বিভিন্ন অবস্থানে অ্যাটলাসের ছবি ধরা পড়েছে টেলিস্কোপে (ডটের সাহায্যে চিহ্নিত)। ছবি: সংগৃহীত।
বয়সে আমাদের সৌরজগতের চেয়েও কোটি কোটি বছরের পুরনো! এমনই এক রহস্যময় মহাজাগতিক বস্তু ধরা দিল দক্ষিণ আমেরিকার চিলির টেলিস্কোপে! বিজ্ঞানীরা বলছেন, রহস্যময় এই বস্তুই সম্ভবত এখনও পর্যন্ত খোঁজ পাওয়া সব চেয়ে প্রাচীন ধূমকেতু।
নাম ‘৩আই/অ্যাটলাস’। সপ্তাহদুয়েক আগে চিলির অ্যাটলাস সার্ভে টেলিস্কোপে প্রথম বার দেখা গিয়েছে এই ধূমকেতুকে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রাচীন এই আন্তঃনক্ষত্র বস্তুর বয়স সৌরজগতের চেয়েও ৩০০ কোটি বছর বেশি। আমাদের সৌরজগতের বয়স প্রায় ৪৬০ কোটি বছর। অর্থাৎ ‘৩আই/অ্যাটলাস’-এর জন্ম প্রায় ৭৫০ কোটি বছর আগে!
কোনও নক্ষত্রের জীবদ্দশার একদম শুরুতে সেই নক্ষত্রের চারপাশে যে সব মহাজাগতিক বস্তু তৈরি হয়, তাদেরকে আন্তঃনক্ষত্র বস্তু বলে। এখনও পর্যন্ত সৌরজগতের বাইরের মাত্র দু’টি আন্তঃনক্ষত্র বস্তুর দেখা পাওয়া গিয়েছে। সেদিক থেকে অ্যাটলাসই হবে তৃতীয়। ফলে এর মধ্যেই সদ্য আবিষ্কৃত এই ধূমকেতুর সম্পর্কে আরও বিশদে জানতে উঠেপড়ে লেগেছেন বিশ্বের তাবড় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।
পৃথিবী থেকে অ্যাটলাসের দূরত্ব পৃথিবী থেকে বৃহস্পতির দূরত্বের সমান। ফলে খালি চোখে এর দেখা পাওয়া অসম্ভব। কেবল মাত্র খুব শক্তিশালী টেলিস্কোপেই দেখা যায় ‘৩আই/অ্যাটলাস’কে। চলতি বছরের ১ জুলাই প্রথম বার এই ধূমকেতুর দেখা পান বিজ্ঞানীরা। সে সময় এটি সূর্য থেকে প্রায় ৬৭ কোটি কিলোমিটার দূরে ছিল। তার পর থেকেই নড়েচড়ে বসেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। অ্যাটলাসের সম্ভাব্য গতিপথ জানারও চেষ্টা চলছে।
শুক্রবার ডারহামে ব্রিটেনের রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির জাতীয় সভায় এই আবিষ্কারের প্রাথমিক স্তরের তথ্য উপস্থাপন করা হয়। সেখানেই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ম্যাথিউ হপকিন্স বলেন, ‘‘আমরা সকলেই ‘৩আই/অ্যাটলাস’ নিয়ে বেশ উত্তেজিত!’’ হপকিন্সের মতে, অ্যাটলাসের গতিবেগের উপর ভিত্তি করে অনুমান করা হচ্ছে, এটি ৭০০ কোটি বছরেরও বেশি পুরনো। আর সে কারণেই এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত আন্তঃনক্ষত্র বস্তুগুলির মধ্যে অ্যাটলাসকেই সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, সম্ভবত আকাশগঙ্গা ছায়াপথের ‘পুরু চাকতি’ অংশ থেকে অ্যাটলাসের উৎপত্তি হয়েছিল। সর্পিল ছায়াপথের যে অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত প্রবীণ এবং ধাতুস্বল্প নক্ষত্র থাকে, তাকেই ‘থিক ডিস্ক’ বা পুরু চাকতি অঞ্চল বলা হয়। আকাশগঙ্গার যে অঞ্চলে সূর্য এবং বেশিরভাগ নক্ষত্র রয়েছে, তার উপর এবং নীচের বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে এই প্রবীণ নক্ষত্রপুঞ্জের অবস্থান। হপকিন্সের মতে, প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি বছর আগে আকাশগঙ্গার এই অংশেই জন্ম হয়েছিল অ্যাটলাসের। হপকিন্সের দেখানো আকাশগঙ্গা ছায়াপথের এই ছবিটি দেখলে এই ধূমকেতুর গতিপথ সম্পর্কে ধারণা করা খানিক সহজ হবে। আমাদের ছায়াপথের চারপাশে প্রায় গোলাকার কক্ষপথে ঘুরে চলেছে এটি। ছবিতে সূর্যের কক্ষপথ হলুদ রঙ এবং অ্যাটলাসের আনুমানিক কক্ষপথ লাল রঙের সাহায্যে দেখানো হয়েছে।
অ্যাটলাসের আনুমানিক কক্ষপথ লাল রঙের সাহায্যে দেখানো হয়েছে। ছবি: বিবিসি।
বিজ্ঞানীরা আরও বলছেন, সম্ভবত একটি প্রাচীন তারার চারপাশে তৈরি হয়েছিল অ্যাটলাস। আর সে কারণেই এই ধূমকেতু প্রচুর পরিমাণে জলীয় বরফ দিয়ে তৈরি। অর্থাৎ চলতি বছরের শেষের দিকে যখন অ্যাটলাস সূর্যের আরও কাছাকাছি পৌঁছবে, তখন সূর্যের তাপে ধূমকেতুপৃষ্ঠের উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার কারণে এর চারদিকে তৈরি হবে জলীয় বাষ্প এবং ধূলিকণার পিণ্ড। এই উজ্জ্বল ‘লেজ’ ধরা পড়বে টেলিস্কোপেও!
এখনও পর্যন্ত মাত্র দু’টি আন্তঃনক্ষত্র বস্তুর খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে একটি হল ১আই/’ওউমুয়ামুয়া। ২০১৭ সালে প্রথম বার দেখা গিয়েছিল একে। দ্বিতীয়টির নাম ২আই/বরিসভ, যা ২০১৯ সালে আবিষ্কার হয়। ছোট্ট সেই তালিকায় তৃতীয় সংযোজন অ্যাটলাস। এই বছরের শেষের দিকে সাধারণ টেলিস্কোপেও পৃথিবী থেকে দেখা যাবে অ্যাটলাসকে। উচ্ছ্বসিত জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাও! অক্সফোর্ডের অধ্যাপক ক্রিস লিন্টটের কথায়, ‘‘এই ধূমকেতু আকাশগঙ্গা ছায়াপথের এমন একটি অংশ থেকে এসেছে, যা আমরা আগে কখনও এত কাছ থেকে দেখিনি। তা ছাড়া, এই আন্তঃনক্ষত্র বস্তু সৌরজগতের চেয়েও অন্তত কয়েকশো কোটি বছরের পুরনো হওয়ার দুই-তৃতীয়াংশ সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সময় থেকেই মহাকাশে ছুটে বেড়াচ্ছে এই ধূমকেতু।’’
‘প্রাচীনতম’ ধূমকেতুটির সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায়নি। অগত্যা হপকিন্সের মডেলই ভরসা। যাবতীয় আবিষ্কারও রয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ে। তবে এই আবিষ্কারকে বেশ গুরুত্ব দিয়েই দেখছেন বিজ্ঞানীরা। কারণ, অ্যাটলাসের গতিপ্রকৃতি খতিয়ে দেখে মূল নক্ষত্রটির সম্পর্কে ধারণা মিলবে। আকাশগঙ্গা ছায়াপথের ‘রহস্যময়’ অঞ্চলের গ্রহ-তারার বিষয়েও জানা যাবে নানা অজানা তথ্য।