বিশ্বকাপ পদক নিয়ে ইউভেনা।
কলকাতা ময়দানে চোদ্দো বছর আগে মোহনবাগান জার্সিতে মহিলাদের লিগে তিনি যখন খেলতেন তখন কে শঙ্কর প্রথম ভারতীয় রেফারি হিসেবে বিশ্বকাপ খেলাতে গিয়েছিলেন। সেই শঙ্করের কৃতিত্ব টপকে বিশ্ব ফুটবলে নতুন নজির তাঁর!
বাংলা জানেন কি না প্রশ্ন করলে গেয়ে উঠলেন ‘তোমার দেখা নাই রে তোমার দেখা নাই...!’ পরক্ষণেই হাসতে হাসতে বলে ওঠেন ‘‘আমার ছ’বছরের ছেলে বরহান তো জানেই না ওর মাম্মি কী করে। বাড়ি ফিরলেই বলে, তোমাকে মাঠের অন্যরা বলটা দেয় না কেন?’’
এক বছর বয়সে পিতৃহারা হয়ে যাবতীয় প্রতিকূলতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে এখন যিনি বিমানবাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার, তিনি বলে দিলেন, ‘‘কষ্ট আর প্রতিকূলতার সামনে পড়লেই আমার জেদ আরও বেড়ে যায়। লক্ষ্য স্থির রেখে এগোলে যে কোনও বাধাই টপকানো সম্ভব।’’
এই হার না মানা মনোভাবকে সম্বল করেই ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে গত শুক্রবার নতুন নজির গড়েছেন গোয়ার ইউভেনা ফার্নান্ডেজ। তিনিই প্রথম ভারতীয় রেফারি যিনি ফিফার কোনও টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলালেন। গত শুক্রবার জর্ডনে মহিলাদের অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে সহকারী রেফারি ছিলেন ইউভেনা। যার পর তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়ে অজস্র টুইট করেছেন ভারতীয় ফুটবলের ‘হুজ হু’ রা।
শনিবার গভীর রাতে দমদম বিমানবন্দরের লাউঞ্জে বসে সেই অভিজ্ঞতা আনন্দবাজার-কে শোনাতে গিয়ে বায়ুসেনা কর্মীর গাল দিয়ে নেমে এল আনন্দাশ্রুর ধারা। ‘‘জানেন, বাবা মারা যাওয়ার পর খুব কষ্টে সংসার চালাতেন মা। বিশ্বকাপ ফাইনালে উত্তর কোরিয়া-জাপান ম্যাচে যখন সহকারী রেফারি হিসেবে মাঠে নামছিলাম তখন সেই দিনগুলো আর বাবার কথা খুব মনে পড়ছিল।’’
অসমের ছাবুয়া বিমানঘাঁটির এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলার ইউভেনা। রবিবার সকালের বিমানেই গুয়াহাটি উড়ে গেলেন। তার আগে জর্ডানের ফাইনালের রেফারিদের পদক গলায় ঝুলিয়ে গোয়ান মেয়ে শোনাচ্ছিলেন তাঁর সাফল্য-সফরের কথা। ‘‘খেলা ছেড়ে এয়ারফোর্স অ্যাকাডেমিতে যাওয়ার পর আমার রেফারিংয়ের শুরু। ফিফা রেফারি হওয়ার পর গত এশিয়ান গেমসে ম্যাচ খেলানোর পর থেকেই আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। ফেডারেশনের রেফারি বোর্ডের চিফ গৌতম (কর) স্যার, প্রদীপ (নাগ) স্যার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সব সময়।’’ একটু থেমে ফের বললেন, ‘‘বিশ্বকাপের জন্য নতুন প্র্যাকটিস শিডিউল, ফিজিক্যাল ট্রেনিং, ডায়েট ফলো করতাম। দিনে ছ’ঘণ্টা খেটেছি। ফাইনাল ম্যাচ খেলাতে নামার সময় মনে হচ্ছিল আমার পরিশ্রম সার্থক।’’
স্বামী মেজর বাদল দাস সেনাবাহিনীতে কর্মরত। এলাহাবাদে হেলিকপ্টার ট্রেনিং নিতে গিয়ে দু’জনের প্রেম। তার পর বিয়ে। সংসার-রেফারিং-বিমাবাহিনীর চাকরি একসঙ্গে সামলাতে গিয়ে সমস্যা হয় না? জানতে চাইলে এ বার চোয়াল শক্ত ইউভেনার। ‘‘এ দেশের মেয়েরা ঘরকন্না আর সন্তানের জন্ম দেওয়া ছাড়াও অনেক গুণ লুকিয়ে রাখেন। উৎসাহ দিলে তাদের সেই গুণগুলোও চোখে পড়বে।’’
আড্ডার মাঝেই বলিউডের রণদীপ হুডার ভক্ত ইউভেনাকে সংবর্ধনা দিতে ফুল আর মিষ্টি নিয়ে বিমানবন্দরে হাজির প্রাক্তন ফিফা রেফারি প্রদীপ নাগ। সঙ্গী এই মুহূর্তে দেশের অন্যতম সেরা রেফারি প্রাঞ্জল বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীন রেফারি সোনাল গুহ রায়। ইউভেনার সঙ্গে একই বছরে ফিফা রেফারিং পাশ করেছেন প্রাঞ্জল। পুরনো ক্লাসমেটের কাছ থেকে প্রাঞ্জল মন দিয়ে শুনছিলেন বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলানোর গল্প।
ফুটবল দুনিয়ায় ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর ভক্ত ইউভেনা যাবতীয় তথ্য উপুড় করে দেওয়ার পর দেখালেন তাঁর মেডেলটাও। ছেলের জন্য আনা খেলনা বন্দুক, হেলিকপ্টারও বেরিয়ে পড়ল ব্যাগ থেকে। তার ফাঁকেই ইউভেনা বলে চলেন, ‘‘এখানেই আত্মতুষ্ট হতে চাই না। লক্ষ্য এ বার সিনিয়র বিশ্বকাপ খেলানো।’’ আইএসএল? ‘‘ওটা আমার বিষয় নয়। ফেডারেশন ঠিক করবে।’’
চেক-ইনের সময় হয়ে আসছে। এ বার উঠল বছর খানেক আগে ময়দানে ঝড় তোলা মহিলা রেফারি কণিকা বর্মনের কথা। কেন ইউভেনারা পারেন আর কণিকারা হারিয়ে যান? ইউভেনা বললেন, ‘‘ওর কথা জানি। নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। উৎসাহ, ভালবাসা আর পরিশ্রমই পারে প্রতিকূল পরিস্থিতিকে হারিয়ে দিতে।’’