Evolutionary History of Potato

আলুর জন্ম কী ভাবে? জিনসূত্র খুঁজতে খুঁজতে বিজ্ঞানীরা দেখলেন, অবদান রয়েছে টম্যাটোরও

কয়েক হাজার বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বতমালার পাদদেশে প্রথম আলুচাষ করেছিল ইনকারা। ষোড়শ শতাব্দী থেকে অভিযাত্রীদের হাত ধরে তা ইউরোপে পৌঁছোয়। সেখান থেকেই ক্রমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে আলুর মহিমা। কিন্তু এত জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও আলুর বিবর্তনের ইতিহাস এত দিন ছিল অজানাই।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০২৫ ০৯:০১
Share:

ছবি: সংগৃহীত।

চিপ্‌স থেকে বিরিয়ানি, তরকারি থেকে মাংসের ঝোল— একটা জিনিস না থাকলে সবই ফিকে। আর সেই আলুই যে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সব্জি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। গত কয়েক শতাব্দী ধরে দুনিয়ার প্রায় সব দেশেই অন্যতম প্রধান খাদ্য হয়ে উঠেছে আলু। কিন্তু এ হেন আলুর জন্ম হল কী ভাবে? সম্প্রতি সেই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

Advertisement

কয়েক হাজার বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বতমালার পাদদেশে প্রথম আলুচাষ করেছিল ইনকারা। ষোড়শ শতাব্দী থেকে অভিযাত্রীদের হাত ধরে তা ইউরোপে পৌঁছোয়। সেখান থেকেই ক্রমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে আলুর মহিমা। কিন্তু এত জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও আলুর বিবর্তনের ইতিহাস এত দিন ছিল অজানাই। তবে সম্প্রতি কৃষিজাত আলুর ৪৫০টি এবং বন্য আলুর ৫৬টি প্রজাতির জিনোম বিশ্লেষণ করে জানা গিয়েছে, লক্ষ লক্ষ বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকায় দুই সব্জির সংমিশ্রণে আলুর জন্ম হয়েছিল! এক দিকে বন্য টম্যাটো, আর এক দিকে আলুর কাছাকাছি এক প্রজাতির মধ্যে প্রাকৃতিক আন্তঃপ্রজননে জন্মেছিল আজকের আলুর পূর্বসূরি।

নতুন এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে ‘সেল’ জার্নালে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আজ থেকে প্রায় ৯০ লক্ষ বছর আগে টম্যাটো এবং আলুরই এক জাতভাইয়ের মধ্যে সংকরায়নের ফলে আলু তৈরি হয়েছিল। আর সেই থেকেই নাকি আলু হয়ে উঠেছিল কন্দজাতীয় সব্জি। এর নেপথ্যে রয়েছে দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিন। সেগুলিকেও চিহ্নিত করে ফেলেছেন বিজ্ঞানীরা।

Advertisement

কী ভাবে হয়েছিল এই সংকরায়ন?

গবেষণায় জানা গিয়েছে, আধুনিক আলুর বাবা-মা হল টম্যাটো এবং পেরুর এক প্রাচীন সব্জি, যার নাম ‘এটিউবারোসাম’। এ বার, একটু তলিয়ে ভেবে দেখলেই এক অদ্ভূত বিষয় নজরে পড়বে। টম্যাটো গাছের ভোজ্য অংশটি হল ফল। অথচ, আলু গাছের যে অংশটি আমরা খাই, সেটি আদতে কন্দ বা টিউবার। তাই আধুনিক আলু গাছের বৈজ্ঞানিক নাম ‘সোলানাম টিউবারোসাম’। আবার, আলুর জাতভাই এটিউবারোসামের সঙ্গে আলুর মিল রয়েছে বটে, তবে এতে কন্দ নেই! তা হলে কী ভাবে এল আধুনিক আলু? তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন গবেষকেরা। আদতে, আজ থেকে প্রায় ১ কোটি ৪০ লক্ষ বছর আগে একই পূর্বপুরুষের থেকে টম্যাটো ও এটিউবারোসামের জন্ম। একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার ৫০ লক্ষ বছর পর প্রাকৃতিক ভাবেই ফের সংকরায়ন হয় এই দুইয়ের। আর তাতেই জন্ম হয় আলুর।

আলুর মতো এটিউবারোসামেরও পাতলা, ভূগর্ভস্থ কাণ্ড রয়েছে। তবে কোনও কন্দ নেই। অন্য দিকে, জিনগত বা বংশগত দিক থেকে আলু টম্যাটোর অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়! সে কারণেই গবেষকেরা আরও বিভ্রান্ত হচ্ছিলেন। এই ধাঁধার রহস্য উন্মোচনের জন্যই কৃষিজাত এবং বন্য— দুই ধরনের আলুর ডিএনএ বিশ্লেষণ করে দেখতে শুরু করেন বিজ্ঞানীরা। গবেষণায় দেখা যায়, আলুর প্রতিটি প্রজাতির মধ্যে এটিউবেরোসাম এবং টম্যাটো গাছের জিনের সুষম মিশ্রণ রয়েছে! অর্থাৎ, একেবারে প্রথম দিকের আলুগুলি যে এই দুই ভিন্ন প্রজাতির গাছের প্রাকৃতিক সংকরায়নের ফল ছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। উদ্ভিদজগতে এমন বিরল ঘটনা সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু টম্যাটো ও এটিউবেরোসাম— দু’টি প্রজাতি আলাদা আলাদা ভাবে প্রায় ৫০ লক্ষ বছর ধরে বিবর্তিত হলেও এদের মধ্যে এতই বেশি জিনগত মিল ছিল, যে ফের তাদের সংকরায়ন সম্ভব হয়।

লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে উদ্ভিদবিজ্ঞানী স্যান্ড্রা ন্যাপ বলছেন, ‘‘বিরল এই ঘটনার ফলে জিনের এমন পরিবর্তন ঘটেছিল যে অভিযোজনের ফলে পরবর্তী বংশধরদের ক্ষেত্রে কন্দ তৈরি হয়। ফলে নতুন এই উদ্ভিদগুলি আন্দিজ পর্বতের দুর্গম, প্রতিকূল পরিবেশে, অনুর্বর মাটিতে কিংবা অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা ও শুষ্ক আবহাওয়াতেও সহজেই বংশবৃদ্ধি করতে থাকে।’’ এই কন্দই আজকের আলুকে আন্দিজ এলাকার পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করেছিল। প্রতিকূল পরিবেশে পুষ্টি সঞ্চয় করে রাখা, অযৌন জননের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করা— সবেতেই আলুকে বাঁচিয়ে রেখেছিল এই কন্দ।

এখন সারা বিশ্বে ৫,০০০-এরও বেশি আলুর প্রজাতি রয়েছে। পেরুর ইন্টারন্যাশনাল পট্যাটো সেন্টার রিসার্চ অর্গানাইজ়েশনের মতে, রোজকার খাবার হিসাবে চাল এবং গমের পরেই আলুর স্থান। চাইনিজ় অ্যাকাডেমি অফ এগ্রিকালচারাল সায়েন্সেসের জীববিজ্ঞানী সানওয়েন হুয়াং বলেন, ‘‘আজকের দিনে আলু সত্যিই মানবজাতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য খাদ্যগুলির মধ্যে একটি। আলুর মতো বহুমুখীতা, পুষ্টিগুণ এবং দেশ-কাল-সংস্কৃতি ভেদে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা খুব কম ফসলের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। মানুষ প্রায় সব রান্নাতেই আলু খায়। মূলত শর্করা বলে হেয় করা হলেও আলুতে ভিটামিন সি, পটাশিয়াম, ফাইবার এবং স্টার্চ থাকে। এটি প্রাকৃতিক ভাবে গ্লুটেন-মুক্ত এবং কম চর্বিযুক্তও।’’ হুয়াং আরও জানাচ্ছেন, প্রজননের সময় আলুর জিনোমে থাকা সমস্ত ক্ষতিকর মিউটেশন এড়ানো এত দিন বেশ কঠিন কাজ ছিল। তবে নতুন এই আবিষ্কারের পর টম্যাটোকে ব্যবহার করে ক্ষতিকর মিউটেশনমুক্ত ‘সুস্থ’ ও উৎকৃষ্ট আলু তৈরি করা যেতে পারে। শুধু তা-ই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফলন যে বাধার মুখোমুখি হয়, তার মোকাবিলাও করা যাবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement