ইউএস ওপেন চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ট্রফি হাতে কার্লোস আলকারাজ়। ছবি: রয়টার্স।
মানুষ! নাকি যন্ত্র! রবিবার ভারতীয় সময় মধ্যরাতে আর্থার অ্যাশ স্টেডিয়ামে কার্লোস আলকারাজ়ের খেলা দেখতে গিয়ে বার বার সেটাই মনে হচ্ছিল। কী ভাবে কেউ এ রকম টেনিস খেলতে পারেন? বিশেষ করে উল্টোদিকে থাকা লোকটার নাম যখন ইয়ানিক সিনার। সেই সিনার যিনি চলতি বছর চারটি গ্র্যান্ড স্ল্যামেরই ফাইনালে উঠেছে। জিতেছেন দু’টি। এই ম্যাচে নামার আগে বিশ্বের এক নম্বর ছিলেন তিনি। সেই সিনার সমাধান করতে পারলেন না আলকারাজ় নামের ধাঁধার। স্প্যানিশ আর্মাডায় ধ্বংস হয়ে গেল ইটালির দুর্গ। চার সেটের লড়াইয়ে সিনারকে হারিয়ে ইউএস ওপেন চ্যাম্পিয়ন হলেন আলকারাজ় (৬-২, ৩-৬, ৬-১, ৬-৪)। ২০২২ সালের পর দ্বিতীয় বার। এই জয়ের ফলে সিনারকে টপকে আবার বিশ্বের এক নম্বর পুরুষ টেনিস খেলোয়াড় হলেন আলকারাজ়। সিংহাসন ফিরে পেলেন তিনি।
চলতি বছর চারটি গ্র্যান্ড স্ল্যামের দু’টি জিতলেন আলকারাজ় (ফরাসি ওপেন ও ইউএস ওপেন)। বাকি দু’টি সিনারের (অস্ট্রেলিয়ান ওপেন ও উইম্বলডন) দখলে। পুরুষদের সিঙ্গলসে শেষ ১১টি গ্র্যান্ড স্ল্যামের মধ্যে ১০টি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন দুই তারকা। আলকারাজ় ছ’টি। সিনার চারটি। দুই তারকার দ্বৈরথকে ‘সিন-কারাজ়’ নামে ডাকা শুরু করেছেন টেনিস ভক্তেরা। কিন্তু সেই লড়াই ইউএস ওপেনের ফাইনালে দেখা গেল না।
কয়েক মাস আগে ফরাসি ওপেনের ফাইনালে সিনারের বিরুদ্ধে দু’টি ম্যাচ পয়েন্ট বাঁচিয়ে ফিরেছিলেন আলকারাজ়। পাঁচ সেটের লড়াই জিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন তিনি। খেলা চলেছিল সাড়ে ৫ ঘণ্টা। দু’মাস আগে উইম্বলডনেও আলকারাজ় প্রথম সেট জেতার পর টানা তিন সেট জিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন সিনার। সেই ম্যাচও ৩ ঘণ্টার বেশি হয়েছিল। তাই সকলের আশা ছিল, সে রকম লড়াই আরও এক বার দেখা যাবে। কিন্তু আর্থার অ্যাশ স্টেডিয়ামে সিনারের থেকে অনেকটা এগিয়ে ছিলেন আলকারাজ়। ২ ঘণ্টা ৪২ মিনিটে খেলা শেষ করে দিলেন তিনি।
ইউএস ওপেনে নামার আগে সিনসিনাটি ওপেনের ফাইনালে চোটের কারণে আলকারাজ়ের বিরুদ্ধে ম্যাচ ছেড়েছিলেন সিনার। এই ম্যাচে তাঁর খেলা দেখে মনে হল, নিজের সেরা ফিটনেসে নেই তিনি। চতুর্থ সেট যখন শুরু হচ্ছে, তখনও সমান চনমনে আলকারাজ়। দেখে মনে হচ্ছিল প্রথম সেট খেলতে নেমেছেন। সেখানে সিনারকে অনেকটাই ক্লান্ত দেখাল। এক এক সময় মনে হচ্ছিল, বলের কাছে পৌঁছাতে সমস্যা হচ্ছে তাঁর।
স্পেন ও ইটালির লড়াইয়ের ইতিহাস বহু পুরনো। পঞ্চদশ শতকে ‘ইটালিয়ান ওয়ার’, বিংশ শতকে ‘স্প্যানিশ সিভিল ওয়ার’-এর সাক্ষী থেকেছে দু’দেশ। পরে সেই লড়াই গড়িয়েছে ফুটবলের মাঠে। ১৯৯৪ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল, ২০০৮ ইউরো কোয়ার্টার ফাইনাল, ২০১২ ইউরো ফাইনালে সেই ছবি দেখা গিয়েছে। ফুটবল থেকে তা এখন সরে গিয়েছে টেনিসে। গত দু’বছর এই দুই তারকা দাপট দেখিয়েছেন। তবে মুখোমুখি সাক্ষাতে এগিয়ে আলকারাজ়। ১৫ বারের মধ্যে ১০ বার জিতেছেন তিনি। তিন বছর আগে নিজের প্রথম ইউএস জেতার পথে কোয়ার্টার ফাইনালে সিনারকে হারিয়েছিলেন তিনি। এই গ্র্যান্ড স্ল্যামে এটি তাঁদের দ্বিতীয় সাক্ষাৎ। সেখানেও বাজিমাত করলেন আলকারাজ়। এ বার ফাইনালে।
আলকারাজ়ের হুঙ্কার। ইউএস ওপেনের ফাইনালে এই মেজাজেই দেখা গেল স্প্যানিশ তারকাকে। ছবি: রয়টার্স।
নির্ধারিত সময়ের থেকে আধ ঘণ্টা দেরিতে শুরু হয়েছিল ইউএস ওপেনের ফাইনাল। নিরাপত্তার কারণে এই বিলম্ব। খেলা শুরুর আগে যখন আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হচ্ছে, তখন দেখা গেল, গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে স্যালুট করছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প। খেলা শুরুর আগে দুই তারকার লকার রুমের ছবিটাও ছিল আলাদা। সিনার তাঁর সাপোর্ট স্টাফদের সঙ্গে ফুটসল খেলছিলেন। মেজাজ ফুরফুরে দেখাচ্ছিল। সেখানে আলকারাজ় কানে হেডফোন লাগিয়ে শরীরচর্চা করতে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল, এই ম্যাচ জিততে অনেক বেশি মরিয়া তিনি। কোর্টে নামার আগে আলকারাজ় বলে গেলেন, তিনি একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নেমেছেন। তা হল বিশ্বের সেরা টেনিস তারকা হওয়া। আর তার জন্য ইউএস ওপেন জিততে হবে তাঁকে। পরের কয়েক ঘণ্টায় সেই লক্ষ্য বাস্তবে পরিণত করলেন তিনি। সিনারের কথায় সেই প্রত্যয় ধরা পড়েনি। খেলাতেও আত্মবিশ্বাসের অভাব চোখে পড়ল।
সিনারের বিরুদ্ধে আলকারাজ়ের পরিকল্পনা ছিল পোক্ত। তিনি শুরুতেই ধাক্কা দিতে চেয়েছিলেন। তাই টস জিতেও প্রথমে সিনারকে সার্ভিস করার আমন্ত্রণ জানান। পরিকল্পনা কাজেও লাগান আলকারাজ়। প্রথম গেমেই সিনারের সার্ভিস ভেঙে দেন তিনি। সেই শুরু। সপ্তম গেমে আরও এক বার সিনারের সার্ভিস ভাঙেন আলকারাজ়। মাঝে মাঝেই নেটের সামনে চলে আসছিলেন আলকারাজ়। সিনারের সামনে জায়গা ছোট করে দিচ্ছিলেন তিনি। তাতেই আনফোর্সড এরর করছিলেন সিনার। সেই ভুলের খেসারত দিতে হয় তাঁকে। আলকারাজ় জানতেন, সিনারকে হারাতে গেলে শুধু র্যাকেটের লড়াইয়ে নয়, মানসিক লড়াইয়েও জিততে হবে। সেটাই শুরু থেকে করতে থাকেন তিনি। প্রতিটি পয়েন্টের পর হুঙ্কার দিতে শুরু করেন। সিনারের স্বভাব আলাদা। খুব একটা উচ্ছ্বাস করেন না তিনি। শান্ত থাকেন। তিনি কি আলকারাজ়ের হুঙ্কারে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন? নইলে যে ভাবে সহজ কিছু শট তিনি ভুল খেললেন তা সাধারণত তাঁর কাছে দেখা যায় না।
দ্বিতীয় সেটেও প্রথম গেমে সিনারের সার্ভিস ভাঙার সুযোগ পান আলকারাজ়। কিন্তু সিনার কোনও মতে সার্ভিস ধরে রাখেন। প্রথম সেটের তুলনায় তাঁর সার্ভিস দ্বিতীয় সেটে ভাল হয়। উল্টে আলকারাজ় একটু বেশি আক্রমণাত্মক শট খেলতে গিয়ে কয়েকটি ভুল করে ফেলেন। চতুর্থ গেমে আলকারাজ়ের সার্ভিস ভাঙেন সিনার। গোটা ম্যাচে ওই এক বারই নিজের সার্ভিস খোয়ান আলকারাজ়। দ্বিতীয় সেট জিতে খেলায় ফেরেন সিনার। এ বারের ইউএস ওপেনে ওই এক বারই সেট খুইয়েছেন আলকারাজ়।
দেখে মনে হচ্ছিল, উইম্বলডনের পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে। তবে তার জন্য সিনারকে ভাল খেলতে হত। আলকারাজ় সেটা হতে দেননি। তিনি সিনারকে বার বার ভুল করতে বাধ্য করলেন। গোটা ম্যাচে সিনারকে ভোগাল তাঁর সার্ভিস। প্রথম সার্ভিস জায়গায় রাখতে পারছিলেন না তিনি। প্রথম সার্ভিস থেকে ৬৯ শতাংশ পয়েন্ট পেয়েছেন সিনার। সেখানে আলকারাজ় তাঁর প্রথম সার্ভিস কাজে লাগিয়ে ৮৩ শতাংশ পয়েন্ট জিতে নিয়েছেন। গোটা ম্যাচে চার বার ডবল ফল্ট করেছেন সিনার। আলকারাজ় এক বারও সেই ভুল করেননি। সিনারের দু’টি ‘এস’-এর পাল্টা ১০টি ‘এস’ মারেন আলকারাজ়। এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট কী ভাবে দাপট দেখিয়েছে আলকারাজ়।
তৃতীয় সেটে সবচেয়ে খারাপ টেনিস খেললেন সিনার। শেষ কবে তিনি এত ভুল করেছেন মনে পড়ছে না। সিনারের প্রথম সার্ভিস ভাঙেন আলকারাজ়। চতুর্থ গেমে আবার সার্ভিস খোয়ান সিনার। পর পর পাঁচটি গেম জিতে নেন আলকারাজ়। কোনও রকমে ব্যাগেল (০-৬ এ হার)-এর লজ্জা কাটান সিনার। তবে তত ক্ষণে মানসিক ভাবে তিনি অনেকটা পিছিয়ে পড়েছেন। ম্যাচের শুরু থেকে আলকারাজ় যে মানসিক লড়াই খেলছিলেন, তা তত ক্ষণে জিতে নিয়েছেন তিনি।
চতুর্থ সেটেও একই ছবি। আরও এক বার সিনারের সার্ভিস ভাঙলেন আলকারাজ়। ফাইনালে আলকারাজ় সার্ভিসের জন্য গড় সময় নিয়েছেন ২ মিনিট। সিনার সেখানে প্রায় সাড়ে ৪ মিনিট। বোঝা গিয়েছে, নিজের সার্ভিস ধরে রাখতে কতটা সমস্যা হয়েছে তাঁর। চতুর্থ সেটেও সেটা দেখা গেল। আলকারাজ়ের বিরুদ্ধে দু’টি ম্যাচ পয়েন্ট বাঁচালেও আর ফিরতে পারেননি সিনার। তৃতীয় ম্যাচ পয়েন্ট কাজে লাগিয়ে চ্যাম্পিয়ন হলেন আলকারাজ়। হতাশ হয়ে কোর্ট ছাড়তে হল সিনারকে।