ঠিক কত ক্ষণ লড়াই করেছিলাম, খেয়াল নেই। দু’তিন মিনিট হবে। কিন্তু সেটাই মনে হয়েছিল অনন্ত সময়। ভালুকটা আমার মুখে, বুকে আর পায়ে থাবার পর থাবা বসাচ্ছিল। দম বন্ধ হয়ে আসছিল অসহ্য যন্ত্রণায়। মনে হচ্ছিল, সব বুঝি শেষ হয়ে গেল। প্রাণপণে ওর গলাটা টিপে ধরার চেষ্টা করছিলাম।
আঘাত আর আতঙ্কের সেই রক্তাক্ত স্মৃতি যেন হঠাৎ কণ্ঠ চেপে ধরল। হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে চোখ বুজে ফেললেন রাসবিহারী দাস অধিকারী। কলকাতা সশস্ত্র পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইনস্পেক্টর।
গ্যাংটকে ভোটের কাজে গিয়ে ভালুকের থাবায় গুরুতর আহত রাসবিহারীবাবুর শারীরিক অবস্থা আপাতত স্থিতিশীল। আজ, সোমবার তাঁর ক্ষতস্থানের সেলাইগুলি পরীক্ষা করা হবে। তাঁর মুখে, মাথায়, বুকে, পায়ে ৯০টি সেলাই পড়েছে।
চিকিৎসকেরা জানান, ভালুকের সঙ্গে লড়াই করে রাসবিহারীবাবু অসীম সাহসের পরিচয় দিলেও এখনও তিনি ‘ট্রমা’র মধ্যে রয়েছেন। ওই ঘটনার কথা ভেবে শিউরে উঠছেন বারে বারেই। কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যাওয়া এবং চোখ বুজে ফেলাটা সেই ত্রাসেরই জের। ক্ষত শুকোনোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ওই আতঙ্ক কাটিয়ে ওঠাটাও অত্যন্ত জরুরি, বলছেন চিকিৎসকেরা।
ভোটের কাজে গ্যাংটকে গিয়ে শুক্রবার সকালে পাহাড়ি ভালুকের মুখে পড়েন রাসবিহারীবাবু। বন্যজন্তুর সঙ্গে অসম লড়াইয়ে কোনও মতে বেঁচে গিয়েছেন। ভালুকের হঠাৎ-হানায় কোমরে গোঁজা পিস্তলটিও বার করার সুযোগ পাননি ওই এএসআই। লড়ে গিয়েছেন স্রেফ দু’টো হাতের জোরে। তাঁর এই সাহসিকতায় কলকাতায় তাঁর সহকর্মীরাও গর্বিত। শনিবার রাত থেকে তাঁরা দফায় দফায় হাসপাতালে গিয়ে অভিনন্দন জানিয়ে আসছেন এই পুলিশ অফিসারকে।
শনিবার রাতে রাসবিহারীবাবুকে গ্যাংটক থেকে কলকাতায় আনা হয়। আপাতত আলিপুরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন তিনি। ওই হাসপাতালের তরফে মারিও মার্টিন লুইস জানান, ঘটনার কথা শোনার পরে তাঁদের মনে হয়েছিল, ওঁকে ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে রাখা জরুরি। সেই অনুযায়ী তাঁরা শয্যার ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন। তবে হাসপাতালে আসার পরে কয়েকটি পরীক্ষানিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ওই পুলিশ অফিসারকে জেনারেল ওয়ার্ডেই রাখা হবে। লুইস বলেন, “রাসবিহারীবাবু কথাবার্তা বলছেন। খাওয়াদাওয়াও করছেন। তবে ভালুকের আতঙ্কটা এখনও রয়েছে। ওঁর স্ত্রী এবং সহকর্মীরা ওঁকে সব সময়ে সাহস জুগিয়ে চলেছেন।”
ঠিক কী হয়েছিল শুক্রবার?
৫৭ বছরের রাসবিহারীবাবু জানাচ্ছেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েই গ্যাংটকে গিয়েছিলেন তিনি। ভোট শুরু হওয়ার ঘণ্টাখানেক আগে তিনি যখন ভোটকর্মীদের পরবর্তী ধাপের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, ঘটনাটা ঘটে তখনই।
ওই পুলিশ অফিসারের কথায়, “তাসি নামগিয়াল অ্যাকাডেমি স্কুলে ডিউটি ছিল। ওখানে পুলিশ বুথের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখি, কয়েক হাত দূরে একটা বিশাল কালো ভালুক। কয়েক মুহূর্তের জন্য গোটা পৃথিবীটা দুলে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, আমার জীবন ওখানেই শেষ। পলকের মধ্যে ভালুকটা গজরাতে গজরাতে আমার কাছে এসে আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়।”
সেই সময় আশপাশটা ফাঁকাই ছিল। দম বন্ধ করা আতঙ্ক চেপে ধরলেও আত্মরক্ষার সহজাত তাগিদে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি উচ্চতার দোহারা চেহারার রাসবিহারীবাবু। তাঁর আর্তনাদ শুনে অন্য নিরাপত্তারক্ষীরা ছুটে আসেন। একসঙ্গে অনেক লোকজন দেখে ভালুকটি রণে ভঙ্গ দেয়। তত ক্ষণে রাসবিহারীবাবুকে ফালাফালা, রক্তাক্ত করে দিয়েছে সে। গ্যাংটকের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসায় শারীরিক অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হওয়ার পরে ওই পুলিশ অফিসারকে কলকাতায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
৩৫ বছরের চাকরিজীবনে অনেক বার বিপদের মুখে পড়েছেন রাসবিহারীবাবু। কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে সেগুলোর কোনও তুলনাই চলে না বলে মনে করছেন তাঁর স্ত্রী কল্যাণীদেবী। চিকিৎসক এবং সহকর্মীরা প্রত্যেকেই রাসবিহারীবাবুর সাহসিকতা নিয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তবে সহকর্মীরা ছুটে না-এলে কী ঘটে যেতে পারত, ভেবে আতঙ্ক কাটছে না রাসবিহারীবাবুর। কল্যাণীদেবীরও।