দুরন্ত: সাত রানের জন্য ডাবল সেঞ্চুরি হাতছাড়া হলেও সিরিজ জয়ের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন পূজারা। শুক্রবার। :ছবি: এএফপি
প্রশ্ন: সিরিজে কী হবে মনে হচ্ছে?
রডনি হগ: পূজারা, পূজারা অ্যান্ড পূজারা। আপাতত এটাই বলতে ইচ্ছে করছে আমার। কী অসাধারণ এক ব্যাটসম্যান পেয়েছেন আপনারা। কী দারুণ নিয়ন্ত্রণ! ব্যাট করে চলেছে তো চলেছেই। ক্লান্তিহীন। আপনাকে একটা ছোট পরিসংখ্যান শোনাই। ৬৮ টেস্টের পরে সানি গাওস্করের ছিল ৬১৮০ রান, সচিন তেন্ডুলকরের ৫১৭৭, রাহুল দ্রাবিড়ের ৫৫৬৬, বিরাট কোহালির ৫৭৯৪ আর পূজারার ৫৩৬০ (দ্বিতীয় দিনের খেলা শুরুর আগে পর্যন্ত)। রাহুল দ্রাবিড়কে বলা হত ‘দ্য ওয়াল’। পূজারাকে তা হলে কী বলা হবে! আমার মনে হচ্ছে, প্রথম বার অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট সিরিজ জিতে ইতিহাস তৈরির মঞ্চ গড়ে দিয়েছে পূজারাই।
প্র: পূজারাকে দেখে কি দ্রাবিড়ের কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে আপনার?
হগ: আমি নিজে তুলনায় বিশ্বাস করি না। তবে কেউ তুলনাটা টানলে তাকে দোষ দেব না। পূজারার ব্যাটিংয়েও দলকে স্থায়িত্ব দেওয়ার একটা ব্যাপার আছে। ওকে দেখে মনে হয় যেন টিমকে বলতে চাইছে, চিন্তা নেই আমি আছি। আমি পূজারার ব্যাটিং দেখে মুগ্ধ। একটা ব্যাপারে দু’জনের অবশ্যই মিল আছে বলে আমার মনে হচ্ছে। সচিন তেন্ডুলকর আর রাহুল দ্রাবিড় যখন একসঙ্গে খেলত, সব সময় প্রচারের আলো থাকত সচিনের উপর। এই কারণে দ্রাবিড়ের দারুণ সব পারফরম্যান্স অনেক সময়ে আড়ালে থেকে গিয়েছে। এখন সেটাই হচ্ছে কোহালি আর পূজারাকে নিয়ে। বলছি না, সচিন বা বিরাটকে নিয়ে হইচই হওয়াটা বাড়াবাড়ি। ওরা বিশ্বের সেরা ক্রিকেটার, ওদের নিয়ে আলোচনা তো হবেই। কিন্তু কখনওসখনও আড়ালে চলে যায় দ্রাবিড়-পূজারাদের পারফরম্যান্স।
প্র: পূজারা কি গাওস্কর, দ্রাবিড়দের স্কুলের? দারুণ টেকনিক, শৃঙ্খলাবদ্ধ, দুর্ভেদ্য রক্ষণ?
হগ: তুলনা করব না। সানিকে আমি বল করেছি। ‘রক’। ও রকম ডিফেন্স কারও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। কিন্তু সানির সব চেয়ে বড় দক্ষতা ছিল, বল ছাড়ার ব্যাপারে। অফস্টাম্প কোথায়, তা নিয়ে কখনও দ্বিধায় পড়তে দেখিনি। তবে আবার বলছি, আমার দেখা সেরা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় পূজারাকে আমি অনেক উপরেই রাখব।
আরও পড়ুন: নব্বইয়ের ঘরে পৌঁছে উদ্বেগে ছিলেন ঋষভ
মুগ্ধ: বিরাটের অধিনায়কত্বেও অভিভূত রডনি। ফাইল চিত্র
প্র: আপনার হাতে বল থাকলে পূজারাকে কী ভাবে আউট করতেন?
হগ: জানি না, সত্যিই ভেবে উঠতে পারছি না। আমাদের সময়ে মজবুত রক্ষণ অনেক ব্যাটসম্যানেরই ছিল। তাই আমার অভিজ্ঞতা আছে পূজারা ঘরানার অনেক ব্যাটসম্যানকে বল করার। তার পরেও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না, পূজারাকে আউট করার জন্য কী ধরনের বোলিং করতাম। দেখে তো মনে হচ্ছে, ও কোনও সুযোগই দেয় না। রক্ষণ শক্তিশালী হলেও অনেকে দু’একটা বল উল্টোপাল্টা চালায়। পূজারার মনঃসংযোগে চিড় ধরার কোনও সম্ভাবনাই দেখা যায় না। ক্রিকেট অনেক পাল্টে গিয়েছে। অনেক গতিসম্পন্ন হয়ে গিয়েছে। রানের জন্য প্রত্যেকে ছুটছে। এই যুগে এ রকম দুর্ভেদ্য রক্ষণ দেখাই যায় না!
আরও পড়ুন: বিপর্যয়ের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া শিবিরে ছড়াচ্ছে গৃহযুদ্ধের শঙ্কা
প্র: এই ভারতীয় দলটাকে কেমন লাগছে আপনার?
হগ: দারুণ মনোভাব দলটার। জেতার জন্য খেলতে নামে। খুব ইতিবাচক ভঙ্গি। গুণগত মানের দিক থেকেও অতীতের অনেক দলের চেয়ে এগিয়ে। চোখে লাগার মতো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি ফিল্ডিং এবং ফিটনেসে। আমার মনে হয়, সব দিক দিয়ে খুব ‘কমপ্লিট’ দল আপনাদের।
প্র: কোহালিকে নিয়ে কী বলবেন?
হগ: দারুণ প্লেয়ার। এই সিরিজে যতটা রান ও করতে চেয়েছিল, ততটা হয়তো ও পারেনি। ব্যাটসম্যান হিসেবে কোহালি সেরাদের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে, কোনও সন্দেহ নেই। জনতার চাপটা খুবই রয়েছে ওর উপরে। সারাক্ষণ কাটাছেঁড়া চলছে ওকে নিয়ে। মাঠে কেমন আচরণ করল, কী মন্তব্য করল, সব কিছু নিয়ে মত-পাল্টা মত চালু হয়ে যায়। কোহালির আগ্রাসী আচরণ নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক, অধিনায়ক হিসেবে ওর রেকর্ড কিন্তু চমকে দেওয়ার মতো। আমার মনে হয়, ও যখন নেতৃত্বের দায়িত্ব নিয়েছিল ধোনির থেকে, তখন ভারত টেস্ট ক্রিকেট র্যাঙ্কিংয়ে খুব ভাল জায়গায় ছিল না। কোহালি অধিনায়ক হওয়ার পরে এখন ওরা এক নম্বরে। এর জন্য অধিনায়ককে কৃতিত্ব দিতেই হবে।
প্র: ভারতীয় পেস বোলিংয়ের রূপান্তর নিয়ে আপনার কী মত?
হগ: আমি যখন খেলতাম, তখন ভারতের পেস বোলিং আক্রমণ বলতে খুব বেশি কিছু ছিল না। কপিল দেব একাই ছিল। দারুণ বোলার ছিল কপিল। ওর সঙ্গে রজার বিনি, কারসন ঘাউড়ি, মদন লালরা ছিল। প্রত্যেকেই মিডিয়াম পেসার এবং সুইং-নির্ভর বোলার। গতি বা বাউন্স ওদের অস্ত্র ছিল না। এখন যেমন পাঁচ থেকে ছ’জন প্রকৃত ফাস্ট বোলার রয়েছে ভারতের হাতে, সেটা কখনও দেখা যায়নি। পার্থে তো ওরা চার পেসারে খেলল। অস্ট্রেলিয়ায় এসে ভারত চার পেসারে খেলছে, এটা কে কবে ভাবতে পেরেছিল!
প্র: ভারতীয় পেসারদের মধ্যে কাকে সব চেয়ে ভাল লাগছে?
হগ: বুমরা সব চেয়ে আকর্ষণীয়। অদ্ভুত রান-আপ আর অ্যাকশন। প্রায় হেঁটে হেঁটে গিয়ে শেষ মুহূর্তে দৌড়ে বল করে। কী করে ওইটুকু দৌড়ে অত জোরে বল করে, সেটা একটা বিস্ময়। তেমনই সোজা, দৃঢ় হাত রেখে কী ভাবে বল ছাড়ে, সেটাও গবেষণার বিষয়। ব্যাটসম্যানরা যে কিছুই উদ্ধার করে উঠতে পারছে না, সেটা তো দেখাই যাচ্ছে। আমার শুধু একটাই চিন্তা রয়েছে। যে-হেতু ওর রান-আপ আর অ্যাকশন কপিবুকের বাইরে, প্রশ্ন একটা থেকেই যাচ্ছে ফিটনেস ধরে রাখা নিয়ে। বুমরা যে এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম সেরা এবং ওকে খেলতে গিয়ে যে ব্যাটসম্যানদের সমস্যা হতেই থাকবে, তা নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। সীমিত ওভারের ক্রিকেট থেকে এসেছে বলে অভাবনীয় সব বৈচিত্র রয়েছে। টেস্টে স্লোয়ার বলে উইকেট নিচ্ছে! বুদ্ধিমান বোলার। শুধু এটাই দেখার যে, এ রকম রান-আপ আর অ্যাকশন নিয়ে চোট-আঘাতের আতঙ্ক না থাকে!
প্র: একটা তর্ক উঠেছে, ভারতের এই পেস বোলিং আক্রমণ সর্বকালের সেরা কি না। আপনি কী বলবেন?
হগ: এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহই নেই আমার। এটাই ভারতের সর্বকালের সেরা পেস আক্রমণ। ওই যে বললাম, এর আগে মিডিয়াম পেসার এসেছে। কপিল দেব একটাই ছিল। কিন্তু এক সঙ্গে চার-পাঁচ জন মিলে ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটারে বল করে যাওয়া, এ ভাবে প্রতিপক্ষ ব্যাটিংয়ের উপরে বোমাবর্ষণ করে যাওয়া— এ সব কখনও দেখিনি।
এটাই ভারতের সর্বকালের সেরা পেস আক্রমণ। মত রডনি হগের।
প্র: বল-বিকৃতির ঘটনা দেখে আপনার প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল?
হগ: খুবই হতাশ হয়েছিলাম। সারা বিশ্ব দেখছে আমরা এটা করছি। অতীতেও বল-বিকৃতির নানা ঘটনা শুনেছি আমরা। বোলার রান-আপে ফিরে যেতে যেতে হয়তো অনৈতিক কিছু করছে। অথবা কোনও ফিল্ডার করছে। কিন্তু গোটা টিম হিসেবে, প্ল্যান করে কী করে এটা করল! আমি সেটাই বুঝে পাচ্ছিলাম না।
প্র: স্মিথ, ওয়ার্নারকে ফেরানো হবে। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের এই অবস্থার মধ্যে স্মিথকে অধিনায়ক হিসেবে ফিরিয়ে আনা উচিত?
হগ: না, অধিনায়ক পরিবর্তন করায় আমার সায় নেই। টিম পেন কী দোষটা করল? দেশের এমন বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে ও বুক চিতিয়ে দলটাকে নেতৃত্ব দিয়েছে। স্মিথ খেলুক, আমি খুব একটা নিশ্চিত নই ওয়ার্নারের ভবিষ্যৎ নিয়ে। তবে পেনকে অধিনায়কত্ব থেকে সরানোটা অন্যায় হবে। ওর হাতে কী রকম দল রয়েছে, সেটাও তো মনে রাখতে হবে। আরও বেশি করে মনে রাখতে হবে, অস্ট্রেলিয়ার খুব দুঃসময়ে ও অধিনায়কত্বের গুরুদায়িত্ব পালন করেছিল। যখন গোটা দেশ আমাদের ক্রিকেট দলকে নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছিল, তখন ও ইমার্জেন্সি অধ্যায়টা সামলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়েছিল। ওর টিম হেরে যাবে, কিন্তু পেনের সাহসিকতা যেন পুরস্কার পায়।