উষ্ণায়নের ধাক্কায় এগিয়ে আসতে পারে পরবর্তী হিমযুগ। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
উষ্ণায়ন এবং তুষারযুগ— আপাত ভাবে দু’টি বিষয়কে বিপরীতধর্মী বলে মনে হতেই পারে। তবে আসলে তা নয়। বরং, দু’টি বিষয় পরস্পরের সঙ্গে ভীষণ ভাবে জড়িত। এমনকি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা প্রভাবিত করতে পারে তুষারযুগকেও। এগিয়ে আনতে পারে পরবর্তী তুষারযুগ। সাম্প্রতিক গবেষণায় এমনটাই দাবি করা হয়েছে।
উষ্ণায়ন বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রমশ ঘেঁটে যাচ্ছে পৃথিবীর কার্বন ডাই অক্সাইডের স্বাভাবিক চক্র। এবং তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে সমুদ্রের তলার বাস্তুতন্ত্রে। এমনটা চলতে থাকলে পৃথিবী ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে যাবে। উষ্ণায়নকে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরবর্তী হিমযুগ এগিয়ে আসতে পারে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
পৃথিবীর জলবায়ু কেমন থাকবে, তা অনেকাংশে নির্ভর করে পাথরের ক্ষয়ের উপর। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের কাছে এ তত্ত্ব অনেক আগে থেকেই স্বীকৃত। তবে গত কয়েক দশক ধরে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, জলবায়ুর উপরে শিলাক্ষয়জনিত প্রভাবের প্রক্রিয়াটি ধীর এবং নির্ভরযোগ্য প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। এটিকে এমন একটি প্রক্রিয়া হিসাবে দেখা হত, যা পৃথিবীর গড় তাপমাত্রায় খুব বেশি হেরফের হওয়া আটকায়। কিন্তু এই ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছেন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা। তাঁরা দেখিয়ে দিয়েছেন, অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলে এই প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে পৃথিবীকে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি শীতল করে তুলতে পারে এই প্রক্রিয়া। সম্প্রতি ‘সায়েন্স’ জার্নালে ওই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে।
পাথরের ক্ষয় কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে জলবায়ু? এটি আসলে একটি চক্রাকার প্রক্রিয়া। পাথরের ক্ষয়কে জলবায়ু নিয়ন্ত্রণের একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া বলা চলে। কী ভাবে চলে এই প্রক্রিয়া? বাতাসের কার্বন ডাই অক্সাইড সহজেই জলীয় বাষ্পের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। পরে সেই কার্বন ডাই অক্সাইড বৃষ্টির সঙ্গে ভূপৃষ্ঠে নামে আসে। এই বৃষ্টির জল যখন কোনও পাথরের উপরে, বিশেষ করে গ্রানাইটের মতো সিলিকেট শিলার উপরে পড়ে— তা এক রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটায় এবং পাথর ক্ষয়ে যেতে থাকে।
তার পরে ওই ক্ষয়ে যাওয়া পাথর গিয়ে মেশে সমুদ্রে। ওই পাথরের সঙ্গে মিশে থাকা কার্বনও সমুদ্রে মিশে যায়। সমুদ্রের নীচে তা-ই ক্যালসিয়ামের সঙ্গে মিশে তৈরি করে চুনাপাথরের প্রবাল প্রাচীর। সমুদ্রগর্ভে তা জমতে থাকে। এবং লক্ষ লক্ষ বছর ধরে কার্বনকে সমুদ্রগর্ভে আটকে রাখে। ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমে যায়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষকদলের প্রধান অ্যান্ডি রিজ়ওয়েলের কথায়, “পৃথিবী যত উষ্ণ হবে, পাথরও তত দ্রুত ক্ষয় হবে। ফলে আরও বেশি পরিমাণে কার্বন সমুদ্রে জমা হবে। এতে পৃথিবী আবার শীতল হয়ে যাবে।”
বস্তুত, পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত অনেকগুলি তুষারযুগ এসেছে। বিশ্বের প্রাচীনতম হিমযুগগুলি অনেক বেশি তীব্র ছিল। ওই সময়ে প্রায় গোটা পৃথিবীই বরফ এবং তুষারে ঢেকে গিয়েছিল। কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, সেই প্রশ্ন থেকেই এই গবেষণার সূত্রপাত। এত দিন গবেষকদের ধারণা ছিল, শিলাক্ষয়ের মাধ্যমে জলবায়ু নিয়ন্ত্রণের এই প্রাকৃতিক ব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয় ভাবে তাপমাত্রার মধ্যে একটি ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে। তবে প্রাচীন হিমযুগগুলি কেন এত চরম ছিল, সেই ব্যাখ্যা মেলেনি শিলাক্ষয়ের মাধ্যমে জলবায়ু নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা থেকে। সেই সূত্র ধরেই গবেষণায় নতুন তথ্য উঠে আসে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের হাতে।
নতুন গবেষণায় সমুদ্রগর্ভের কার্বন চক্র বিশ্লেষণ করে দেখেন বিজ্ঞানীরা। তাতে দেখা যায়, এর সঙ্গে সরাসরি যোগ রয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের। তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড বৃদ্ধির ফলে শিলাক্ষয়ও বেশি হয়। একই সঙ্গে প্রচুর ফসফরাসও ধুয়ে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে। এই ফসফরাস প্রচুর পরিমাণে প্ল্যাঙ্কটন (জলজ পরিবেশে ভেসে থাকা ক্ষুদ্র উদ্ভিদের সমষ্টি)-কে পুষ্টি জোগায়। ফলে সমুদ্রে প্ল্যাঙ্কটনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এই প্ল্যাঙ্কটন সালোকসংশ্লেষের মাধ্যমে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে। মারা যাওয়ার পরে এগুলি ডুবে যায় সমুদ্রের তলায়। একই সঙ্গে এদের মধ্যে থাকা কার্বনও সমুদ্রের তলায় জমে যায়। ফরে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড কমে গিয়ে তা সমুদ্রের নীচে জমা হতে থাকে।
তবে উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে এই প্রক্রিয়া বদলে যেতে পারে। সমুদ্রে প্ল্যাঙ্কটন বৃদ্ধি পেয়ে তা অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে। অক্সিজেন কমে যাওয়ায় সমুদ্রের তলায় চাপা পড়ে যাওয়া ফসফরাস আবার জলে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে। এই ফসফরাস সমুদ্রে প্ল্যাঙ্কটন আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। সেগুলি মারা যাওয়ার পরে অক্সিজেনের মাত্রা আরও কমে আসবে। ফলে প্ল্যাঙ্কটন বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চক্রাকারে চলতে থাকবে। এমনটা হতে থাকলে বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাই অক্সাইড প্রচুর পরিমাণে সমুদ্র গর্ভের কার্বন হিসাবে জমতে থাকবে। ফলে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা কমে জলবায়ুকে শীতল করে তুলতে পারে। এমনকি পরবর্তী হিমযুগকে আরও এগিয়ে আনতে পারে।
যদিও পরবর্তী হিমযুগ এগিয়ে আসতে পারে কি না, সেটি বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে ‘গৌণ’ বলেই মনে করছেন গবেষকদলের প্রধান রিজ়ওয়েল। বরং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কী ভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, সেটিই আগে দেখা উচিত বলে মনে করছেন তিনি। রিজ়ওয়েলের কথায়, “পরবর্তী তুষারযুগ ৫০ হাজার, ১ লক্ষ নাকি ২ লক্ষ বছর পরে শুরু হবে— তাতে কি দিনের শেষে আমাদের খুব বেশি কিছু যায় আসে? আমাদের এখন দেখতে হবে উষ্ণায়নকে কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সে দিকেই মন দিতে হবে। এক সময় না এক সময় পৃথিবী আবার শীতল হয়ে যাবে— তা সে যতই ধীর গতিতে হোক না কেন।”