ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।
দোতলার ব্যালকনিতে বসে আছে টুকু। গায়ে মিষ্টি রোদ। বাবা, মা অফিসে। ভাই রূপম স্কুলে। টুকুর সারা দিনের খাবার ডাইনিং টেবিলে ঢেকে রাখা আছে। অন্য দিন বেলাপিসি সঙ্গে থাকে। টুকু আজ একা। অবশ্য সবাই থাকলেও ও একা। আগে ব্যালকনিতে বসলেই দেখা যেত কত রকমের পাখি। এ দিক ও দিক উড়ত। কত রকমের ডাক। সামনে ছোট রাস্তা। ও পারে একটা পুকুর ছিল। মাছরাঙা, পানকৌড়ি আসত। কত লোক স্নান করত। কাপড় কাচত। গাছের তলায় বসে তাস খেলত কিছু লোক। দেখতে দেখতে সব কেমন যেন পালটে গেল। পুকুর বুজিয়ে উঠেছে বহুতল। চার পাশের গাছগুলোও আর নেই। পাখিরাও আর আসে না।
এ বাড়িতে টুকুুর একমাত্র বন্ধু, তার বাড়ির উঠোনের কদমগাছ। টুকুুর একান্ত আপন ‘বন্ধুগাছ’। কদম ফুল উঠোন নোংরা করে। বাবা গাছটা কেটে ফেলতে চেয়েছিল। টুকুর সে কী কান্না! মা শেষ পর্যন্ত গাছটা কাটতে দেয়নি। টুকুু জানে গাছেরও দুঃখ হয়, আনন্দ হয়। তাই তো টুকুুর ঘরের জানলার ধার ঘেঁষে ফুটে থাকে কদম ফুল। দিনের আলোয় সবাই যখন কাজে ব্যস্ত, বন্ধুগাছ টুকুুকে গল্প শোনায়। এক অদ্ভুত ভবিষ্যতের গল্প। বিশ্বাস হয় না টুকুুর। তবে শুনতে ভাল লাগে। সব মানুষ নাকি পালটে যাবে। বদলে যাবে জীবনযাত্রা। টুকুুর মতোই সব মানুষ হুইল চেয়ারে বসে থাকবে। আর তাদের হাতে থাকবে রিমোট কন্ট্রোল। বেলাপিসি হয়ে যাবে রোবট। রিমোটের বোতাম টিপলেই, রোবটই সব কাজ করে দেবে। মানুষের আর কাজই থাকবে না। মানুষ তখন হবে অন্য রকম। বেঁটে আর মোটা। হাত পায়ের আঙুলের মাঝে ফাঁক থাকবে না। জোড়া লেগে যাবে। ঘরের মধ্যে থাকবে গাছ। ছোট ছোট বনসাই-এর মতো। ওদের দিকে তাকিয়ে মানুষ গল্প করবে। ফেলে আসা বৃক্ষস্মৃতি। সবুজ জীবনের রূপকথা। সব মানুষ হয়ে উঠবে একা। ভীষণ একা। গতিহীন সুদীর্ঘ দিন যেন আর কাটতেই চাইবে না। মানুষ থেকে যন্ত্র, আবার যন্ত্র থেকে মানুষ হতে চাইবে সবাই।
হঠাৎই কানে এল কা-কা শব্দ। উফ্ অসহ্য। কুৎসিত কালো। যেমন দেখতে তেমনই তার ডাক। কর্কশ গলায় চেঁচাচ্ছে কাকটা। মুখে নোংরা খাবার। কদম গাছের ডালে এসে বসেছে। এরা নাকি ঝাড়ুদার পাখি? পরিবেশ যত না পরিষ্কার করে, নোংরা করে বেশি। বন্ধুগাছের সবুজ পাতারা দুলছে। যেন হাত নেড়ে ডাকছে টুকুুকে। তবে কী নতুন কোনও গল্প শোনাবে বন্ধুগাছ? চোখ দুটো বুজে এল টুকুর।
জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল টুকু। এখন বিকেল। অনেক নীচে ছোট ছোট মানুষ। ওদের মধ্যে যেন হঠাৎ-ব্যস্ততা। পাশের সুবিশাল বহুতলগুলিতে সবাই জানলা দরজা বন্ধ করছে। পড়ার টেবিলে বই পড়ছে টুকু। মা ঘরে ঢুকল। ‘কী রে টুকু, দরজা-জানলা বন্ধ করিসনি এখনও?’ টুকু বলল, ‘করছি।’ ‘থাক, তুই পড়। আমি বন্ধ করে দিচ্ছি। ছ’টা বাজবার আগেই এ ঘরে চলে আসবি।’ টুকু পড়তে শুরু করল। এখন সবাই বেশি বেশি পড়ে। ডক্টর আঙ্কল বলেছেন, সপ্তাহে দু’দিন নিয়ম করে বই পড়তে হবে। টিভি, কম্পিউটার, মোবাইল থেকে চোখ, মাথা, কানকে বিশ্রাম দিতে হবে। টুকুর বই পড়ার অভ্যাস তেমন ছিল না। শুধু বই পড়ে এখন ও অনেক ভাল আছে। ছোট থেকে বড় সবাই এখন বই পড়ে। মাঝে মাঝে ‘বই পড়া উৎসব’ হয়। মলগুলোতে বইয়ের কাউন্টার থাকে। স্টাডি কর্নার থাকে। সময় পেলেই বই পড়ে সবাই। স্কুলে স্কুলে বেশি করে বই পড়া শুরু হয়েছে। আগামী প্রজন্মকে আরও চিন্তাশীল করে তুলতে হবে। যে স্কুলের লাইব্রেরিতে বইয়ের স্টক যত বেশি, সেখানে ছাত্রছাত্রীর ভর্তির প্রবণতা বেশি এটাই এখন ট্রেন্ড। বাবা টুকুকে একটা বই এনে দিয়েছে। কাকের বই। পরীক্ষায় একটা বিষয় থাকে গল্প বলা। সামনেই পরীক্ষা। টুকুও ব্যস্ত। পাশের ঘর থেকে মা ডাকছে। ‘টুকু চলে আয় কাক আসছে।’ সবাই ঘরের ভিতর। জানলা দরজা বন্ধ। পরদা টানা। বাইরে থেকে শোনা গেল শব্দটা, কা-কা-কা। রোজ আসে ওরা। ঠিক সন্ধে ছ’টায়। প্ল্যান্ড সিটির ছোট-বড় লেনগুলিতে। এক বার দেখেছিল টুকু। চোখদুটো লাল। গায়ের রং কালো। ওদের চোখ আর ডানা থেকে এক ধরনের ‘রে’ বের হয়। ঠোঁট দুটো দিয়ে কা-কা শব্দ। শহরের ঝাড়ুদার পাখি ওরা। ওই ‘রে’ আর শব্দে রাস্তার বিভিন্ন বিষাক্ত পোকামাকড়, জীবাণু মরে যায়। বাতাসের ক্ষতিকারক ভারী উপাদানগুলো শোষণ করে নেয় কাকের শরীর। ওরা রিমোট কন্ট্রোল দ্বারা পরিচালিত। রোজ এ ভাবেই রাস্তা পরিষ্কার করে পুর-ঝাড়ুদার। সবাই
এ সময় নিরাপদ স্থানে সরে যায়। টুকুদের ঘরের পাশ দিয়ে একটা কাক উড়ে গেল। শব্দটা খুব কাছ থেকে কানে এল। কা-কা-কা। পড়ার টেবিলের সামনে রাখা ক্যালেন্ডারে চোখ পড়ল টুকুর। আজ ০৬।০২।৩০৪৫। দশ দিন বাদেই টুকুর পরীক্ষা। আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেল টুকুর। ব্যালকনিতে রোদের তেজ একটু বেশি। কদম গাছের ডালটা হাওয়ায় দুলছে। সূর্যের আলোয় যেন মুচকি মুচকি হাসছে আর টুকুকে বলছে, কী হল বন্ধু? অবাক হলে? দেখলে তো দুষ্টু কাককে কেমন করে ঝাড়ুদার পাখি বানিয়ে দিলাম?