বিষেও কেন বেপরোয়া মশা, পাকড়াও জিন

বিশ্ব জুড়ে অ্যানোফিলিস মশা ডিডিটি এবং অন্যান্য কীটনাশককে হজম করে কী ভাবে বেঁচে থাকছে সেই রহস্য তাঁরা উদ্ঘাটন করে ফেলেছেন বলে দাবি একদল ব্রিটিশ গবেষকের। জিনোম বায়োলজি জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধে লিভারপুল স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ওই গবেষকেরা দাবি করেছেন, মাত্র একটি জিনের গঠনগত পরিবর্তন অ্যানোফিলিস মশার দেহে ঢোকা কীটনাশকের রাসায়নিক পরিবর্তন করে দিচ্ছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২৩:১৬
Share:

বিশ্ব জুড়ে অ্যানোফিলিস মশা ডিডিটি এবং অন্যান্য কীটনাশককে হজম করে কী ভাবে বেঁচে থাকছে সেই রহস্য তাঁরা উদ্ঘাটন করে ফেলেছেন বলে দাবি একদল ব্রিটিশ গবেষকের।
জিনোম বায়োলজি জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধে লিভারপুল স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ওই গবেষকেরা দাবি করেছেন, মাত্র একটি জিনের গঠনগত পরিবর্তন অ্যানোফিলিস মশার দেহে ঢোকা কীটনাশকের রাসায়নিক পরিবর্তন করে দিচ্ছে। যার ফলে মশা কীটনাশককে অনায়াসে হজম করে ফেলছে। মশার শরীরে কীটনাশকের কোনও প্রভাবই পড়ছে না।
সত্তরের দশক পর্যন্ত ভারত এবং অন্য দেশে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের অন্যতম হাতিয়ার ছিল ডিডিটি। ডিডিটি ছড়িয়েই ষাটের দশকে ভারতকে ম্যালেরিয়ামুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। সত্তরের দশকের পর থেকে থেকে গেল নিয়মিত ডিডিটি ছড়ানোর পরেও ম্যালেরিয়া ফিরে আসছে। ভারতই নয়, আফ্রিকা এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও দেখা গেল ম্যালেরিয়া ফিরে আসছে প্রবল ভাবে।
বিজ্ঞাণী-গবেষকেরা দেখলেন, অ্যানোফিলিস মশা দিব্যি তাদের মারনবাণ ডিডিটি-কে হজম করে ফেলছে। এর পরেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মশা মারার তেল হিসেবে ডিডিটি-র ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। পরবর্তী কালে দেখা যায়, ডিডিটি-র পরিবর্ত কীটনাশক পাইরেথ্রয়েডও আর মশার দেহে কাজ করছে না। ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি এর ফলে পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়েছে বিভিন্ন দেশে। ম্যালেরিয়া ফিরে এসেছে প্রবল ভাবে।

Advertisement

ভোঁতা ডিডিটি

Advertisement

অ্যানোফিলিস মশার জিনগত পরিবর্তনের জন্যই যে ওই মশা ডিডিটি প্রয়োগে আর মরছে না তা জানা গিয়েছিল আগেই, কিন্তু সেই জিনটিকে চিহ্নিত করা যাচ্ছিল না। লিভারপুল স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের গবেষকদের দাবি, তাঁরা ওই জিনটিকে চিহ্নিত করে ফেলেছেন। তাঁরা দেখেছেন, পরিবেশগত পরিবর্তনে অ্যানোফিলিস মশার জিএসটি(ই)-২ নামের জিনটির এক বার রাসায়নিক পরিবর্তন (মিউটেশন) হলেই তা ডিডিটি-কে নির্বিষ পদার্থে ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা রাখছে। তার ফলে ওই মশা ডিডিটি প্রতিরোধী হয়ে পড়ছে।
অ্যানোফিলিস ফিউনেসটাস প্রজাতির মশা নিয়ে কাজ করলেও গবেষকদলের প্রধান চার্লস ওন্ডজি-র দাবি, সব প্রজাতির অ্যানোফিলিস মশার ক্ষেত্রেই ওই জিনগত পরিবর্তনই তাদের ডিডিটি প্রতিরোধী করে তুলেছে। জিনোম বায়োলজি জার্নালে প্রকাশিত তাঁদের নিবন্ধে চার্লস বলেছেন, পরিবর্তিত (মিউটেটেড) জিনটি এক ধরনের মাছি (ড্রসোফিলা)-র শরীরে ঢুকিয়ে দেখা গিয়েছে, সেই মাছিও ডিডিটি প্রতিরোধী হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ পরিবর্তিত জিনটি-র মধ্যেই যে ডিডিটি-কে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তৈরি হয়েছে, তা নিশ্চিত। গবেষকদের দাবি, অ্যানোফিলিস মশার ওই জিনগত পরিবর্তনের ফলে শরীরের যে সব প্রোটিন তৈরি হচ্ছে তারা ডিডিটি-র বিষ নষ্ট করে দিচ্ছে।
ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের এই গবেষণার ফল কতটা সুদূরপ্রসারী হবে তা নিয়ে এদেশের বিজ্ঞানী মহলে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ এই গবেষণার সফল প্রয়োগ কতটা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অনেক আবার নতুন আশার সন্ধান পাচ্ছেন।
কলকাতার ইনস্টিটিউট অব কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজি (নাইসেড)-য়ের অধিকর্তা শেখর চক্রবর্তী বলেন, “ডেঙ্গি ও ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে মশার জিনগত পরিবর্তন নিয়ে নানা ধরনের কাজ হচ্ছে। গবেষণাগারে পরীক্ষা সফল হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে তা অনেক সমস্যার সৃষ্টি করছে। এক্ষেত্রেও যে তা হবে না তা কে বলতে পারে?”
এ প্রসঙ্গে উদাহরণ টেনে শেখরবাবু বলেন, অনেক গবেষণাগারেই এমন ধরনের মশা গবেষকেরা তৈরি করেছেন যা ডেঙ্গি বা ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহনই করতে পারে না। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাদের প্রয়োগ যথাযথ করা সম্ভব হয়নি। তাই লিভারপুলের গবেষকদের কাজ নিয়ে এখনই এত মাতামাতি করার পক্ষপাতী নন ওই বিজ্ঞানী।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজি (আইআইসিবি)-র সিনিয়র প্রিন্সিপাল সায়েন্টিস্ট রূপক ভদ্র আবার ওই গবেষণার ফল নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী। তিনি বলেন, লিভারপুলের ওই গবেষকদের দাবি যদি সত্যি হয় তবে ডিডিটি-র রাসায়নিক গঠনের কিছু পরিবর্তন আনতে পারলেই ফের ওই কীটনাশককে ম্যালেরিয়া দমন প্রক্রিয়ায় সফল ভাবে কাজে লাগানো সম্ভব। রূপকবাবু বলেন, “ডিডিটি-র রাসায়নিক গঠনটি ওই নির্দিষ্ট জিনটির চেনা। তাই ডিডিটি-র রাসায়নিক গঠনের কিছু পরিবর্তন ঘটাতে পারলেই ওই জিন নতুন রাসায়নিকটিকে আর চিনতে পারবে না।” আইআইসিবি-র ওই বিজ্ঞানী বলেন, “মশার বংশবৃদ্ধি আর কোনও ভাবেই যখন রোধ করা সম্ভব নয় তখন কিন্তু কীটনাশকের সফল প্রয়োগের উপরেই আমাদের নির্ভর করতে হবে।”
নতুন কীটনাশক হজম করে ফেলার মতো জিনও হয়তো তৈরি হয়ে যাবে ভবিষ্যতে। যত দিন তা না হচ্ছে, তত দিন অন্তত ম্যালেরিয়া ডেঙ্গু দমনে কাজে আসতে পারে এই পথ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন