বিশ্বকাপ জেতার পর ট্রফি হাতে উল্লাস ভারতীয় ক্রিকেটারদের। ছবি: পিটিআই।
স্বাবলম্বী হল ভারতের মহিলা ক্রিকেট। ২০০৫, ২০১৭ সালেই হতে পারত। অল্পের জন্য হাতছাড়া হয়েছিল বিশ্বজয়ের শিরোপা। এ বার আর তা হতে দেননি হরমনপ্রীত কৌরেরা। রবিবার ডিওয়াই পাতিল স্টেডিয়ামে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জেতার পর ভারতের আকাশে নতুন ১৫ মহিলা তারকা জন্ম নিলেন। পিটি ঊষা, সাইনা নেহওয়াল, সানিয়া মির্জ়া, পিভি সিন্ধুদের পর আবার কারও নাম ধরে স্লোগান তোলার সুযোগ পেল ভারতের ক্রীড়াপ্রেমী জনতা।
শুরুটা হয়েছিল ১৯৮৪ সালে ঊষার হাত ধরে। লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক্সে রাতারাতি তারকা হয়েছিলেন এই স্প্রিন্টার। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে কেউ একটু জোরে দৌড়োলেই সকলে বলতেন, “পিটি ঊষার মতো দৌড়োচ্ছে।” তার পর আসেন সানিয়া মির্জ়া। ভারতের মহিলা টেনিসকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে যান। ডবলসে তিনটি ও মিক্সড ডবলসে তিনটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতেন। সেই সময় সানিয়াকে দেখে ভারতের অনেক বাচ্চা মেয়ে হাতে র্যাকেট তুলে নিয়েছিল। ক্রীড়া ‘আইকন’-এ পরিণত হয়েছিলেন সানিয়া।
সানিয়া টেনিসে যে কাজটা করেছেন, সেটাই ব্যাডমিন্টনে করেছেন দুই তারকা। সাইনা নেহওয়াল ও পিভি সিন্ধু। শুরুটা করেছিলেন সাইনা। ২০১২ লন্ডন অলিম্পিক্সে ব্রোঞ্জ, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে একটি করে রুপো ও ব্রোঞ্জ, কমনওয়েলথ গেমসে তিনটি সোনা, একটি করে রুপো ও ব্রোঞ্জ জেতেন। সেই পথ ধরে আসেন সিন্ধু। তিনি ছাপিয়ে যান সাইনাকেও। ২০১৬ রিয়ো অলিম্পিক্সে রুপো, ২০২০ টোকিয়ো অলিম্পিক্সে ব্রোঞ্জ জেতেন। পাশাপাশি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে একটি সোনা, দু’টি করে রুপো ও ব্রোঞ্জ, কমনওয়েলথ গেমসে দু’টি সোনা, দু’টি রুপো ও একটি ব্রোঞ্জ জেতেন তিনি। ১৯৮৪ থেকে ২০২০, এই ৩৬ বছরে ভারতের খেলাধুলোয় মহিলা তারকা বলতে এই চার জনই।
এই চার জনের পর ভারতের ক্রীড়া মানচিত্রে কর্নম মালেশ্বরী, মনু ভাকের, সাক্ষী মালিক, বিনেশ ফোগাট, দীপা কর্মকার, দীপিকা কুমারী, রানি রামপালেরা এসেছেন। প্রত্যেকে নিজেদের ছাপ রেখেছেন। কিন্তু ঊষা, সানিয়াদের মতো তারকা হতে পারেননি। সেই জায়গা ফাঁকা ছিল এত বছর। তা ভরাট করলেন হরমনপ্রীতেরা।
অস্ট্রেলিয়াকে সেমিফাইনালে হারিয়েছে ভারত। যে দু’জন দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়েন সেই জেমাইমা রদ্রিগেজ় ও আমনজ্যোৎ কৌর, কেউই দীর্ঘদেহী বা পেশিবহুল নন। ঊষার মতো জোরে তাঁরা দৌড়াতে পারেন না। কিন্তু ৫ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার দুই ক্রিকেটার মহিলাদের ক্রিকেটের ‘দৈত্য’ অস্ট্রেলিয়ার বিজয়রথ থামিয়ে দিয়েছেন।
ক্রিকেট ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। ঘরে ঘরে বাচ্চারা হাতে তুলে নেয় ব্যাট-বল। চলে যায় মাঠে। কেউ বা ভর্তি হয় অ্যাকাডেমিতে। কেউ খেলে মনের আনন্দে। আবার কেউ স্বপ্ন দেখে ক্রিকেটকে পেশা করার। ভারতের পুরুষদের ক্রিকেটে তারকার অভাব কোনও দিন ছিল না। সুনীল গাওস্কর, কপিল দেব, সচিন তেণ্ডুলকর, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, রাহুল দ্রাবিড়, অনিল কুম্বলে, যুবরাজ সিংহ, মহেন্দ্র সিংহ ধোনি, রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি থেকে হালের শুভমন গিল, অভিষেক শর্মা। তালিকাটা বেশ লম্বা।
কিন্তু মহিলাদের ক্রিকেটে এত দিন কী ছিল? মিতালি রাজ ও ঝুলন গোস্বামী প্রায় দু’দশক ধরে ভারতের মহিলাদের ক্রিকেট টেনেছেন। দু’বার দেশকে এক দিনের বিশ্বকাপের ফাইনালে তুলেছিলেন। জিততে পারলে হয়তো তারকার মর্যাদা পেতেন। পারেননি। সেই আক্ষেপ এত দিনে মিটল।
ভারতের মহিলাদের ক্রিকেটে গত কয়েক বছর ধরে বদল শুরু হয়েছিল। মহিলাদের আইপিএল ও আরও কয়েকটি ঘরোয়া লিগ শুরু হওয়ায় খেলার প্রসার ঘটে। তার হাত ধরে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে উঠে আসেন ক্রিকেটারেরা। রিচা ঘোষ, ক্রান্তি গৌড়, আমনজ্যোৎ, শ্রী চরণীরা তারই ফসল। এই ক্রিকেটারদের লড়াই করে উঠে আসতে হয়েছে। তাই হয়তো কঠিন পরিস্থিতিতেও ভেঙে পড়েন না তাঁরা। শান্ত থাকেন। খেলা জেতেন। তার পর উল্লাসে মাতেন।
ভারতের মহিলা ক্রিকেটের এই উত্থানের প্রভাব পড়েছে সমর্থনেও। ২০১২ সালে ভারতের মুম্বইয়ে মহিলাদের বিশ্বকাপের ফাইনালে দেখা গিয়েছিল গ্যালারিতে মাঠকর্মী ছাড়া বিশেষ কেউ নেই। ১২ বছর পর ডিওয়াই পাতিল স্টেডিয়ামের গ্যালারি ভর্তি। মাঠের ভিতরে যত দর্শক, বাইরে তত মানুষ বড় পর্দায় খেলা দেখেছেন। জিয়োহটস্টারে খেলা দেখেছেন ৩২ কোটি দর্শক। যা পুরুষদের খেলার থেকেও বেশি। এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে হরমনপ্রীতদের খেলার মধ্যে দিয়ে। তাঁরা সাফল্য এনেছেন। সেই সাফল্যে মেতেছেন দেশবাসী।
বলিউডে মহিলাদের খেলাধুলো নিয়ে ছবি কম হয়নি। শাহরুখ খানের ‘চক দে ইন্ডিয়া’য় দেখা গিয়েছিল, বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ভারত। খেলাধুলোর এক অন্য জাতীয় সঙ্গীত তৈরি হয়েছিল সেই ছবিতে। তার পর তা ভারতের পুরুষদের খেলায় বহু বার বেজেছে। রবিবার বাজল ডিওয়াই পাতিল স্টেডিয়ামে। হরমনপ্রীতদের বিশ্বজয়ের পরে। সত্যিই, এই বিশ্বকাপ জয় যেন ভারতের ক্রিকেটকে পূর্ণতা দিল। সেই সঙ্গে ভারতের আকাশে জন্ম দিল ১৫ নতুন তারকার।