পৃথিবীতে জীবনের আবির্ভাব কবে হয়েছে, নতুন তথ্য জানালেন বিজ্ঞানীরা। —প্রতীকী চিত্র।
এত দিন যা মনে করা হত, তার চেয়েও অনেক আগে পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব হয়ে গিয়েছিল। পৃথিবী সৃষ্টির প্রায় ৪০ কোটি বছর পরেই এই গ্রহে প্রথম প্রাণের আবির্ভাব হয়। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় তেমনটাই আভাস পাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
পৃথিবীর প্রথম ‘জীবন’ ছিল এক অণুজীব। বিবর্তনের বংশলতিকার একেবারে গোড়ায় রয়েছে সে। তার থেকেই সব ডালপালা প্রসারিত হতে হতে প্রাণী এবং উদ্ভিদকুলের আবির্ভাব হয়। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে গাছপালা, মানুষ, এমনকি বিশালাকায় নীল তিমি— বর্তমানে পৃথিবীতে যত জীবন রয়েছে, সব কিছুরই সৃষ্টির গোড়ায় রয়েছে সেই আদিম পূর্বসূরি। বিজ্ঞানীরা এটিকে বলেন ‘লাস্ট ইউনিভার্সাল কমন অ্যানসেস্টর’ (সংক্ষেপে লুকা)।
মানবপ্রজাতির আবির্ভাব হয়েছে আদিম বানর প্রজাতি থেকে। তবে বিবর্তনের বংশলতায় আরও পিছিয়ে গেলে দেখা যাবে সব স্তন্যপায়ী প্রাণী, সব মেরুদণ্ডী প্রাণীর আবির্ভাবের মূলে রয়েছে একটিই পূর্বসূরি। আরও পিছিয়ে গেলে পাওয়া যায় এই লুকাকে। ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, উদ্ভিদ, শৈবাল, কীটপতঙ্গ, পাখি, জলজ প্রাণী, মানুষ এবং অন্য জীবজন্তু— সকলেই বিবর্তনের শাখাপ্রশাখার বিস্তার হয়েছে লুকা-র থেকেই। বিবর্তনের বংশলতিকা বেয়ে নামতে নামতে লুকা সেই বিন্দুর প্রতিনিধিত্ব করে, যেখান প্রতিটি ডালপালা এক জায়গায় এসে মিশেছে।
জীব বিবর্তনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ হল ‘ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণ’। এটি হল আজ থেকে প্রায় ৫৩-৫৪ কোটি বছরের একটি সময়কাল। এই সময়েই পৃথিবীর বেশির ভাগ প্রাণীকূলের আবির্ভাব হয়। মেরুদণ্ডী প্রাণীরও আবির্ভাব হয় সেই সময়েই। এখান থেকেই জীবকুল দ্রুত শাখাপ্রশাখা বিস্তার করতে শুরু করে। এই সময়কালকে একটি বিস্ফোরণের সঙ্গে তুলনা করা হয়। কারণ, এর আগে পর্যন্ত জীবকুলের এমন সম্প্রসারণ ঘটেনি।
লুকার প্রথম আবির্ভাব কবে হয়, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য নেই। পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে আজ থেকে প্রায় ৪৬০ কোটি বছর আগে। বছরের পর বছর ধরে বিজ্ঞানীরা অনুমান করে আসছেন সম্ভবত আজ থেকে প্রায় ৪০০ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে লুকা আবির্ভূত হয়েছিল। অর্থাৎ, পৃথিবী সৃষ্টির ৬০ কোটি বছর পরেই। কিন্তু সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেল, এত দিন যা মনে করা হত— তার চেয়েও ২০ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে লুকা-র আবির্ভাব হয়ে গিয়েছিল।
পৃথিবীর ওই আদিম জীব কেমন ছিল, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য গবেষকদের হাতে নেই। কারণ এত আদিমকালের কোনও জীবাশ্ম এখনও সন্ধান মেলেনি। সেই সময়ের পাথরগুলির মধ্যে খুব কমই এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে। ফলে পৃথিবীর আদিম জীবের বিষয়ে তথ্যসংগ্রহ করা বেশ কঠিন। তবে আণুবীক্ষণিক ফাইলোজেনেটিক্স কৌশল ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা এই ধরনের জীবের বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। তা থেকে অনুমান করা হয়, এটি ছিল অনেকটা এক ধরনের এককোষী অণুজীবের মতো।
পরবর্তী সময়ে ব্রিটেনের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের নেতৃত্বে একটি দল অত্যাধুনিক আণুবীক্ষণিক ফাইলোজেনেটিক গবেষণা করে। তাতে দেখা যায়, প্রায় ৪২০ কোটি বছর আগে লুকার আবির্ভাব হয়েছিল। ‘নেচার ইকোলজি অ্যান্ড ইভোলিউশন’ জার্নালে সেই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে জীবিত বিভিন্ন প্রাণীর জিনের তুল্যমূল্য বিশ্লেষণ করেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা এর জন্য বিবর্তনের এক জটিল মডেলকে ব্যবহার করেন। তাতে লুকা-র আবির্ভাবের সময় নিয়ে যেমন তথ্য মিলেছে, তেমনই এই অণুজীব কেমন ছিল, তা নিয়েও বেশ কিছু আশ্চর্যজনক তথ্য উঠে এসেছে।
বিজ্ঞানীদের দাবি, এটি একটি সরল প্রোক্যারিওট (এককোষী জীব) ছিল। তবে এদের মধ্যে সম্ভবত রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাও ছিল। এই অণুজীব সেই সময়ে পৃথিবীতে একা বাস করত, এমনটাও অসম্ভব বলে মনে করছেন তাঁরা। বিজ্ঞানীদের অনুমান, লুকার বর্জ্য অন্য অণুজীবেরা খেত। যা থেকে সম্ভবত একটি বাস্তুতন্ত্র তৈরি হয়েছিল। যদিও এ বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।