করোনার ধাক্কা: কী প্রভাব বাংলার খেলায়/ সাঁতার
Coronavirus

গর্ব মুছে অন্ধকার, সৌবৃতিদের সম্বল এখন নিজের জেদ

দিল্লি সাইয়ের এই ছাত্র ফোনে বললেন, ‍‘‍‘এখন হাত-পায়ের পেশির ব্যায়াম করছি। জলে এত দিন নামিনি। পেশিশক্তি নষ্ট হচ্ছে।”

Advertisement

দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২০ ০৬:৩৩
Share:

মহড়া: জলে নামা যাবে না। বাড়ির ছাদেই ট্রেনিং চলছে সৌবৃতির। নিজস্ব চিত্র।

পাখির চোখ ২০২২ সালের বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমস। তার জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন এই মুহূর্তে বাংলার অন্যতম সেরা সাঁতারু স্বদেশ মণ্ডল।

Advertisement

৪০০ মিটার ব্যক্তিগত মেডলিতে নির্বাচিত হওয়ার সময় ৪.২৮ মিনিট। চম্পাহাটির স্বদেশের দাবি, অনুশীলনে ৪.৩০ মিনিট করে ফেলেছিলেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রকোপে তাঁর সব প্রচেষ্টা আপাতত জলে। পাঁচ মাসেরও বেশি সময় অনুশীলনেই নামা হয়নি তাঁর।

দিল্লি সাইয়ের এই ছাত্র ফোনে বললেন, ‍‘‍‘এখন হাত-পায়ের পেশির ব্যায়াম করছি। জলে এত দিন নামিনি। পেশিশক্তি নষ্ট হচ্ছে। কিছু করারও নেই।’’ যোগ করেন, ‍‘‍‘সাঁতার কবে শুরু হবে কেউ জানে না। জলে নামার পরে সাঁতারু না চাইলেও লালা, শ্লেষ্মা মিশবেই। তাই ফের সাঁতার শুরুর স্বপ্নটাও দেখতে পাচ্ছি না। আর শুরু হলেও অন্তত দেড় বছর পিছিয়ে পড়ব।’’

Advertisement

বাংলার মহিলাদের মধ্যে অন্যতম দুই সেরা সাঁতারু সালকিয়ার সৌবৃতি মণ্ডল ও বালির সায়নী ঘোষ। দিল্লিতে স্বদেশের সঙ্গেই অনুশীলন করেন সৌবৃতি। দু’বছর আগে জাতীয় সাঁতারে সোনাজয়ী এই সাঁতারুও বললেন, ‍‘‍‘স্বপ্ন তো ধাক্কা খাচ্ছেই। সাঁতার তো আর ভিডিয়ো ক্লাস করে হবে না!’’ আজ পর্যন্ত বাংলা থেকে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেওয়া একমাত্র মহিলা সায়নীর মন্তব্য, ‍‘‍‘সাঁতার ফের শুরু হলে, সকলের কাছেই কাজটা কঠিন হবে। কিন্তু আমার কাছে তা আরও কঠিন। কাঁধের চোটের জন্য গত বছর সাঁতার কাটিনি। আগামী বছর জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য নিজেকে তৈরি করছিলাম। কিন্তু সেই প্রস্তুতিও বন্ধ রাখতে হয়েছে।’’ বেশির ভাগ সুইমিং পুল বন্ধ। সকলেরই ভয়, দীর্ঘ লকডাউনে অনুশীলনের অভাবে না দক্ষতাটা মারাত্মক ধাক্কা খায়। একই রকম হতাশা গত পাঁচ বছরে জাতীয় স্তর থেকে সোনাজয়ী সাঁতারু শানু দেবনাথ, শ্রেয়ন্তী পানেদের মধ্যেও। করোনার ত্রাস এঁদের সুইমিং পুলে নামাটাই বন্ধ করে দিয়েছে! এই সময়ে সাঁতারুরা কী ভাবে তা হলে নিজেদের তরতাজা রাখবেন? বুলা চৌধুরীর মতো দূরপাল্লার কিংবদন্তি সাঁতারুর জবাব, ‍‘‍‘সব মিলিয়ে বাংলার সাঁতারের পরিস্থিতি মোটেও ভাল নয়। দু’তিন জন ছাড়া বাকিদের দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হবে। এঁদের জন্য রাজ্য সংস্থার কোনও উদ্যোগ তো দেখিনি।’’ বুলার প্রশ্ন, ‘‘স্বদেশ, সৌবৃতিরা ভিনরাজ্যে কেন সাঁতার শিখতে গেল? এখানে না আছে ভাল কোচ, না আছে আধুনিক সুইমিং পুল।’’

স্বাধীনতার পরে পাঁচ দশক জাতীয় সাঁতারে বাংলার রমরমা ছিল। এখন সবই অতীত। তার উপরে রাজ্য সংস্থায় তুমুল অর্ন্তদ্বন্দ্ব। এক বছর আগেই নতুন কমিটি দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। তাতে কী উপকার হয়েছে, কেউ জানে না। রাজ্য অলিম্পিক সংস্থাও এই কমিটিকে কতটা গুরুত্ব দেয়, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সম্প্রতি খেলো ইন্ডিয়ায় ১২টি সোনা জিতে ফিরেছিলেন বাংলার সাঁতারুরা। কিন্তু কর্তাদের অর্ন্তদ্বন্দ্বের কারণেই রাজ্য গেমসে সাঁতারুদের নামতে দেওয়া হয়নি। এ সবের ফল, জাতীয় সাঁতারে এক সময় প্রথম বেঞ্চে থাকা বাংলা পিছনের বেঞ্চে চলে গিয়েছে।

২০০০ সালে জাতীয় সাঁতারে সাতটি সোনা জয়ী আকবর আলি মীর বলছেন, ‍‘‍‘কী ভাবে এগোবে বাংলার সাঁতার? দু’তিনটির বেশি ভাল সুইমিং পুলই তো নেই। মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, গোয়া, তামিলনাড়ুর বাচ্চারা প্রথম দিন থেকেই পুলে নেমে আধুনিক প্রশিক্ষণ পাচ্ছে। এখানে কিছু নেই।’’ প্রায় দেড় দশক কলকাতার পূর্বঞ্চলীয় সাই থেকে কোচ হওয়ার পদ্ধতি বন্ধ। বাংলার প্রাক্তন সাঁতারুদের কোচিং শিখতে ছুটতে হয় পাটিয়ালা। কেন বন্ধ? রাজ্য সাঁতার সংস্থার প্রাক্তন প্রধান রামানুজ মুখোপাধ্যায়ের জবাব, ‍‘‍‘প্রচুর চিঠি লিখেছি। কাজ হয়নি।’’ দীর্ঘ দিন ধরে ক্ষমতায় থাকা রামানুজদের দিকেও নানা অভিযোগের আঙুল ওঠে।

কলকাতায় সাইয়ের সুইমিং পুলে ডাইভিং বোর্ড নেই বলে সাঁতারুদের মধ্যে ক্ষোভ প্রবল। দুবাই থেকে সাঁতারের জাতীয় কোচ প্রদীপ কুমার যদিও বললেন, ‍‘‍‘সাঁতারে বাংলাই পথপ্রদর্শক। জেলায় সুইমিং পুল বানিয়ে সাঁতারকে ছড়িয়ে দিলেই প্রচুর প্রতিভা আসবে।’’

জাতীয় সাঁতারে সত্তর ও আশির দশকে চ্যাম্পিয়ন আশিস দাস, অভিজিৎ ঘোষেরা বলছেন, ‍‘‍‘সরকারি বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে অ্যাকাডেমি নেই। চাকরি নেই। ভবিষ্যতের সাঁতারুরা উৎসাহিত হবে কেন? আমাদের সময়ে কলেজ স্কোয়ার, হেঁদুয়াতে গিজগিজ করত সাঁতারুর ভিড়। এখন সারা বছরে ক্লাবগুলিতে সাকুল্যে ১০০ বা ১৫০ জন করে ভর্তি হয়। আমাদের সময়ে দিনে এক একটা ক্লাবে ৫০০-১০০০ জন সাঁতার কাটতে আসত। তাই দাপট ছিল জাতীয় স্তরে।’’

রাজ্য সংস্থার সভাপতি দেবাশিস কুমার বলছেন, ‍‘‍‘বাচ্চাদের মধ্যে সংক্রমণের আশঙ্কাতেই সাঁতার শুরু হয়নি।’’ দাবি করছেন, ‍‘‍‘সুভাষ সরোবর ও দেশবন্ধু পার্কে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরির কাজ লকডাউনের জন্য বন্ধ। আর কোচ কম নেই। প্রাক্তনরা পরামর্শ দিলে তা শুনেই এগোবো।’’

করোনার আতঙ্ক দূর হয়ে লকডাউন উঠলেও কি বঙ্গ সাঁতারের সুদিন ফিরে আসবে? সময়ই বলবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন