...আলোর নীচেই অন্ধকার?

চন্দননগর কি জানে পৃথিবী জুড়ে উঁকি দিচ্ছে এক নতুন সমস্যা

সদ্য আবিষ্কার হওয়া এলইডি বাল‌্‌বের ব্যবহার একই সঙ্গে যেমন বিদ্যুতের সাশ্রয় করেছে, তেমনই এগুলো পরিবেশবান্ধবও বটে।

Advertisement

অরিন্দম রায়

শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০১
Share:

প্রতীকী ছবি।

আর মাত্র দু’দিন। তার পর বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব। দুর্গাপুজো। আর দুর্গাপুজো মানেই আলো। তবে এই আলো ছড়াতে পারে দূষণ। শব্দদূষণ নিয়ে সবাই চিন্তিত হলেও, আলোর দূষণ নিয়ে সচেতনতা কম। কলকাতা শহরেরই চারদিকে আলো। প্রতিটি রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে জড়ানো আলোর মালা। শুধু শহরেই নয়, মফস্সলেরও মোড়ে মোড়ে বিরাট আলোর স্তম্ভ। আর পুজো আসলে তো কথাই নেই। সবই নাকি চন্দননগর শহরের আশীর্বাদ। আলোর এই বাড়াবাড়ি যে দূষণ ছড়াতে পারে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা সাবধানবাণী শোনাচ্ছেন বহু দিন ধরেই। বায়ুদূষণ, জলদূষণ, শব্দদূষণের পর গোটা পৃথিবী জুড়ে উঁকি দিচ্ছে এক নতুন সমস্যা। আলোক দূষণ।

Advertisement

উৎসবের আনন্দে আলোকিত প্রাঙ্গণ থেকে আলোক দূষণের প্রবণতা ইদানীং কালে উঠে আসছে বিভিন্ন গবেষণায়। নাসা পরিচালিত কৃত্রিম উপগ্রহ সউমি থেকে আসা তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি ছবি থেকে জানা গিয়েছে, ইংরেজি নববর্ষের সময় ভারতে ব্যবহৃত নানাবিধ আলোকসজ্জার দিন এবং তার ঠিক ১০ দিন আগের আকাশের মধ্যের বিপুল পার্থক্য। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, উৎসবের কারণে কৃত্রিম আলোর ব্যবহার শুধুমাত্র উৎসবের দিনগুলিতে হয় না, উৎসবের পরও উৎসবের রেশ বজায় রাখতে বেশ কিছু দিন রাখা হয়। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার বিজ্ঞানী পবন কুমারের নেতৃত্বে করা সদ্যপ্রকাশিত একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে, ২০০৩ সালের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে আলোক দূষণ বেড়েছে সাত গুণেরও বেশি। অথচ আলোক দূষণ কমানোর পথ খুবই সহজ। অকারণে আলোর ব্যবহার কমানো, রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে টাইমার লাগানো, আলোক উৎসের তীব্রতা কমানো এবং ১০ ফুটের বেশি উচ্চতায় ল্যাম্পপোস্ট না লাগানোর মতো অত্যন্ত সাধারণ কিছু পদ্ধতি অবলম্বনেই শুধু যে আলোক দূষণ কমবে তা-ই নয়, বহু টাকার বিদ্যুতেরও সাশ্রয় হবে।

শুধু উৎসব নয়। আলোক দূষণের অন্যতম কারণ হল, দ্রুত নগরায়ণ এবং জনসংখ্যার ক্রমবৃদ্ধি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে বাজারের প্রতিযোগিতা, বাড়ছে কাজের সময়। ফলে শহর ও মফস্সলের রাতের আকাশ ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার রাত এবং আলোকিত দিনের চক্রাকার পরিবর্তন কোটি কোটি বছরের পৃথিবীর বিবর্তনের ফলস্বরূপ প্রাণী এবং উদ্ভিদের ডিএনএ বা জিনের মধ্যে স্মৃতির মতোই গেঁথে গিয়েছে। পুষ্টি, জনন, শিকার এবং বিশ্রামের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া ভীষণ ভাবে নির্ভরশীল আলো এবং অন্ধকারের ক্রমান্বয় চক্রের ওপর। মানুষের এই নির্ভরতা নষ্ট হয়েছে রাতের পরিবেশে কৃত্রিম আলোকসজ্জার দ্বারা। ফলে মানুষ প্রকৃৃতি থেকে ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছে।

Advertisement

১৯৯৪ সালের এক ঘটনা। সে বছর আমেরিকার লস এঞ্জেলস শহরে ভূমিকম্পের কারণে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। বেশ কিছু মানুষ স্থানীয় ইমার্জেন্সি বিভাগে টেলিফোন করে জানিয়েছিলেন আকাশে এক বিরাট রূপোলি অদ্ভুত বস্তু দেখা যাচ্ছে। পরে জানা যায়, সেটি ছিল ছায়াপথ। সেই শহরে বড়-হওয়া বেশিরভাগ মানুষই কৃত্রিম আলোকের কারণে কখনও ছায়াপথ দেখেনইনি।

সদ্য আবিষ্কার হওয়া এলইডি বাল‌্‌বের ব্যবহার একই সঙ্গে যেমন বিদ্যুতের সাশ্রয় করেছে, তেমনই এগুলো পরিবেশবান্ধবও বটে। কিন্তু সাধারণ ভেপার ল্যাম্পের তুলনায় নগণ্য দাম হওয়ার কারণে বেড়েছে অপব্যবহার। বিদ্যুৎসাশ্রয়ী বলে সারা রাত বাথরুম বা বারান্দার আলো জ্বালিয়ে রেখে দেন অনেকেই। শুধুমাত্র রাস্তাঘাট নয়, বিজ্ঞাপন এবং অনুষ্ঠান বাড়িতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে এই বাল‌্‌ব। সিডনির বিখ্যাত অপেরা হাউসের ফ্লাডলাইটে আকৃষ্ট হয়ে প্রতি বছর মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে পরিযায়ী পাখির ঝাঁক। ফ্লোরিডার উপকূলে সামুদ্রিক কচ্ছপের বাচ্চারা ডিম ফোটার পর সামুদ্রিক ঢেউয়ে প্রতিফলিত চাঁদের আলোয় দিক নির্ণয় করে জলের দিকে এগিয়ে চলে। কিন্তু বর্তমানে ফ্লোরিডা উপকূলের বিপুল সংখ্যক রিসর্টে এবং হোটেলের কৃত্রিম আলোকসজ্জায় কচ্ছপের ছানাগুলি দিকভ্রষ্ট হয়ে সমুদ্রের উল্টো অভিমুখে যায় এবং সকালের সূর্যের তাপে ও জলের অভাবে হাজার হাজার কচ্ছপ মারা যায়। আমেরিকার কচ্ছপ সংরক্ষণ কেন্দ্রের অধিকর্তা বিজ্ঞানী ডেভিড গডফ্রের মতে, উপকূলবর্তী এলাকায় আলোক দূষণ সামুদ্রিক কচ্ছপের ছানাদের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ।

আলোর দূষণ মানুষের পক্ষেও ক্ষতিকারক। আলোক উৎস থেকে নিঃসৃত ফোটনকণা চোখের রেটিনায় পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে নিউরনের মাধ্যমে সঙ্কেত পৌঁছে যায় দুই গুরুমস্তিষ্কের মাঝে থাকা পিনিয়াল গ্রন্থিতে। পিনিয়াল গ্রন্থি থেকে তৈরি হওয়া মেলাটোনিন হরমোন ঘুমের সময়কার বিভিন্ন প্রক্রিয়া, যেমন— দেহের তাপমাত্রা কমানো, খিদে কমানো, বিপাকের ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে। পিনিয়াল গ্রন্থি সন্ধের পর থেকে ভোর অবধি মেলাটোনিন নিঃসরণ করে। রাতের বেলায় কৃত্রিম আলোকের উপস্থিতি রক্তে মেলাটোনিনের স্বাভাবিক ঘনত্বের পরিবর্তন করে, যা মানুষের জৈবিক ঘড়িকে প্রভাবিত করে। ফলস্বরূপ নিদ্রাহীনতা, বিষণ্ণতা, উদ্বেগ এবং মধুমেহ রোগের সম্ভাবনা অত্যধিক বাড়িয়ে তোলে। ২০০৫ সাল থেকে প্রকাশিত ১৭টি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ কৃত্রিম আলোকের সঙ্গে স্তন ক্যান্সারের সম্পর্কের সন্ধান দিয়েছে। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের বিজ্ঞানীদের এক অনুসন্ধান বলছে, রাতে কর্মরত মহিলাদের ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতা অন্ধ বা দৃষ্টিহীন মহিলাদের থেকে বহু গুণ বেশি।

মূলত কৃত্রিম আলোর উপস্থিতি তিন ভাবে প্রভাব ফেলে নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত প্রাণীদের ওপর। অত্যধিক আলোর কারণে ছোট স্তন্যপায়ী জীব, যেমন— ইঁদুর, ছুঁচো, গন্ধগোকুল, কাঠবেড়ালিদের রাতের অন্ধকারে শিকার ধরার পরিধি কমতে থাকে। ডারউইন ইয়ারড মাউস নামের ইঁদুরদের নিয়ে এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, কৃত্রিম আলোকের উপস্থিতি ১৫ শতাংশ পর্যন্ত খাদ্যের অভাব সৃষ্টি করতে পারে।

শহরের পাখি এবং পতঙ্গের ওপর এই কৃত্রিম আলোর প্রভাব আবার আলাদা। পাখি এবং পতঙ্গ উভয়ই আকৃষ্ট হয় কৃত্রিম আলোর উৎসের দিকে এবং অত্যধিক উষ্ণতার কারণে ঝলসে গিয়ে বা জলের অভাবে মারা যায় তারা।

আলোক দূষণ সরাসরি পতঙ্গের প্রজননে বাধা সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, কলকাতায় এবং পার্শ্ববর্তী শহরতলিতে বছর পাঁচেক আগেও জোনাকির দেখা পাওয়া যেত, কিন্তু বর্তমানে হাতেগোনা কিছু জায়গা ছাড়া জোনাকিদের দেখাই পাওয়া যায় না। কৃত্রিম আলো এতটাই বেশি উজ্জ্বল যে, তা জোনাকিদের নিজস্ব আলোর ঔজ্জ্বল্যকে ছাপিয়ে যায়। ফলে জোনাকিদের প্রজননকালীন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

আলোক দূষণ নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে একাধিক দেশ। পরিযায়ী পাখিদের যাতায়াতের ঋতুতে টরন্টো, নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটনের মতো শহরে রাতের বেলা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। আরিজ়নার ফ্ল্যাগস্টাফ প্রথম শহর হতে চলেছে, যেখানে সম্পূর্ণ ভাবে রাতের অন্ধকার আকাশকে প্রাধান্য দিয়ে বানানো হচ্ছে। যদি এই কলকাতাতেও করা যায় এ রকম অন্ধকার উৎসব, তাতে পরিবেশ বাঁচবে, বাঁচবে অন্য প্রাণী ও মানুষরাও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন