২০০৩ ফিরিয়ে এনে বিদায় নিলেন ধোনিরা

বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের পর এ বার কি আপনি অবসর নিচ্ছেন? সিদ্ধান্তটা কালকেই হয়ে যাবে না তো? সাংবাদিক সম্মেলনে আসামাত্র মহেন্দ্র সিংহ ধোনির জন্য এই বাউন্সারটা ছোবল মেরে এত বার উঠল যে, সমসংখ্যক ডেলিভারি প্রথমার্ধে সিডনি উইকেট থেকে উঠলে ভারতের বিদায় হয়তো এত একপেশে হতো না! সকালে পিচ দেখে এসে ড্যামিয়েন ফ্লেমিং টুইট করলেন, ‘মঙ্গলগ্রহেও জীবনের সন্ধান থাকতে পারে, কিন্তু এই উইকেটে নেই।’ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও পিচ রিপোর্ট করে এসে ঘাড় নাড়ছেন, “পুরো ব্যাটিং ট্র্যাক। বল ঘুরবে বলে মনে হয় না।”

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

সিডনি শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৫ ০৪:৩৩
Share:

অধরা বিশ্বকাপ। সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারের পরে মাঠ ছাড়ছেন বিরাট কোহলি। বৃহস্পতিবার সিডনিতে। ছবি: গেটি ইমেজেস।

বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের পর এ বার কি আপনি অবসর নিচ্ছেন? সিদ্ধান্তটা কালকেই হয়ে যাবে না তো?

Advertisement

সাংবাদিক সম্মেলনে আসামাত্র মহেন্দ্র সিংহ ধোনির জন্য এই বাউন্সারটা ছোবল মেরে এত বার উঠল যে, সমসংখ্যক ডেলিভারি প্রথমার্ধে সিডনি উইকেট থেকে উঠলে ভারতের বিদায় হয়তো এত একপেশে হতো না! সকালে পিচ দেখে এসে ড্যামিয়েন ফ্লেমিং টুইট করলেন, ‘মঙ্গলগ্রহেও জীবনের সন্ধান থাকতে পারে, কিন্তু এই উইকেটে নেই।’ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও পিচ রিপোর্ট করে এসে ঘাড় নাড়ছেন, “পুরো ব্যাটিং ট্র্যাক। বল ঘুরবে বলে মনে হয় না।”

তখনই জানা হয়ে যায় টস এক অসীম গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ভেসে উঠতে যাচ্ছে। ভারতকে ওটা জিততেই হবে, কারণ এ ধরনের পিচে তাদের ম্যাচ জেতার একমাত্র নকশা, প্রথম ব্যাট করে তিনশোর ওপর রান তোলা! অনন্ত ভাগ্যের অধিকারী হিসেবে এই যে তাঁর পরিচিতি, তার ওপর সম্পূর্ণ অবিচার করে ধোনি টস হারলেন। দক্ষিণ ইয়ারার ধারের হোটেলে ম্যাচ দেখতে বসা ব্রেন্ডন ম্যাকালাম তখনই বোধহয় অশান্তিতে ভোগা শুরু করেন, তাঁর জীবনে আবার হাজির হলেন মাইকেল ক্লার্ক!

Advertisement

ইনিংস বিরতিতে যখন ড্রেসিংরুমে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে এক এক জন ভারতীয়র শরীর, তাঁদের ক্লান্ত পদক্ষেপ দেখে দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠে বারো বছর আগের এক বিষণ্ণ অপরাহ্ন মনে পড়ে গেল। ওয়ান্ডারার্সে সে দিন বিকেলে তো এ ভাবেই ক্লান্ত পায়ে ফিরছিলেন সৌরভ-রাহুলরা! ৩৫৯ কী ভাবেই বা সম্ভব ছিল?

কিন্তু এই সময়ে ৩২৯ তাড়া কি ততটাই দুঃসাধ্য? না হালকা আলো আছে?

লাহৌর ও করাচির ফোন ঘুরিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী ম্যাচ পূর্বাভাস পাওয়া গেল। লাহৌরে ওয়াহাব রিয়াজ! বিশ্বকাপে আবিষ্কৃত নায়ক, যাঁকে নিয়ে আলোচনা বেড়েই চলেছে। তা ওয়াহাব ফোনে বললেন, “ইন্ডিয়ান ব্যাটিং লাইন আপের পক্ষে এই রান তাড়া করাটা সমস্যা ছিল না। কিন্তু নক আউট ম্যাচ তো বোধহয় হবে না।” করাচির বাড়িতে পাওয়া গেল পাকিস্তানের আর এক নতুন তারাকে। সরফরাজ আহমেদ। এ বারের বিশ্বকাপে পাকিস্তানের একমাত্র সেঞ্চুরিকারীর গলা ফোনে দারুণ প্রত্যয়ী শোনাচ্ছে। “ইন্ডিয়া ইজি করবে। শ্রীলঙ্কাই তো এই মাঠে ৩১২ করেছিল। এই ব্যাটিং লাইন আপ নিয়ে কোনও টার্গেটই না। শুধু বিরাটকে খেলতে হবে।” সরফরাজের নম্বর থেকে কিছু পরে আবার ফিরতি ফোন এল। যেটা বেশ আশ্চর্যজনক। কারণ তাঁকে ভাল করে চিনিই না। রিটার্ন কল কেন? না, একটা ভুলে যাওয়া কথা বলার জন্য। “লিখবেন ম্যাচটা ঘুরে গেল কিন্তু ধোনির ক্যাপ্টেন্সিতে। সে দিন আমলার জন্য কী ফিল্ড সাজিয়েছিল। আজ ক্লার্ক-ওয়াটসনকেও কী ভাবে না আউট করল! ও না থাকলে অস্ট্রেলিয়া সাড়ে তিনশো করে। ধোনি ইন্ডিয়াকি আধি জান হ্যায়,” ঘোষণা করলেন সরফরাজ।

পরে দেখা গেল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যথেষ্ট অনভিজ্ঞ সরফরাজ সেমিফাইনাল ম্যাচটা ধরতেই পারেননি! এটা তো আর-পাঁচটা ম্যাচের মতো নয়। শুধু স্কিল না, অস্ট্রেলিয়ার মাঠে হলুদ জার্সির সঙ্গে লড়তে আরও বেশি লাগে নার্ভ। টুর্নামেন্টে টানা সাত ম্যাচে সেটা দেখানোর পর বৃহস্পতিবার ভারতীয় পেসারদের কেউ কেউ যা করে বসলেন, তার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকান টিম সর্বস্তরে নিন্দিত চোকিং। একটা নির্দিষ্ট লাইনে ব্যাটসম্যানের শরীর থেকে সামান্য দূরে না রেখে তাঁরা ব্যাটের আরও কাছে বল করে গেলেন। এই ফর্মে থাকা স্টিভ স্মিথ সেই বল পাওয়া মানে বিড়লা-অম্বানীকে ব্যবসার সুযোগ খুলে দেওয়া!

গত চার মাস ধরে ভারতকে ভুগিয়ে গিয়েছেন নতুন স্টিভ। অস্ট্রেলিয়া ছাড়ার আগের দিনও যেন বিদায় সংবর্ধনা দিয়ে দিলেন। দোসরা এপ্রিল দু’হাজার এগারোর সেই মায়াবী রাতের ধ্বংসাবশেষ পড়ে থাকল সিডনি ক্রিকেট মাঠের শেষ মার্চের বিকেলে। বিকেলেই তো তাঁর সেঞ্চুরিতে স্টিভ বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের ময়ূরপুচ্ছ কেড়ে নিয়েছেন! এই মাঠ চিরকাল এক স্টিভকে জেনে, সম্মান করে এবং অভিভূত হয়ে এসেছে। নতুন স্টিভ যেন একই রাজপথের তেজি, উৎসাহী যোদ্ধা!

একই সঙ্গে সব রকম ফর্ম্যাট মিলিয়ে বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটসম্যানও কি? কারণ ওয়ান ডে বিচার্য হলে ওটা আর বিরাট কোহলির অধিকারে নেই। ত্রিদেশীয় সিরিজে ৮ গড় নিয়ে শেষ করার পর দু’টো নক আউট ম্যাচে কোহলি করলেন যথাক্রমে ৩ আর ১। এমনিতে দ্বিতীয় সেমিফাইনালের এক্সিট পোলে অস্ট্রেলিয়া বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় এগিয়ে ছিল। ক’টা নাম বলব মার্ক টেলর, ম্যাকগ্রা, হুসেন, আথারটন, বুকানন, ইয়ান চ্যাপেল, রিচার্ড হ্যাডলি। লারা ছাড়া সবাই ভারতকে পিছিয়ে রেখেছিলেন। তা নিয়ে আক্ষেপ না থাকলেও কোহলি নিয়ে নিশ্চয়ই থাকবে। বড় ম্যাচের প্লেয়ার তিনি। কেন ফিল্ডিংয়ে এত সহজ ক্যাচ ছাড়বেন? ব্যাট করার সময়ই বা কেন এত চাপে থাকবেন?

ম্যাচ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ওয়াহাব রিয়াজ ঠিকই বলেছিলেন। উইকেটে পেসারের জন্য কিছু নেই। স্টার্ক-জনসনের মতো প্রতিভা হলে অন্য কথা। নইলে মাথা খুঁড়েও এখানে কিছু বার করা শক্ত। সিডনির এমন সারফেসে চাপ তৈরি করতে পারতেন স্পিনাররা। রবিচন্দ্রন অশ্বিন বেশ ভাল বলও করলেন। কিন্তু অন্য প্রান্তে সহায়তা কোথায়? রবীন্দ্র জাডেজা গোটা বিশ্বকাপে মাত্র ৯ উইকেট পেয়েছেন। গড় ৪০। এই জায়গাটাই আগের বার যুবরাজ সিংহের ছিল। ব্যাটে ধারাবাহিক ম্যাচ জেতানো ছাড়া নিয়েছিলেন ১৫ উইকেট! জাডেজা রান করেছেনও কি না সব মিলিয়ে মাত্র ৫৭। এই একটা দুর্বল জায়গা গোটা টুর্নামেন্টে ভারতের থেকে গেল। বিদায়ী দিনে জলজ্যান্ত প্রশ্নও রেখে গেল যুবিকে আনা কি উচিত ছিল না?

এখনকার মতো যুবরাজ-আগমনের চেয়ে ডানকান ফ্লেচারের যে বিসর্জন হচ্ছে, সেটাই ভারতীয় ক্রিকেটের আরামদায়ক খবর। গত বিশ্বকাপ জেতার পর থেকে এখানে ৯৫ রানে হার এত বড় একটা পিরিয়ড পেয়েও ডানকান কোনও পরম্পরাই তৈরি করতে পারেননি। আজকের ম্যাচে তাঁর ছকই বা কী ছিল, বোঝা গেল না।

সে দিনও সেঞ্চুরিয়ন ফাইনালের বিষণ্ণ রোমন্থনে রাহুল দ্রাবিড় আশ্চর্য করে দিয়ে বলেছেন, ফাইনালে হারা নিয়ে তাঁর বিশেষ শোক নেই। কারণ অস্ট্রেলিয়া এত ভাল টিম ছিল যে ম্যাচে এক মিনিটের জন্যও তাঁদের হাতে রিমোট নিতে দেয়নি। আজ এসসিজিতেও তো অবিকল তাই। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চার উইকেট নেওয়া বাদ দিলে টানা দশ মিনিটও ম্যাচের রাশ পায়নি ভারত। আর ওই উইকেট পতনগুলোর আগেই কিন্তু স্টিভ স্মিথ ঘটে গিয়েছে!

ধোনি শেষ দিকে একা লড়লেন। তার আগে শিখরকে মনে হচ্ছিল, অস্ট্রেলিয়াকে বিপন্ন করতে পারেন। ওপেনিং পার্টনারশিপ যে স্বপ্ন দেখাচ্ছিল, পরে দেখা গেল সেটা মরীচিকা ছিল। এত ছুটকো-ছাটকা বিপদ তৈরি করে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো যায় না। তা-ও তারা আগের সেই বিশ্বজয়ী দল নয়! বিপক্ষকে ম্যাচে ঢোকার সুযোগ দেয়। ফিল্ডিং অনেক খারাপ। আজও ধবন-ধোনির এমন দু’টো ক্যাচ পড়ল যা অস্ট্রেলীয় মহাদেশে ফেলার নিয়ম নেই!

এর মধ্যে একটা ক্যাচ ফেলেছেন এবং ব্যাটেও আজ নিয়ে পরপর দু’টো নক আউট ম্যাচে রান পেলেন না অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক। রোববার এমসিজিতে অবধারিত তাঁর শেষ ওয়ান ডে ম্যাচ হতে চলেছে। সে তিনি নিজে যেতে চান বা না চান! অস্ট্রেলিয়া কাপ হাতে তুলুক বা না তুলুক!

ধোনি? ওই তো বলে দিলেন ভারতীয় মিডিয়া ভেবেটেবে যা স্থির করবে, আমি ঠিক তার উল্টোটা করব। একটু বেশি রাতে আলো-অন্ধকারের মধ্যে ভারতীয় দল বেরিয়ে যাচ্ছে সিডনি ক্রিকেট মাঠ থেকে। এ বার চার মাস পর দেশের টিকিটের জন্য ফোনটোন করবে। ধোনিকে দেখে মনে হল, এই মানুষটা এখনও তার দেড় মাসের বাচ্চাকে দেখেনি।

এই মানুষটার নেতৃত্বে ভারত টানা এগারো বিশ্বকাপ ম্যাচ জিতেছে। এই মানুষটা আজও তার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল।

ভারতীয় দলকে বাসে উঠতে দেখার সময় মনে হচ্ছিল আজকের হারে হয়তো গৌরব নেই। কিন্তু সামগ্রিক পারফরম্যান্সে রয়েছে। ওই অন্ধকারেই কোনও এক ফ্যানের পোস্টার নিয়ে দাঁড়ানো উচিত ছিল। যেখানে লেখা থাকার কথা এমএসডি, বিনোদনের জন্য ধন্যবাদ!

অস্ট্রেলিয়া

ফিঞ্চ ক ধবন বো উমেশ ৮১

ওয়ার্নার ক কোহলি বো উমেশ ১২

স্মিথ ক রোহিত বো উমেশ ১০৫

ম্যাক্সওয়েল ক রাহানে বো অশ্বিন ২৩

ওয়াটসন ক রাহানে বো মোহিত ২৮

ক্লার্ক ক রোহিত বো মোহিত ১০

ফকনার বো উমেশ ২১

হাডিন ন.আ. ৭

জনসন ন.আ. ২৭

অতিরিক্ত ১৪,

মোট ৫০ ওভারে ৩২৮-৭।

পতন: ১৫, ১৯৭, ২৩২, ২৩৩, ২৪৮, ২৮৪, ২৯৮।

বোলিং: শামি ১০-০-৬৮-০, উমেশ ৯-০-৭২-৪, মোহিত ১০-০-৭৫-২,

বিরাট ১-০-৭-০, জাডেজা ১০-০-৫৬-০, অশ্বিন ১০-০-৪২-১।

ভারত

রোহিত বো জনসন ৩৪

ধবন ক ম্যাক্সওয়েল বো হ্যাজেলউড ৪৫

বিরাট ক হাডিন বো জনসন ১

রাহানে ক হাডিন বো স্টার্ক ৪৪

রায়না ক হাডিন বো ফকনার ৭

ধোনি রান আউট ৬৫

জাডেজা রান আউট ১৬

অশ্বিন বো ফকনার ৫

শামি ন.আ.১

মোহিত বো ফকনার ০

উমেশ বো স্টার্ক ০

অতিরিক্ত ১৫

মোট ৪৬.৫ ওভারে ২৩৩।

পতন: ৭৬, ৭৮, ৯১, ১০৮, ১৭৮, ২০৮, ২৩১, ২৩২, ২৩২।

বোলিং: স্টার্ক ৮.৫-০-২৮-২, হ্যাজেলউড ১০-১-৪১-১, জনসন ১০-০-৫০-২,

ফকনার ৯-১-৫৯-৩, ম্যাক্সওয়েল ৫-০-১৮-০, ওয়াটসন ৪-০-২৯-০।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন