সম্রাজ্ঞী হলেন ভিক্টোরিয়া

কাগজের সমালোচনা, টিটকিরি কিছুই গায়ে মাখলেন না তিনি। ভারত তাঁর কাছে স্বপ্নের দেশ। অশ্বঘোষ কাগজের সমালোচনা, টিটকিরি কিছুই গায়ে মাখলেন না তিনি। ভারত তাঁর কাছে স্বপ্নের দেশ। অশ্বঘোষ

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share:

দিল্লি দরবার: ১৯০৩। ভিক্টোরিয়া তখন আর নেই। ছবি: গেটি ইমেজেস

প য়লা জানুয়ারি মানেই কি চিড়িয়াখানা, পিকনিক আর হুল্লোড়? ভারতে এই দিনের সবচেয়ে জম্পেশ উৎসবটি ঘটেছিল দিল্লি শহরে। নিজেকে সে দিন ‘ভারতসম্রাজ্ঞী’র মুকুটে ভূষিত করলেন ভিক্টোরিয়া। ১ জানুয়ারি, ১৮৭৭।

Advertisement

মহারানি সে দিন ভারতে নেই। তবু দিল্লি, বোম্বাই থেকে রাজধানী কলকাতা, সর্বত্র সকাল থেকে সাজো সাজো রব। একদা মুঘল রাজধানী দিল্লিতে তত ক্ষণে তৈরি হয়ে গিয়েছে রাজকীয় তাঁবুর শহর। বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ছোট-বড় ৬৩ জন রাজা তাঁদের মন্ত্রী, সেনাপতিদের নিয়ে ঢুকে এসেছেন প্রধান তাঁবুতে। জায়গায় জায়গায় সুসজ্জিত হাতি, ঘোড়া, পালকি।

তাঁবুর মাঝখানে মঞ্চ, সেখানে বড়লাটের জন্য সিংহাসন। আশেপাশে ১৫ হাজার সৈন্য বন্দুক উঁচিয়ে অ্যাটেনশন-এর ভঙ্গিতে। দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ তাঁবুতে ঢুকে এলেন বড়লাট লর্ড লিটন। সিংহাসনে গিয়ে বসলেন তিনি, উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছে তাঁবুর জনতা।

Advertisement

মঞ্চে উঠে এলেন ১০ নম্বর বেঙ্গল ল্যান্সার বাহিনির মেজর অসমন্ড বার্নস। সিপাহি বিদ্রোহের সময় থেকে এই দেশে আছেন, আজকের অনুষ্ঠানে তিনিই প্রধান ঘোষক। বার্নস পড়ে শোনালেন পুরো ঘোষণা ও নতুন সম্রাজ্ঞীর বার্তা: এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমরা ও আমাদের ভারতীয় প্রজারা আরও দৃঢ় বন্ধনে বাঁধা পড়ব। ওপর থেকে নিচু তলার মানুষ সবাই জানুক, আমাদের শাসনে তাদের সাম্য, মৈত্রী ও ন্যায়বিচার অটুট থাকবে।

এর পর ভাষণ দিলেন বড়লাট। তার পরই সম্রাজ্ঞীর উদ্দেশে ১০১টি গান স্যালুট। বিউগল আর ট্রাম্পেটে বেজে উঠল জাতীয় সঙ্গীত— গড সেভ দ্য কুইন।

উচ্ছ্বাস দেশের সর্বত্র। কলকাতা ময়দানেও সেই দুপুরে বসেছে দরবার। ঘোষণা পড়ে শোনানোর পর সেনাদের মার্চ পাস্ট, জাতীয় সঙ্গীত। সম্মানিত করা হল ৬১ জন ‘নেটিভ জেন্টলম্যান’কে। সৎ পথে ফেরার সুযোগ দিয়ে বোম্বেতে এ দিনই জেলখানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হল কিছু অপরাধীকে।

মাদ্রাজে টাউন হলের সিঁড়িতেও তখন পড়ে শোনানো হচ্ছে সেই ঘোষণাপত্র। পয়লা জানুয়ারিতে কখনও সারা ভারত একযোগে একটি ঘোষণা নিয়ে এই ভাবে মাতেনি।

সম্রাজ্ঞীর প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল এক বছর আগে থেকেই। ১৮৭৬ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডিজরেলির উদ্যোগে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হল ‘রয়্যাল টাইট্‌লস অ্যাক্ট’। একদা ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি প্রথম ‘হিজ ম্যাজেস্টি’ খেতাব নিয়েছিলেন। তাঁর উত্তরসূরি ভিক্টোরিয়া এ বার থেকে শুধু ‘হার হাইনেস’ নন, পুরোদস্তুর সম্রাজ্ঞী।

তার দুই বছর আগে, ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশ সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য করেছে। কোম্পানি যে ভাবে সিপাহি বিদ্রোহের মোকাবিলা করেছিল, ভারতীয় সিপাই এবং ইংরেজ সেনা, দুই পক্ষের নিষ্ঠুরতাতেই শিউরে উঠেছিলেন রানি। ভিক্টোরিয়া তখন বড়লাট ক্যানিংকে চিঠিতে জানাচ্ছেন, ভারতীয়দের প্রতি যেন অহেতুক ঘৃণার অত্যাচার না হয়। ‘দেয়ার শুড বি নো হেট্রেড টু ব্রাউন স্কিন।’

দুই দশক আগে বিদ্রোহী সিপাইদের ক্ষমা করার জন্যও তো পয়লা জানুয়ারিকেই বেছে নিয়েছিলেন রানি। বছরের প্রথম দিনের মধ্যে যে বিদ্রোহীরা অপরাধ স্বীকার করবে, তাদের অপরাধ মাফ। ১৮৫৭ এবং সিপাহি বিদ্রোহ পড়ে থাকুক অতীতের গহ্বরে, ১৮৫৮ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে শুরু হোক নতুন দিন। ১৮৫৭ সালের নভেম্বর মাসেই সে কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন ভিক্টোরিয়া। তখনকার বাংলা কাগজ ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় রানির ঘোষণা: ‘যে সকল লোক গবর্নমেন্টের বিপক্ষ হইয়া অস্ত্রধারণ করিয়াছে, যদি তাহারা আপন আপন গৃহে প্রত্যাগমন করিয়া স্ব স্ব বৈষয়িক ব্যাপারে প্রবৃত্ত হয়… অপরাধ একেবারে মার্জ্জনা করা যাইবেক।’

এ দেশে পা রাখেননি, কিন্তু ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এ রকমই। তা ছাড়া রাশিয়ার জার বা প্রুশিয়ার রাজা, ফ্রান্সের রাজা যদি নিজেকে ‘সম্রাট’ বলতে পারেন, তিনিই বা পিছিয়ে থাকবেন কেন? ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না ঠিকই, কিন্তু নিজেকে অস্ট্রেলিয়ার সম্রাজ্ঞী বললে পুরো ব্যাপারটা খেলো হয়ে যায় না?

একটা ছোট্ট দ্বীপের রানি, তিনি হবেন সাত সমুদ্র পারের সম্রাজ্ঞী! আর ভারত দেশটা? তন্ত্রমন্ত্র, জাদু, উদ্ভট পাগড়ি মাথায় মহারাজা, বাঘ আর হাতিতে ভর্তি। ইংল্যান্ডের কাগজে তখন ঠাট্টা: ‘এমপ্রেস অব ইন্ডিয়া কি রানির নাম হতে পারে? ওই নামে বরং একটি স্টিম ইঞ্জিন আনা হোক।’

কিন্তু ভিক্টোরিয়া ‘ভারতসম্রাজ্ঞী’র মুকুট ধারণে আত্মবিশ্বাসী। উইন্ডসর ক্যাসল-এ ভোজ, কয়েক জন বিদেশি রাষ্ট্রদূত। ভিক্টোরিয়া তাঁদের সামনেই প্রধানমন্ত্রী ডিজরেলিকে বকুনি দিতে শুরু করলেন, ‘ডিউক অব আরগাইল অতি বদ, কিচ্ছু খেয়াল রাখো না।’ তোড়ে বকুনি দিচ্ছেন রানি, প্রধানমন্ত্রী নীরব। ডিউক আবার সম্পর্কে রানির বেয়াই। ‘ভারতসম্রাজ্ঞী’ খেতাব নিয়ে এক দিন হাসাহাসি করছিলেন, রানির কানে খবরটা পৌঁছে গিয়েছে।

সংবাদমাধ্যমকেও ছাড়েননি। তখনকার ‘টাইম্স’ পত্রিকায় এক কলমচি লিখেছিলেন, ছোট্ট দ্বীপের রানি যদি সম্রাজ্ঞী হন, আরাকানের রাজাদেরও সম্রাট বলতে ক্ষতি কী? ভিক্টোরিয়া পালটা বললেন, ‘জনগণ আমার এই সম্রাজ্ঞী খেতাবের বিরুদ্ধে নয়। শুধু প্রেসের লোকগুলোরই যত জ্বালা!’ ইংল্যান্ডে ১৮৭৬ সালের ২৮ এপ্রিল ভারতসম্রাজ্ঞীর খেতাব নিলেন তিনি।

কিন্তু এটি সরকারি ঘোষণামাত্র। সম্রাজ্ঞী খেতাবের পর লন্ডনে অনেকে হাসে, ‘আয়ার্ল্যান্ডটা আর বাকি কেন? বাকিংহামের রানি এখন আয়ার্ল্যান্ডেরও সম্রাজ্ঞী।’ উৎসব তাই করতে হবে ভারতেই।

তার পরই ১ জানুয়ারি, ১৮৭৭। ভারতসম্রাজ্ঞী হলেন ভিক্টোরিয়া। কয়েক প্রজন্ম পর বাংলার গ্রামে অত্যাচারিত চাষির মুখেও সাহস জোগাবেন তিনি। শরৎচন্দ্রের গল্পের গফুর জমিদারের পেয়াদাকে সটান শুনিয়ে দেবে, ‘মহারানির রাজত্বে কেউ কারও গোলাম নয়।’

জানুয়ারির প্রথম দিনেই শুরু হয়েছিল মহারানির সেই রাজত্ব!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন