-টা দেব, বিস্তর চিন্তা করতে হয়েছে। শিকারির ঘরের দেওয়ালে পশুর কাটা মুন্ডু আটকানো থাকে। তিব্বতে গেলে ধর্মীয় মন্দিরে দেখেছি, জন্তুর খুলি তো বটেই, মোষের নাড়িভুঁড়ি পর্যন্ত শুকনো করে ঝোলানো থাকে। কিন্তু কলকাতায় সে সব হাড়গোড় পাব কোত্থেকে!

প্রথমে যোগাযোগ করলাম শবর জনজাতির সঙ্গে। ওঁরা এক মাসে আমাকে চারটের মতো খুলি এনে দিলেন। আমার কপালে ভাঁজ বাড়ল। লাগবে তো একশোটা। সময় কমে আসছে। কী করি! শেষে চলে গেলাম উলুবেড়িয়ার পশু-গোরস্থানে। হাড় ছড়িয়ে, উঁচু উঁচু ঢিবি। মাটিতে আঁশটে গন্ধ। ওই পরিবেশে একটু ভয়-ভয়ও লাগতে শুরু করল আমার। তবু, বহু চেষ্টাচরিত্রের পর জোগাড় করা গেল কিছু হাড়গোড়। কিছু এল বাংলাদেশ থেকে। গুজরাত থেকে এল লম্বা লম্বা শিং। কারণ, ওখানকার গবাদি পশুর ওই ধরনের শিং দেখা যায়। তার পর, এক দিন, ত্রিধারা পুজো কমিটির দেবাশিস কুমারকে বললাম, কেমন কাজ হচ্ছে একটু দেখুন। মোবাইলে ছবি দেখালাম। উনি খুব খুশি। বললেন, এগুলো ফাইবারের তৈরি, তাই না? একেবারে অরিজিনালের মতো দেখাচ্ছে। আমি বললাম, আরে অরিজিনালই তো। উনি ভেবেছেন, ঠাট্টা করছি। বিশ্বাসই করছিলেন না গোড়ায়। তার পর সব শুনে, ওঁর চোখ কপালে।

ওপনিংয়ের পর পর দেখি অবসর আর ত্রিধারা’য় হাড্ডাহাড্ডি লড়াই লেগে গেছে। অবসরের পরির দেশ দেখে ত্রিধারার লোকেরা বলেছেন, আরে এটা তো আমাদের থেকেও ভাল। অবসরের লোকজন মানতে নারাজ। কোথায়? তোমাদেরটা অনেক ভাল। আমাকেই এক জন বিচার করতে অনুরোধ করলেন। বললাম, কী করে তুলনা করি! একটা যদি ক্ষীরের পায়েস তো অন্যটা মাটন কষা।

পুজোর দিনগুলোয় ভিড়ে উপচে পড়ছিল রাস্তা। মানুষ ঠাকুর দেখছিল। আমি মণ্ডপের ধারে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম মানুষ। তাঁদের মুখের অভিব্যক্তি। ওটাই যে আমার দুর্গাপুজোর পুষ্পাঞ্জলি।

goldenmemorykolkata@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন