Cloud Seeding

বিসমিল্লায় গলদ? দূষণ ঠেকাতে দিল্লির মেঘে বীজ বুনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর ভাবনাই ‘ভুল’, মত বিশেষজ্ঞদের

‘ক্লাউড সিডিং’ নিয়ে পাঁচটি পরীক্ষার জন্য কানপুর আইআইটি-র সঙ্গে ৩.২১ কোটি টাকার সমঝোতাপত্র স্বাক্ষর করেছিল দিল্লির সরকার। ইতিমধ্যেই তিনটি পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এক বারও বৃষ্টি নামেনি রাজধানীতে।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:৫৫
Share:

দিল্লিতে ব্যর্থ ‘ক্লাউড সিডিং’। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

বিসমিল্লাতেই গলদ থেকে গিয়েছে! যে কারণে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানো গেল না দিল্লিতে। প্রথমত, শীতকালে রাজধানী শহরে ‘ক্লাউড সিডিং’ সম্ভবই নয়। দ্বিতীয়ত, দূষণ রোধে কৃত্রিম বৃষ্টির ভাবনাই ভুল। এতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় বলেই মত বিশেষজ্ঞদের একাংশের।

Advertisement

শীতে দিল্লিতে বায়ুদূষণ নতুন কিছু নয়। মূলত দীপাবলির পর থেকেই বিষধোঁয়ায় ঢেকে যায় রাজধানী। বিভিন্ন এলাকার বাতাসের গুণমানের গড় সূচক পৌঁছে যায় চারশোর কাছাকাছিতে, পরিবেশবিদদের মতে যা ‘ভয়াবহ’। এই সমস্যা নির্মূল করতে দিল্লিতে অনেক দিন ধরেই কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর কথা ভাবা হচ্ছিল। এর জন্য সম্প্রতি বিপুল পরিমাণ টাকাও ঢেলেছে দিল্লির সরকার। এ ধরনের পাঁচটি পরীক্ষা করার জন্য কানপুর আইআইটি-র সঙ্গে ৩.২১ কোটি টাকার সমঝোতাপত্র স্বাক্ষরিত হয়। ইতিমধ্যে তিনটি পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এক বারও বৃষ্টি নামেনি দিল্লিতে।

অতীতে নানা জায়গায় কৃত্রিম বৃষ্টি নামানো হয়েছে। মূলত খরা অধ্যুষিত অঞ্চলে জলের জোগান বাড়াতেই তা করা হয়। ভারতে মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু এবং কর্নাটকের মতো রাজ্যে এই প্রক্রিয়ার সফল প্রয়োগ দেখা গিয়েছে। ২০০৮ সালে বেজিং অলিম্পিক্সের সময় এই প্রক্রিয়ায় শহরের বাতাসের গুণগত মান বৃদ্ধি করেছিল চিনের সরকারও। কিন্তু দিল্লিতে তা কেন সফল হল না, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তবে মূল যে কারণটির কথা উঠে আসছে, তা হল— শীতে দিল্লির বাতাসে আর্দ্রতার ঘাটতি।

Advertisement

ক্লাউড সিডিং কী?

কৃত্রিম মেঘ তৈরি করে বৃষ্টি ঝরানোর এই পদ্ধতিকেই ‘ক্লাউড সিডিং’ বলে। এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে কৃত্রিম বৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে প্রথমে আবহাওয়ায় খানিকটা বদল ঘটানো হয়। মূলত ড্রোন বা বিমানের সাহায্যে মেঘের উপর ছড়িয়ে দেওয়া হয় সিলভার আয়োডাইড জাতীয় রাসায়নিক, ড্রাই আইস কিংবা ভোজ্য লবণ। এর পর ক্যালশিয়াম ক্লোরাইড এবং ক্যালশিয়াম অক্সাইডের মিশ্রণের প্রলেপ দেওয়া হয় মেঘের গায়ে। এতে শুকনো মেঘের আর্দ্রতা বেড়ে যায়। মেঘ আয়তনে এবং ওজনেও ভারী হয়। পরে তা জলভরা মেঘে পরিণত হয় এবং কিছু ক্ষণ পরে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে।

কখনও কখনও আবার মেঘের জল কম উষ্ণতায় জমে গিয়ে স্ফটিকের মতো বরফকণায় পরিণত হয়। তখনও একই ভাবে বিমান থেকে রাসায়নিক ছিটিয়ে মেঘের মধ্যে জমে থাকা জল বা বরফকণার অতিশীতল অবস্থা নষ্ট করে দেওয়া হয়। বরফ পরিণত হয় জলকণায়। তাতে মেঘের জলধারণ ক্ষমতা কমে এবং মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে মাটিতে ঝরে পড়ে বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে।

কেন ব্যর্থ হল দিল্লিতে?

বিশেষজ্ঞদের মত, এই ধরনের কৃত্রিম বৃষ্টি যে কোনও মেঘে সম্ভব নয়। এর জন্য মেঘে ৫০-৬০ শতাংশ আর্দ্রতা থাকা প্রয়োজন। এই বিশেষ ধরনের মেঘ যখন তখন পাওয়া যায় না দিল্লিতে। দীপাবলির পর শীতের আবহে, অক্টোবর থেকে জানুয়ারি মাসের মধ্যে তো নয়ই। এই সময় দিল্লির আবহাওয়া শুষ্ক থাকে। কুয়াশা থাকে বাতাসে। তার চেয়েও বড় কথা, মেঘও ভীষণ পাতলা হয়। এই আবহাওয়ায় কৃত্রিম বৃষ্টি হয় না। সঠিক আবহাওয়া পাওয়া যায় একমাত্র প্রাক্‌বর্ষা বা বর্ষা বিদায় নেওয়ার পর পর। তখনও যে কৃত্রিম বৃষ্টি নামবেই, তা-ও জোর দিয়ে বলা যায় না। সম্ভাবনা বড়জোর ৫০ শতাংশ।

দিল্লিতে ‘ক্লাউড সিডিং’-এর দায়িত্বে থাকে আইআইটি কানপুরের ডিরেক্টর মণীন্দ্র আগরওয়াল বলেন, ‘‘শেষ ক্লাউড সিডিংয়ের সময় মেঘের আর্দ্রতা ছিল মাত্র ১৫ শতাংশ। মেঘের আর্দ্রতা এত কম থাকলে বৃষ্টির সম্ভাবনা এমনিতেই কম থাকে। তাই আমাদের পরীক্ষা সফল হয়নি।’’

যদিও এই ব্যর্থতাকে ভবিষ্যতের জন্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হিসেবেই দেখছেন আইআইটি-র ডিরেক্টর। মণীন্দ্রের কথায়, ‘‘মেঘের আর্দ্রতা কম থাকা সত্ত্বেও যখন ক্লাউড সিডিং করা হয়, তখন পরিবেশের উপর অল্প হলেও প্রভাব পড়ে। আশানুরূপ ফলাফল হয়তো মেলে না, তবে কিছু প্রভাব তো পড়েই। এ ক্ষেত্রেও ১৫টি কেন্দ্রের তথ্য সংগ্রহ করে দেখা গিয়েছে, বাতাসে পিএম ২.৫ এবং পিএম ১০-এর ঘনত্ব ৬ থেকে ১০ শতাংশ কমে গিয়েছে।’’ ভবিষ্যতে এই ধরনের পরীক্ষা করতে গেলে এই পর্যবেক্ষণ কাজে লাগবে বলে মনে করছেন গবেষকেরা।

হিতে বিপরীত!

যদিও বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত, ঠান্ডার দিনে কৃত্রিম বৃষ্টি দূষণ তো কমাবেই না। উল্টে তা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। তাঁদের যুক্তি, ঠান্ডা আবহাওয়ায় হালকা বৃষ্টি হলে, বাতাসে থাকা অতি ক্ষুদ্র ক্ষতিকর ধূলিকণা (পিএম ২.৫) বৃষ্টির ছোট ছোট ফোঁটার সঙ্গে মিশে যায়। যার ফলে বাতাসে এক ধরনের অ্যারোসোল (পরিবেশ বিজ্ঞানের পরিভাষায় সেকেন্ডারি অ্যারোসোল) তৈরি হয়। বৃষ্টি বন্ধ হলে আবার সেই সব অ্যারোসোল অর্থাৎ কণা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। এতে ‘পিএম’ বেড়ে যায়, অর্থাৎ দূষণ বাড়ে। ফলে অল্প বৃষ্টিতে কখনওই দূষণ ঠেকানো সম্ভব নয়। দরকার ভারী বৃষ্টি, যা সম্ভব নয় ক্লাউড সিডিংয়ে।

‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’-এর গবেষক অনুমিতা রায়চৌধুরী বলছেন, ‘‘ক্লাউড সিডিং-এর পরেও দিল্লিতে এখনও উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত হয়নি। তবে এটা স্পষ্ট যে, বৃষ্টিতে দূষণবর্ধক উপাদানের পরিমাণ পরিমাণ সাময়িক ভাবে কমলেও দূষণ দ্রুত ফিরবে।’’

প্রতিকার কী?

শীতে দিল্লির বায়ুদূষণের কারণ হিসাবে মূলত দায়ী করা হয় খেতের আগাছা পোড়ানোকে। এ নিয়ে রাজনৈতিক তরজাও চলে নিরন্তর। রবি মরসুম শুরু হওয়ার আগে পঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের চাষিরা খেতের আগাছা পুড়িয়ে ফসলের জমি তৈরি করে থাকেন। ওই সময়ে বায়ুপ্রবাহের অভিমুখ দিল্লির দিকে থাকায় আগাছা পোড়ানো ধোঁয়ার চাদর জাতীয় রাজধানী অঞ্চলের আকাশে দীর্ঘ সময় থাকতে দেখা যায়। তার সঙ্গে দীপাবলির বাজির ধোঁয়া। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের অনেকের মত, এ সবই সাময়িক কারণ। আসল কারণ দিল্লির যানবাহন। রাজধানীর বাতাসে যে সব ক্ষতিকর ধূলিকণা রয়েছে, তার ৪০ শতাংশের বেশি আসে গাড়ির ধোঁয়া থেকে। তাতে লাগাম দেওয়াই সবচেয়ে বেশি জরুরি।

‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভানস্ড স্টাডিজ’-এর অধ্যাপক সংবাদপত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে লিখেছেন, ‘‘দিল্লির বায়ুদূষণের সমস্যাকে শুধু দিল্লির সমস্যা হিসাবে দেখলে চলবে না। দিল্লি-সহ আশপাশের এলাকাকেও দূষণ আটকানোর পরিকল্পনার মধ্যে আনতে হবে। তার জন্য জ্বালানির ব্যবহার আগে কমাতে হবে। বাড়াতে হবে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement