আশির দশকের শেষ দিকের পঞ্চায়েত নির্বাচন। রাজ্য সচিবালয়ের কনিষ্ঠ কেরানি হিসেবে ‘ফার্স্ট পোলিং অফিসার’ নিযুক্ত হয়ে আহ্লাদে ষোলোআনা। ‘প্রিসাইডিং অফিসার’ আয়কর পরিদর্শক, বয়স্ক মানুষ। আমায় দেখে নাক কুঁচকে মুখে বার দুয়েক চুকচুক শব্দ করে বললেন, হ্যারা আর লোক পাইল না, এই ছ্যামড়াডারে দিছে আমার লগে!
প্রথম ট্রেনিং-এর পর ভদ্রলোক কিঞ্চিৎ প্রসন্ন হয়ে নিজের টিফিন থেকে ভাগ দিলেন। ভোটের আগের দিন কাঁধে এক ঢাউস ব্যাগ নিয়ে দেগঙ্গা ডিসিআরসি-তে হাজির হলাম। বুথে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সন্ধে। প্রাইমারি স্কুলে বুথ। ঘরের কোণে এক কাঁদি ডাব রাখা ছিল। আমরা থিতু হওয়ার আগেই এক জন অচেনা মানুষ সবার হাতে একটা করে ডাব কেটে ধরিয়ে দিলেন। ছাতিফাটা তেষ্টা মেটাতে কেউ কেউ দুটো-তিনটে করে ডাব খেয়ে ফেললেন। দাম দেওয়ার প্রসঙ্গ উঠতেই ভদ্রলোক আধ হাত জিভ বের করে বললেন— আপনারা গ্রামের অতিথি। সামান্য ডাবের জন্যে আবার দাম! ছি!
কিছু ক্ষণ পরে রাজনৈতিক দলের পোলিং এজেন্টরা এলেন দেখা করতে। অজ পাড়াগাঁ। আশেপাশে কোনও খাবারের হোটেল নেই। প্রতিদ্বন্দ্বী উভয় পক্ষ তাই একসঙ্গে রাতে খাওয়ার নেমন্তন্ন করলেন। প্রিসাইডিং অফিসারকে একটু দ্বিধান্বিত দেখে দু’পক্ষই আশ্বাস দিলেন, খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে কাছেই এক অরাজনৈতিক ব্যক্তির বাড়িতে। চিন্তার কোনও কারণ নেই।
স্কুলে আলো-পাখার বালাই নেই। সরকারি হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোয় নানা রকম খাম লিখতে আর ফর্ম ফিল-আপ করতে সকলে গলদঘর্ম। এর উপর আবার তিন প্রস্থ ব্যালট পেপারের পিছনে প্রিসাইডিং অফিসারের অটোগ্রাফ! রাত এগারোটা নাগাদ খাওয়ার ডাক এল। খাওয়ার আয়োজন দেখে তো সকলে তাজ্জব! আমরা যেন ঠিক শ্বশুরবাড়িতে আসা নতুন জামাই!
পর দিন নির্দিষ্ট সময়ে ভোট শুরু হল এবং শেষও হল নির্বিঘ্নে। সুশৃঙ্খল ভাবে ভোট দিলেন সবাই। গ্রামের লোকেরাই আমাদের সকালের জলখাবার থেকে শুরু করে দুপুরের খাবার, এমনকী সান্ধ্য জলযোগ জুগিয়ে গেলেন। তেষ্টা পেলেই মুখের সামনে কচি ডাব। পোলিং এজেন্টদের দেখে বোঝার উপায় নেই যে তাঁরা বিরোধী। নিজেদের মধ্যে হাসি-মশকরা থেকে খাবার ভাগাভাগি— সবেতেই নির্দ্বিধায় শামিল উভয় পক্ষ।
ভোটের শেষে বুথেই গ্রাম পঞ্চায়েতের ব্যালট গণনা। বিজয়ী প্রার্থীকে সার্টিফিকেট দিয়ে সব কিছু বাঁধাছাদা করে বেরোতে বেরোতে রাত প্রায় বারোটা। বিদায়বেলায় দেড় দিনের ভূরিভোজের দাম দেওয়ার প্রসঙ্গ তুলতেই আবার আধ হাত জিভ বের করা পুরনো সংলাপ— আপনারা তো গ্রামের অতিথি। সামান্য দুটি ভাতের আবার দাম! ছি!
দশ বছর বাদে, নব্বইয়ের শেষাশেষি, আবার পঞ্চায়েত নির্বাচনের ডিউটি। এ বার আমি প্রিসাইডিং অফিসার।
হুগলির ধনেখালি ব্লকের ডিসিআরসি থেকে একই ভাবে মালপত্র বুঝে নিয়ে ভোটের আগের দিন বাসে চড়ে বিকেল-বিকেল বুথে পৌঁছনো গেল। চাঁদিফাটা গরমে প্রাণ আইঢাই অবস্থা। একটা পরিত্যক্ত প্রাইমারি স্কুলে বুথ। প্রায় ঘাড়ের উপর নেমে আসা টিনের চাল। অসমান মাটির মেঝেতে সর্বত্র ইঁদুরের গর্ত। জানালাহীন দেয়ালে হাঁ-করা বড় বড় ফাটল। সন্ধে নাগাদ শাসক দলের এক নেতা এলেন দেখা করতে। নিজেই জানালেন, তিনি স্থানীয় স্কুলের পদার্থবিদ্যার শিক্ষক এবং পঞ্চায়েত সমিতির বিদায়ী সদস্য। সঙ্গের দুজন লোককে দেখিয়ে বললেন, এরা বুথে আলো-পাখা এবং আপনাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে বললাম, কিন্তু রাজনৈতিক দলের সাহায্য কিংবা আতিথ্য নিলে যদি... আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই কেমন রুক্ষ স্বরে ভদ্রলোক বললেন— ধুস্ মশাই, পয়সা দেবেন, খাবেন। এর মধ্যে আবার ও সব আতিথ্য-ফাতিথ্য আসছে কোত্থেকে? ওদের সঙ্গে কথা বলে নিন।
অগত্যা ভদ্রলোকের সামনেই শুরু হল দরদস্তুর। রাস্তার লাইন থেকে হুক করে দুটো চল্লিশ ওয়াটের বাল্ব আর দুখানা পাখা লাগানোর জন্যে যে দর হাঁকা হল, ঠিক সেই টাকাটাই কন্টিনজেন্সি হিসেবে পোলিং পার্টিকে দেওয়া হয়েছে। খাওয়াদাওয়ারও দাম চাওয়া হল আকাশছোঁয়া!
ভদ্রলোক বললেন— আপনারা মাস গেলে মাইনে পাবেন, ভোটের জন্য বাড়তি টাকা পেয়েছেন, খরচা তো করতেই হবে! সব টাকা কি বাড়ি নিয়ে যাবেন ভেবেছেন?
হক কথা! তবু ভদ্রলোকের হুমকিতে কেমন যেন জেদ চেপে গেল। টিমের সকলের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক হল, আলো-পাখা লাগানোর দরকার নেই। শুধু ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য সবচেয়ে সস্তা ডিমের ঝোল ভাত দিয়ে চালিয়ে নেওয়া হবে। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গজগজ করতে করতে বিদায় নিলেন পদার্থবিদ।
যথাসময়ে শুরু হল ভোট। কিন্তু প্রথম থেকে সব ব্যাপারেই পোলিং এজেন্টদের মধ্যে প্রবল মতানৈক্য। যত সময় গড়াতে লাগল, পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করল। হুমকি, পালটা-হুমকিতে বুথ সরগরম। একটু বেলা বাড়তেই দেখা দিল নতুন সমস্যা। মাথার উপর টিনের চাল তেতে আগুন। আমরা দাঁতে দাঁত চেপে গরম সহ্য করলেও এজেন্টরা বিরূপ। হন্তদন্ত হয়ে এলেন সেই শিক্ষক ভদ্রলোক। আমাদের প্রতি অগ্নিদৃষ্টি এবং অভিধান-বহির্ভূত কুটুম্ব সম্ভাষণ বর্ষণ করতে করতে নিজেই আলো-পাখা লাগাবার হুকুম দিলেন।
বিস্তর বাগ্বিতণ্ডার মধ্য দিয়ে এক সময় ভোটদানের সময়সীমা শেষ হল। এজেন্টদের আদেশে সামান্য জিরিয়ে নেওয়ার পালা, তার পর গ্রাম পঞ্চায়েতের ভোট গণনা। বাইরে হঠাৎ দমাদ্দম আওয়াজ শুরু হল। ‘পেটো পড়ছে, পেটো পড়ছে’ বলতে বলতে লোকজন দুদ্দাড় ছোটাছুটি শুরু করল। বুথের মধ্যে আমরা ভয়ে জড়সড়। একমাত্র বৃদ্ধ কনস্টেবলের ভরসায় আমরা কয়েক জন নিরীহ গণতন্ত্রের সেপাই ব্যালটবাক্স আগলে বসে রইলাম।
বাইরেটা এক সময়ে শান্ত হয়ে এল। ফিরে এলেন একমাত্র শাসক দলের পোলিং এজেন্ট। বিরোধী দলের এজেন্টের জন্যে দীর্ঘ ক্ষণ অপেক্ষার পরেও তিনি ফিরে না আসায়, তাঁর অনুপস্থিতিতেই গণনা শুরু করতে হল। শেষ হতে হতে সকাল হয়ে গেল। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত শরীরে সমস্ত কাগজপত্র, বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে বাসে উঠতে যাব, এমন সময় আবার উদয় হলেন সেই শিক্ষক ভদ্রলোক। আলো-পাখার ভাড়ার দাবিতে বাসের দরজা আটকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বুথে আলো-পাখা যে তাঁর হুকুমে লাগানো হয়েছিল, এ কথা মনে করিয়ে দিতেই শুরু হল অকথ্য গালিগালাজ। আস্তে আস্তে ওঁর স্যাঙাতরা লাঠিসোটা নিয়ে জড়ো হতে শুরু করল।
অগত্যা, চাহিদামত টাকা মিটিয়ে তবে সে যাত্রায় নিস্তার।