টোকিও যেতে পারেন সাংবাদিক হিসেবে

শেষ মুহূর্তের দুর্ঘটনা কেড়ে নিল অভিনব পদক স্বপ্ন

যে শ্যুটিং রেঞ্জে তিনি ফাইনালে নেমেছিলেন তাঁর আলো কম ছিল। সেটা জেনেই বিদেশ থেকে আনা ‘সাইট’ ব্যবহার করার জন্য তা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এই কাচের সাইটটা রাইফেলের সঙ্গে থাকলে লক্ষ্যটা অনেক স্পষ্ট হয়। আলো সমস্যা কমে যায় এক জন শ্যুটারের। কিন্তু ১০ মিটারের ইভেন্ট শুরুর আগেই ঘটে দুর্ঘটনা।অভিনব বিন্দ্রা কি আগেই বুঝে গিয়েছিলেন তাঁর পদক পাওয়ার সম্ভবনা কমে গিয়েছে? প্রায় দু’ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর পাঁচ বারের অলিম্পিয়ান একেবারে অন্য মুডে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এ ব্যাপারে অবশ্য কিছু বলেননি।

Advertisement

রতন চক্রবর্তী

রিও দে জেনেইরো শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৬ ০৪:৪৪
Share:

অভিনব বিন্দ্রা

অভিনব বিন্দ্রা কি আগেই বুঝে গিয়েছিলেন তাঁর পদক পাওয়ার সম্ভবনা কমে গিয়েছে?

Advertisement

প্রায় দু’ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর পাঁচ বারের অলিম্পিয়ান একেবারে অন্য মুডে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এ ব্যাপারে অবশ্য কিছু বলেননি। শুধু বলেছেন, ‘‘কোনও অজুহাত দিতে চাই না। শুধু এটুকু বলতে চাই যে ভাবে শেষ করলাম তাতে আমি তৃপ্ত।’’

দেশের একমাত্র সোনাজয়ী অ্যাথলিটের ঘনিষ্ঠ বৃত্ত থেকে কিন্তু অন্য খবর বেরিয়ে আসছে। যে শ্যুটিং রেঞ্জে তিনি ফাইনালে নেমেছিলেন তাঁর আলো কম ছিল। সেটা জেনেই বিদেশ থেকে আনা ‘সাইট’ ব্যবহার করার জন্য তা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এই কাচের সাইটটা রাইফেলের সঙ্গে থাকলে লক্ষ্যটা অনেক স্পষ্ট হয়। আলো সমস্যা কমে যায় এক জন শ্যুটারের। কিন্তু ১০ মিটারের ইভেন্ট শুরুর আগেই ঘটে দুর্ঘটনা। যে টেবিলে অভিনব রাইফেল এবং সাইটটা রেখেছিলেন, জামা-কাপড় বদলানোর সময় সেটা হঠাৎ-ই ভেঙে পড়ে। ভেঙে যায় কাচের সাইটটাই। ফলে শুরুতেই ধাক্কা খায় অভিনবর এত দিনের চেষ্টা। স্বাভাবিক ভাবেই আলোর সমস্যা ফের চলে আসে অভিনবের। ভারতবাসীর তাঁর হাতে পদক জয়ের স্বপ্ন দেখাও শেষ হয়ে যায় এই ঘটনাতেই।

Advertisement

আলোর সমস্যাই কি আপনার কাল হয়ে দাঁড়াল? অভিনব বললেন, ‘‘টার্গেটে রাখতে চেয়েছিলাম। মেরেওছিলাম। হল না। কী করা যাবে। এটাই তো জীবন। মেনে নিতেই হবে।’’ শ্যুটিং রেঞ্জে যে রকম বিরক্তি আর হতাশা নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলাম, এই অভিনবের সঙ্গে তাঁকে মেলানো যাচ্ছিল না। শান্ত, আবেগহীন একটা মানুষ। বহু সেরা অ্যাথলিটের অবসর দেখেছে ভারত। কত কথা, কত জ্ঞান বিতরণ, কত উপদেশ, কত কান্নাও দেখছে বা শুনেছে। কিন্তু অলিম্পিক্সের এক নম্বর অ্যাথলিটের অবসর নেওয়ার দিনের সঙ্গে মনে হয় কারও কোনও তুলনা হয় না।

এমনিতেই অভিনবর সাক্ষাৎকার নেওয়া মানে নির্ভেজাল কিছু ভাল ভাল কথা। বিতর্কহীন শব্দ। এ দিনও তাঁর ব্যতিক্রম হয়নি ঠিক। তবে তিনি দেখিয়েছেন অবসরের দিনও কী ভাবে নির্লিপ্ত থাকা যায়।

পাঁচটা অলিম্পিক্সে নামলেন। তিনটেতে ফাইনালে উঠেছেন। একটায় সোনা জিতেছেন। আপনি শেষ অলিম্পিক্সে চার নম্বর হয়ে তৃপ্ত? ‘‘আরও ভাল করলে হয়তো ভাল হত। টার্গেটে মেরেওছিলাম। আমাদের খেলায় এটাই মজা। কিন্তু চার নম্বর হয়েছি তাতে কোনও আক্ষেপ নেই। অবসর নেওয়ার সময়টা ভালই হল। কোনও আক্ষেপ নেই।’’ মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। ভারতের নীল জার্সি গায়ে চাপিয়ে এসেছিলেন এ দেশের খেলাধুলার অন্যতম আইকন। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, দেশের পতাকাবাহক হিসাবে শেষ অলিম্পিক্সটা উপভোগ করলেন তা হলে? ‘‘আমি মার্চপাস্টে এমনিতে থাকি না। যখন আমাকে বলা হল পতাকাবাহক হতে হবে তখন রাজি হলাম। এটা তো সম্মানের।’’

গেমস ভিলেজে ফিরে গিয়ে এর পর অন্য অ্যাথলিটদের কি কোনও টিপস দেবেন? ‘‘ওটা তো কোচেদের কাজ। তাঁরাই দেবেন। আমাদের দেশের কোচেরা যথেষ্ট ভাল। তারাই ভাল বলতে পারবেন কী ভাবে এগোলে সাফল্য পাওয়া যাবে,’’ বলে দেন অভিনব। কিন্ত যে শ্যুটারদের দিকে তাঁকিয়ে আছে গোটা দেশ, সেই জিতু রাই, হিনা সিধুরা একের পর এক ইভেন্টে ব্যর্থ হচ্ছেন। লিয়েন্ডার পেজের একেবারে বিপরীত রাস্তায় হাঁটলেন অভিনব। লিয়েন্ডার অভিযোগ করেছিলেন, ‘‘জুনিয়ররা আমাকে টেনে নামানোর চেষ্টা করছে।’’ আর অভিনব বললেন, ‘‘জুনিয়রদের সম্পর্কে আমার মন্তব্য করাটা ঠিক নয়। চেষ্টা তো করছেই। অপেক্ষা করুন।’’

অবসরের পর আপনার লক্ষ্য কী? অনেকেই ভেবেছিলেন চৌত্রিশের বিন্দ্রা তাঁর বিদেশি বান্ধবীকে বিয়ে করার কথা বলবেন। কিন্তু সে দিকে পা বাড়ালেনই না সোনার ছেলে। ‘‘এই প্রশ্নটা করা এখন একেবারেই ঠিক নয়। খারাপ প্রশ্ন। আমি সবে অবসর নিলাম। এখনও পরের প্ল্যানিংটাই ঠিক করিনি। আজকের দিনটা উপভোগ করতে দিন।’’

দেহরাদূনে আপনার বাবা যে আড়াই একরের শুটিং রেঞ্জ তৈরি করে দিয়েছেন, আপনি শ্যুটিং ছেড়ে দেওয়ার পর সেখানে এখন কী হবে? হাসতে হাসতে মজা করে অভিনব বলে দেন ‘‘ভেজিটেবল প্ল্যান্ট করব। গাছ লাগাব। শ্যুটিং যখন ছেড়ে দিচ্ছি দূষণ রুখতে গাছ বসাব।’’ অভিনব বিন্দ্রার মতো অ্যাথলিট রাইফেল তুলে রাখছেন, ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, কোনও অ্যকাডেমি করার ইচ্ছে নেই? ‘‘আমার যে ফাউন্ডেশন আছে সেখানে ৩০ জনকে সাহায্য করা হয় প্রতি বছর। এর বাইরে আর কোনও পরিকল্পনা নেই এখন।’’ তা হলে কোচ হওয়ার ইচ্ছে নেই? ‘‘আমার তো সেই ক্ষমতাই নেই। যোগ্যতাও নেই। কোচ হওয়া তো কঠিন কাজ।’’ কিন্তু কর্তা হিসাবেও তো অভিনবকে পেতে পারে দেশ। এ বার ফর্সা মুখে আরও হাসি ছড়িয়ে জবাব এল, ‘‘না, না, সেই ক্ষমতাও আমার নেই। আমি নিজেই খুব আগোছালো মানুষ। এ সব করতে গেলে অনেক গোছালো হতে হয়।’’

অবসর ভেঙে ফিরে আসার কোনও পরিকল্পনা? টোকিও অলিম্পিক্সে কি আপনাকে দেখা যাবে? এ বার বেশ সিরিয়াস অভিনব। ‘‘আমি অনেক ভেবে চিন্তেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যদি টোকিওয় যাই সাংবাদিক হিসাবে যাব। কেউ যদি নিয়ে যায়।’’ শেষ লাইন দুটো বলে হাসলেন এক বার।

শেষ প্রশ্নটা করা হল এই ভাবে। দীর্ঘ বর্ণময় জীবন আপনার। কিন্তু অবসর নেওয়ার পরও আপনি এমন নির্লিপ্ত? ‘‘মানিয়ে নেওয়াটাই জীবন। আপনাদের কাছে এসে কান্নাকাটি করলাম। লাভ কী! আবেগ কখনও কোনও মানুষকে জেতায় না।’’

অলিম্পিক্সে সোনাজয়ীর কথাগুলো কতটা খাঁটি অভিনব বিন্দ্রা যে নিজেই তার প্রমাণ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন