মেডেল হাতে।
৩১ নম্বর জাতীয় সড়কে শীতের সময় কমলালেবু বিক্রি করা মেয়েটা আর পাঁচজন মহিলা পসারিণীর মতোই খদ্দের টানতে ব্যস্ত। ফল বিকোলে জুটবে খানিক টাকা। তা দিয়ে সংসার গড়াবে আরও খানিকটা। বিকিকিনির অবসরে এখনও ওই হাত তুলে নেয় ধনুক। বাচ্চাদের শেখায় ছিলা পরানোর কায়দা। শেখায়, কেমন মনোসংযোগে ভেদ করতে হয় ‘বুলস আই’। হতাশা চেপে নিজের স্বপ্ন চারিয়ে দিতে চায় আগামী প্রজন্মের মধ্যে।
জুনিয়র এবং সিনিয়র পর্যায়ে এক সময় জাতীয় তীরন্দাজি চ্যাম্পিয়ন বুলি বসুমাতারির থোড়-বড়ি-খাড়া রোজনামচায় খানিক বদল আসতে পারে সোমবার। অন্তত পরিবারের আশা তেমনই। কারণ, রাজ্যের প্রাক্তন জাতীয় চ্যাম্পিয়নের এমন দুর্দশার কথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী তথা বর্তমানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালের কানে উঠেছে। তাই দিসপুরে তলব পড়েছে বুলির।
নামনি অসমের চিরাং জেলার বাসিন্দা বুলি ছোট থেকেই লক্ষ্যভেদের নেশায় মত্ত। তীর-ধনুক বড়ো গ্রামগুলিতে ঘরে-ঘরে থাকে। বুলির ঠাকুরদার হাতে গড়া তীর ধনুকেই বুলির হাতেখড়ি। ঠাকুরদার কাছে শুনত রূপকথার বীরাঙ্গনাদের গল্প। আর চালিয়ে যেত লক্ষ্যভেদের খেলা।
স্থানীয় প্রতিভা অণ্বেষণ শিবিরে, তীরন্দাজিতে মেয়েটার প্রতিভা দেখে গুয়াহাটির স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়ায় তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়। ২০০৫ সালে, অজমেঢ় জাতীয় সাব জুনিয়র পর্যায়ে দু’টি সোনা ও একটি রুপোর পদক পান বুলি। পরের বছর মহারাষ্ট্রের অমরাবতীতে জাতীয় স্কুল গেমস প্রতিযোগিতায় বুলির ঝুলিতে আসে একটি সোনা ও একটি রুপো। এরপর জাতীয় সিনিয়র তীরন্দাজির আসরে, জামশেদপুরে বুলি ৫০ মিটার বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হন। দলগত বিভাগে পান রুপো। ২০০৮ সালে ফের আসে রুপো। তখন বুলি দেশের অন্যতম সেরা তীরন্দাজ। কিন্তু ২০১০ সালে চোটের কারণে সরে আসতে হয় তাঁকে। কিন্তু চোট সারিয়ে ফেরার মতো রসদ বা সাহায্য পাননি রাজ্য বা কেন্দ্র থেকে। আধা সেনায় চাকরির চেষ্টাও বারবার ব্যর্থ হয়। ভাল প্রশিক্ষক রাখা, ভাল তীর-ধনুক কেনারও পয়সা ছিল না। অগত্যা পরিবারের চাপে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন বুলি। জাতীয় চ্যাম্পিয়ন তীরন্দাজের স্বপ্নও সেখানেই শেষ।
কমলালেবু বিক্রিই তাঁর পেশা।
এখন বুলি ভারত-ভুটান সীমান্তের কাছে সামথাইবাড়ি এলাকায় ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কে শীতে কমলালেবু, বছরের অন্য সময় যা পারেন বিক্রি করেন। অথবা আছে দিন মজুরি। স্বামীও দিন মজুর। অবশ্য দুই মেয়ের মা বুলি বেচাকেনা, সংসারের চাপ সামলেও তীর-ধনুককে একেবারে কাছছাড়া করেননি। স্থানীয় সিদলি কাসিকোতরা উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে চারটি ছাত্র জুটেছে তাঁরা। অবসর সময় তাঁদেরই প্রশিক্ষণ দেন বুলি।
দেখেননি দঙ্গল সিনেমা। নাম শুনেছেন দীপা কর্মকার, মেরি কম, সাক্ষী মালিকের। তাঁদের সাফল্যের খবরে চিনচিনে নিষ্ফলতার ব্যথা তাড়া করেছে খানিকক্ষণ। ভেবেছেন, সরকারি সাহায্য পেলেও তিনিও হয়ত হয়ে উঠতে পারতেন রাজ্যের মেয়েদের কাছে রোল মডেল। যে মেয়েটা বড়োভূমির নাশকতা, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের আবহের মধ্যে অতি-দারিদ্রের মধ্যে থেকেও হতে পেরেছিল জাতীয় চ্যাম্পিয়ন।
প্রাক্তন জাতীয় চ্যাম্পিয়নের দুর্দশার কথা জানতে পেরে বড়ো নেত্রী তথা বনমন্ত্রী প্রমীলারানি ব্রহ্ম বুলিকে চাকরির আশ্বাস দেন। তিনি বিষয়টি জানান মুখ্যমন্ত্রীকে। নিজেও খেলোয়াড় ছিলেন সর্বানন্দ সোনোয়াল। ছিলেন দেশের ক্রীড়ামন্ত্রী। রাজ্যের ক্রীড়া প্রতিভা তুলে ধরতে সর্বদা সচেষ্ট তিনি। তাই বুলির কথা জানতে পেরে তিনি জেলাশাসককে বার্তা পাঠান। জানান, সোমবার বুলির সঙ্গে দেখা করতে চান। নতুন আশা জাগলেও আগেভাগে স্বপ্ন দেখতে চান না বুলি। তাঁর ইচ্ছে, কোথাও কাজ জুটলেও তার সঙ্গে যেন তীর-ধনুকের যোগ থাকে।
ছবি: প্রীতম বি চৌধুরী ও স্যাভিও দইমারি।
আরও পড়ুন: চার ছক্কার ফুলঝুড়ি ছুটিয়ে ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান করলেন অপরাজিত ১৫০!