পৃথিবীর ঘূর্ণনের গতি কমছে, নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে চাঁদ! গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
২৪ ঘণ্টায় এক দিন— ছোটবেলার খাতায় কত অঙ্কই না মিলিয়ে দিয়েছে এই সরল হিসাব। বিজ্ঞানের পাতায় অবশ্য দিনের আরও সূক্ষ্ম একটি হিসাব দেওয়া থাকে। বলা হয়, সূর্যের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে নিজের চারপাশে ঘুরতে পৃথিবীর আসলে সময় লাগে ২৩ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট ৪ সেকেন্ড। যে কারণে বাড়তি সময়টুকুর হিসাব মেলানোর জন্য চার বছর অন্তর বছরে একটি করে দিন যোগ করতে হয়। আসে ৩৬৬ দিনের অধিবর্ষ (লিপ ইয়ার)। কিন্তু এই নিয়মও চিরস্থায়ী নয়! পৃথিবীর এই ঘূর্ণনের গতি যে ধীরে ধীরে কমে আসছে, তা ছোটদের কোনও বইয়ের পাতায় লেখা হয়নি।
দীর্ঘ দিন ধরে পৃথিবীর আহ্নিক গতি নিয়ে গবেষণা করতে করতে, গ্রহের আবর্তন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে করতে বিজ্ঞানীরা উপলব্ধি করেছেন, সত্যিই গতি কমছে। পৃথিবী দিন দিন মন্থর হচ্ছে। আর পুরো ঘটনাই ঘটছে চাঁদের কারসাজিতে! পরিস্থিতি এমনই যে, বছরের সঙ্গে দিন যোগ করে আর হিসাব মেলানো যাবে না। দিনের সঙ্গে ঘণ্টা জুড়তে হতে পারে ভবিষ্যতে। আসতে পারে ২৫ ঘণ্টার দিন!
দৈনন্দিন জীবনের হিসাব মেলানোর জন্য ২৪ ঘণ্টার দিন বানিয়ে ঘড়ির কাঁটা চালায় মানুষ। কিন্তু আসলে ২৪ তো বটেই, ২৩ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডের সেই হিসাবও স্থির নয়। পৃথিবীর প্রতি দিনের ঘূর্ণন-গতিতে সামান্য হলেও হেরফের হয়। বিজ্ঞানীরা বলেন, সূর্যের সাপেক্ষে পরিমাপ না করে আমরা যদি পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি অন্য কোনও নক্ষত্রের সাপেক্ষে পরিমাপ করি, তবেই অন্য হিসাব উঠে আসে। অন্য নক্ষত্রের বিচারে নিজের চারপাশে পৃথিবীর ঘোরার গতি আরও কিছুটা কমে যায়। আর প্রায় এই গতিতে ছোটবড় তারতম্য হয়। সেকেন্ডের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের সে সব হেরফেরের প্রভাব মানবসভ্যতায় পড়ে না। পড়ার কথাও নয়। কিন্তু তা বিজ্ঞানীদের নজর এড়ায় না। সূর্যের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতেই পৃথিবীর নিজস্ব ঘূর্ণন চলে বলে গতির এই হেরফের, মত বিশেষজ্ঞদের একাংশের।
পৃথিবীর উপর তার একমাত্র উপগ্রহ চাঁদের প্রভাব বরাবরই অনেক বেশি। চাঁদের আকর্ষণে পৃথিবীতে জোয়ার-ভাটা হয় নিয়মিত। এই চাঁদের টানই পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি কমিয়ে দিচ্ছে, দাবি বিজ্ঞানীদের একাংশের। তাঁরা বলছেন, চাঁদের যে বল জোয়ার-ভাটা ঘটায়, সেই বলই পৃথিবীর গতিতে ‘ব্রেক’ হিসাবে কাজ করছে। আসলে চাঁদের মহাকর্ষ বলের টানে পৃথিবীর সমুদ্রের বিশাল জলরাশি চলকে ওঠে। এক বার ফুলে কিছু ক্ষণ পর আবার জল আছড়ে পড়ে নীচে। জলরাশির ওঠানামার এই পরিমাপ স্বাভাবিক ভাবেই নিঁখুত হয় না। এর ফলে সমুদ্রের তলদেশে ঘর্ষণ হয়। বিজ্ঞানীদের দাবি, সেই ঘর্ষণই পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি কমাচ্ছে একটু একটু করে।
পৃথিবীর গতি কমিয়ে দিয়ে নিজেও ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে চাঁদ। এই প্রক্রিয়ায় চাঁদ এবং পৃথিবীর মধ্যে কিছুটা শক্তির আদানপ্রদান চলে। বিষয়টি বোঝার জন্য একটি পার্থিব দৃশ্য কল্পনা করে নেওয়া সহজ। অফিসের চাকাযুক্ত চেয়ারটিকে বনবন করে ঘুরিয়ে দেওয়ার পর হালকা করে পা দিয়ে তাকে নিজের দিকে টানলে বা হালকা ধাক্কা দিলে দেখা যাবে, চেয়ারের ঘূর্ণন থামছে না। কিন্তু তার ঘূর্ণনের গতি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।
পৃথিবীর ঘূর্ণনে সামান্য সেকেন্ডের তারতম্য আমরা বুঝতে পারি না। কিন্তু বিজ্ঞানীরা সেই অদৃশ্যেরও হিসাব রাখেন। মহাজাগতিক পর্যবেক্ষণ এবং দীর্ঘ ঐতিহাসিক রেকর্ডের সঙ্গে বর্তমানের ঘড়ির তুলনা করেন তাঁরা। সময়ের আধুনিক হিসাব পদ্ধতিতে সূক্ষ্ম তারতম্যও ধরা পড়ে যায়। পৃথিবীর ঘূর্ণনের সঙ্গে ঘড়ির সময়ের হিসাব মেলাতে ‘লিপ সেকেন্ড’ ব্যবহার করেন বিজ্ঞানীরা। আমেরিকার নৌ পর্যবেক্ষণ ঘাঁটি থেকে ‘লিপ সেকেন্ড’-এর তথ্য নিয়মিত প্রকাশও করা হয়।
দিনের সময় বাড়তে বাড়তে কখনও ২৫ ঘণ্টার দিন মিলবে, খাতায়কলমে তা সম্ভব বলেই জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু কত দিনে? একটি দিন সম্পন্ন হতে ২৫ ঘণ্টা লেগে যাবে? কবে থেকে বদলাবে সেই ঘড়ির নিয়ম? বিজ্ঞানীদের দাবি, যে হেতু পৃথিবীর ঘূর্ণন-গতি পরিবর্তনশীল, তাই অদূর ভবিষ্যতে ঘড়ি পাল্টানোর সম্ভাবনা নেই। খাতায়কলমে করা হিসাব বলছে, যদি চাঁদ ও পৃথিবীর গতিবিধি একইরকম থাকে, তবে ২৫ ঘণ্টার দিন আসতে সময় লাগবে অন্তত ২০ কোটি বছর। তা মানুষ, মানবসভ্যতা বা ক্যালেন্ডারে কোনও রকম প্রভাব ফেলতে পারবে না।
চাঁদ একা দায়ী নয়। পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি কমিয়ে দিতে পারে আরও কিছু শক্তি। বিজ্ঞানীরা বলেন, পৃথিবীর মধ্যে যদি বিশাল ভরের কোনও বস্তু স্থান পরিবর্তন করে, তার প্রভাবেও ধাক্কা খেতে পারে গ্রহের ঘূর্ণি। প্রকাণ্ড বরফের চাঁই গলে গেলে বা বিপুল জলরাশি লাফিয়ে উঠলে কমতে পারে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি। জলবায়ুর পরিবর্তনও তাই এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।