আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে কী বলা হয়েছিল আর তার একশো বছর পরে আমেরিকার হ্যানফোর্ড আর লিভিংস্টোনের অবজারভেটরিতে সরাসরি কীসের (মহাকর্ষীয় তরঙ্গ) হদিশ মিলেছে, আমার মনে হয় এত দিনে মোটামুটি ভাবে সে সম্পর্কে প্রায় সকলেরই একটা প্রাথমিক ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছে। তাই সে সম্পর্কে আরও একটি প্রবন্ধ লেখা হলে, তা চর্বিত চর্বণ হয়ে যেতে পারে। অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন।
তাই আমি চাইছি, এমন কয়েকটি বিষয় নিয়ে খুব সংক্ষেপে, কিছু আলোচনা করতে, যে বিষয়গুলি নিয়ে সাধারণ মানুষের এখনও জানার আগ্রহ রয়েছে বা থাকতে পারে। সেই সব আগ্রহের কিছুটা আমজনতার আগেও ছিল। বাকিটা হয়তো জন্মেছে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সাম্প্রতিক আবিষ্কারের ঘটনার পর। ওই আবিষ্কারই হয়তো তাঁদের মনে নতুন নতুন প্রশ্ন উঠিয়ে দিয়েছে। এ ব্যাপারে আগ্রহটাকে আরও উস্কে দিয়েছে। আমার মনে হয়, এখন সেই বিষয়গুলিকেই আরও সহজ ভাবে তাঁদের সামনে তুলে ধরা উচিত। তা হলে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবেন, পদার্থবিদ্যার এই সাম্প্রতিক যুগান্তকারী আবিষ্কারের গুরুত্ব কতটা আর তা কোথায় কোথায়। অনেকেরই মনে প্রশ্ন রয়েছে, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আবিষ্কারটা যখন হয়েই গেল আমেরিকায়, তখন আর এত টাকা-পয়সা খরচ করে কেন আমরা সেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য করতে চলেছি ‘লাইগো-ইন্ডিয়া’ প্রকল্প।
কেন ‘লাইগো-ইন্ডিয়া’ প্রকল্প এখন এতটা জরুরি?
প্রথমেই সহজ করে একটা কথা বলে দেওয়া যাক, আমরা কি এক চোখ দিয়ে আমাদের চার পাশের সব কিছুকে খুব সহজে দেখতে পারি? পারি না। সেই জন্যই আমাদের দু’টো চোখ। মাথার ঠিক দু’ পাশে। যাতে আশপাশের সব দিকটা আমরা অনেক ভাল ভাবে দেখতে পারি। কিন্তু, তাতেও অনেক অসুবিধা রয়েছে। সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমাদের চোখ দু’টোর মধ্যে দূরত্বটা খুব সামান্য বলে আমরা সেই দু’ চোখ দিয়ে আমাদের আশপাশের একটা নির্দিষ্ট মাত্রার ‘রেজোলিউশন’ পর্যন্তই দেখতে পারি। তার চেয়ে বেশি ভাল ভাবে দেখতে পারি না।
মহা-আবিষ্কারের তীর্থ! আমেরিকার হ্যানফোর্ডের সেই লাইগো ডিটেক্টর।
ঠিক তেমনই আমেরিকার হ্যানফোর্ড আর লিভিংস্টোনে যে তিনটি অ্যাডভান্সড লাইগো ডিটেক্টর গত বছরের সেপ্টেম্বরে চালু করা হয় (যার মাধ্যমে প্রথম সরাসরি হদিশ মিলল মহাকর্ষীয় তরঙ্গের), সেগুলোর মধ্যে দূরত্বটা ততটা ছিল না। সেগুলো রয়েছে শুধু আমেরিকাতেই। তাই ঠিক হয়েছিল, হ্যানফোর্ডের দু’টির মধ্যে একটি ‘লাইগো-ডিটেক্টর’কে নিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এমন কোনও দেশে, ভৌগোলিক অবস্থানের নিরিখে যে দেশটি রয়েছে কার্যত, আমেরিকার বিপরীত মেরুতে। তারই প্রেক্ষিতে, আরও একটি অ্যাডভান্সড লাইগো ডিটেক্টর বসানোর কথা ছিল অস্ট্রেলিয়ায়।
আরও পড়ুন
ব্রহ্মাণ্ডের অন্য প্রান্তের বার্তাও এনে দেবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ!
মহাকাশে মিলল চিনি, প্রাণের স্পষ্ট ইঙ্গিত, বলছেন বিজ্ঞানীরা
মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আবিষ্কারে জিত ভারতীয় মেধার!
কিন্তু নানা কারণে তা বসানো সম্ভব না হওয়ায়, ভৌগোলিক অবস্থানের নিরিখে সেটির ভারতে বসানোর সুযোগ এসে যায় আমাদের সামনে। কারণ, ভৌগোলিক অবস্থানের নিরিখে ভারতও রয়েছে কার্যত, আমেরিকার বিপরীত মেরুতেই। ভারতের পক্ষে শেষ পর্যন্ত সম্ভব না হলে, এ ব্যাপারে সম্ভাব্য দেশ হিসেবে চিনের কথাও ভাবা হয়েছিল। তবে আমরা খুশি, আমাদের ‘লাইগো-ইন্ডিয়া’ প্রকল্পে শেষমেশ কেন্দ্রীয় সরকারি অনুমোদন মিলেছে। যা, অনিবার্য ভাবেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। ফলে, ওই তরঙ্গ খোঁজার জন্য তা হয়ে দাঁড়াবে ‘তৃতীয় নয়ন’। তার ‘সেনসিটিভিটি’ও আমেরিকায় বসানো অ্যাডভান্সড লাইগো ডিটেক্টরগুলোর চেয়ে অনেকটাই বেশি হবে। যার ফলে, ভারতে বসানো ডিটেক্টরটি দিয়ে শুধুই যে মহাকাশের অন্য প্রান্তটিও দেখা যাবে, তা নয়, এই ব্রহ্মাণ্ডের আরও অনেক দূরে, আরও অনেক গভীরেও সন্ধান চালানো যাবে।
‘বিগ ব্যাং’-এর সময়কার মহাকর্ষীয় তরঙ্গেরও হদিশ মিলবে এই দশকেই
দু’টি কৃষ্ণ গহ্বরের সংঘর্ষে যে ভাবে তরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছিল।শিল্পীর কল্পনায়।
আমেরিকার হ্যানফোর্ড আর লিভিংস্টোনের দু’টি অ্যাডভান্সড লাইগো ডিটেক্টরে যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সরাসরি হদিশ মিলল এই প্রথম। তা কিন্তু সেই অর্থে, এই ব্রহ্মাণ্ডের খুব বেশি দূর অতীতের ঘটনার খবর জানাতে পারবে না। আজ থেকে প্রায় ১৪০০ কোটি বছর আগে, ‘বিগ ব্যাং’ বা, মহা-বিস্ফোরণের ফলে কী কী ঘটনা ঘটেছিল ব্রহ্মাণ্ডে, তা কী ভাবে কতটা দ্রুত হারে চার দিকে প্রসারিত (Inflation) হয়েছিল, তার সরাসরি কোনও প্রমাণ আমরা এখনও পাইনি। কারণ, ওই প্রচণ্ড মহা-বিস্ফোরণের পর অনিবার্য ভাবেই যে জোরালো মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছিল, ১৪০০ কোটি বছর পর এখন তা অনেকটাই স্তিমিত বা ক্ষীণতর হয়ে আসায় পৃথিবী থেকে আমাদের পক্ষে সেই আদিমতম মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বা ‘প্রাইমর্ডিয়াল গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ’-এর সরাসরি হদিশ পাওয়াটা সম্ভব হয়নি।
দু’টি কৃষ্ণ গহ্বরের সংঘর্ষের ফলে হওয়া মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। শিল্পীর কল্পনায়।
কিন্তু ২০১৪ সালে ‘BICEP-2’ পরীক্ষা সাফল্যের খুব কাছাকাছি এসে ব্যর্থ হওয়ার পর আর ২০১৫ সালে ‘প্ল্যাঙ্ক সার্ভেয়ার স্পেস মিশন’-এর পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণের পর ‘কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড’ (CMB) নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে আমি এই গবেষণার সঙ্গে দীর্ঘ দিন আন্তর্জাতিক স্তরে জড়িত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আদিমতম মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সরাসরি হদিশ পাওয়াটা এখন শুধুই কিছু সময়ের অপেক্ষা। আর দু’-চার বছরের মধ্যে সেই আদিমতম তরঙ্গেরও সরাসরি হদিশ মিলবে বলে আমার জোরালো বিশ্বাস। আমি বলতে চাইছি, এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে আমরা পা ফেলার আগেই আমরা খুব সম্ভবত, সরাসরি হদিশ পেয়ে যাব আদিমতম মহাকর্ষীয় তরঙ্গেরও। ‘কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড’ (CMB) বলতে বোঝায় ‘বিগ ব্যাং’-এর তিন লক্ষ আশি হাজার বছর পরে যে ‘মহাজাগতিক পরিমণ্ডলে’র সৃষ্টি হয়েছিল। যাকে তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের ‘ধাত্রীভূমি’ও বলা যায়।
আমি অবাক হব না, যদি সেই আদিমতম তরঙ্গেরও সরাসরি হদিশ মেলে এই পৃথিবী থেকেই। কারণ, প্রাথমিক ভাবে ঠিক হয়েছিল, আদিমতম মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সরাসরি হদিশ পেতে ২০২০ সালে মহাকাশেই পাঠানো হবে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ডিটেক্টর- ‘eLISA’। যা নাসার প্রযুক্তিগত সাহায্য নিয়ে মহাকাশে পাঠানোর কথা ছিল ‘ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি’ বা ইএসএ-র। কিন্তু, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য কারণে ইএসএ-র সেই সম্ভাব্য অভিযানের সময় আরও এক-দেড় দশক পিছিয়ে গিয়েছে। তাই আমার বিশ্বাস, মহাকাশে গিয়ে সন্ধান করার আগেই আমরা পৃথিবী থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী ডিটেক্টরের মাধ্যমে আদিমতম মহাকর্ষীয় তরঙ্গেরও সরাসরি হদিশ পেয়ে যাব।
আরও চমকে দেওয়ার মতো আবিষ্কারের অপেক্ষায় আমরা
মানতেই হবে, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আবিষ্কার শুধুই একশো বছর আগেকার আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদকেই প্রমাণ করেনি। আগামী দিনে আরও নিখুঁত ভাবে, আরও গভীরে ঢুঁড়ে-ফুঁড়ে এই ব্রহ্মাণ্ডকে দেখা ও তাকে জানা-বোঝার নতুন ‘হাতিয়ার’ও তুলে দিয়েছে আমাদের হাতে। যাকে বলা হচ্ছে, ‘নিও উইন্ডো’। আর যেহেতু সেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের উৎস একটা নয়, অনেক, অসংখ্য, তাই বলা যেতেই পারে অনেক অনেক ‘নতুন জানলা’ আমাদের সামনে খুলে দিয়েছে মহাকর্ষীয় তরঙ্গর এই সাম্প্রতিক আবিষ্কার। এখনও পর্যন্ত যত বারই নতুন নতুন
দেখুন এই তরঙ্গকে সহজে বোঝার ভিডিও।
আবিষ্কারের মাধ্যমে নতুন নতুন জানলা খুলেছে মহাবিশ্বকে জানা ও বোঝার জন্য, তত বারই আমরা রীতিমতো চমকে গিয়েছি অনেক অজানা তথ্য জেনে, অনেক অচেনা মহাজাগতিক বস্তুর সন্ধান পেয়ে। আর সেই ঘটনা এক বার ঘটেনি। বার বার ঘটেছে। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে, একই ভাবে তার মাধ্যমেও, এই ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে অনেক অজানা জিনিস জানার আর অনেক অনেক অচেনা মহাজাগতিক বস্তুর হদিশ পাওয়ার সম্ভাবনাটা প্রায় ৯৯ শতাংশই জোরালো হয়ে উঠেছে। আলোক কণা বা ফোটনের মাধ্যমে আমরা এই মহাবিশ্ব সম্পর্কে যেমন অনেক অজানা জিনিস জানতে পেরেছি, জেনে চলেছি, তেমনই অনেক অচেনা মহাজাগতিক বস্তু সম্পর্কে আমাদের ধ্যান-ধারণা গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে ‘কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড’ বা, ‘সিএমবি’। রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে মহাকাশে অনুসন্ধান চালানোর পদ্ধতি আবিষ্কার হওয়ার পর আমরা ‘পালসার’-এর খোঁজ পেয়েছিলাম। উচ্চ শক্তির তরঙ্গের মাধ্যমে অনুসন্ধানের পদ্ধতি আবিষ্কৃত হওয়ার পর গামা-রে বিস্ফোরণের ঘটনা আমরা জানতে পেরেছিলাম।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আবিষ্কার আমাদের কী কী জানাতে পারে?
আমরা এখনও পর্যন্ত সামান্যই কয়েকটা ‘মৃত নক্ষত্রে’র কথা জানি। যারা আগে ভারী নক্ষত্র ছিল। কিন্তু জ্বালানি নিঃশেষ হয়ে যাওয়ায়, বহু কোটি বছর আগে তারা ‘মরে গিয়ে’ হয় ‘শ্বেত বামন নক্ষত্র’ বা ‘নিউট্রন নক্ষত্রে’ পরিণত হয়েছে। না হলে তারা হয়ে গিয়েছে ছোট-বড় কৃষ্ণ গহ্বর। অন্য গ্যালাক্সিগুলোর কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, আমাদের এই ‘মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি’তেই ঠিক ক’টা ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর রয়েছে, তা আমরা এখনও সঠিক ভাবে জানি না। লুকিয়ে থাকা কৃষ্ণ গহ্বরগুলি ঠিক কোথায় কোথায় থাকতে পারে, সে সম্পর্কেও আমাদের ধারণা তেমন স্পষ্ট নয়। সদ্য আবিষ্কৃত মহাকর্ষীয় তরঙ্গ এ ব্যাপারে আমাদের অনেকটাই সাহায্য করবে। এ বার মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আবিষ্কৃত হওয়ার সময়েও কি আমরা নতুন কথা কিছু কম জানতে পেরেছি? যে কৃষ্ণ গহ্বর দু’টির মধ্যে সংঘর্ষের ফলে সৃষ্টি হওয়া মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে এই সে দিন আমরা ধরতে পেরেছি, সেই কৃষ্ণ গহ্বরগুলির মতো ভারী ব্ল্যাক হোলের হদিশ তো আমরা এর আগে পাইনি। সেটাও একটা নতুন জিনিস জানতে পারা। একটা অচেনা মহাজাগতিক বস্তুর সন্ধান পাওয়াই। তাই নয় কি? ফলে, আর দু’-চার কি খুব বেশি হলে, আর সাত-আট বছরের মধ্যে এই মহাবিশ্ব সম্পর্কে আরও চমকে দেওয়ার মতো তথ্য যে আমরা পেতে চলেছি, এতে আমার কোনও সন্দেহই নেই।
ভারতীয়ের অবদান এই আবিষ্কারে- দেখুন ভিডিও।
ছবি সৌজন্য: নাসা
ভিডিও সৌজন্য: আয়ুকা, পুণে ও জার্নাল নেচার