মহম্মদ সিরাজের (বাঁ দিকে) খারাপ বোলিংয়ে হতাশা বাড়ল অধিনায়ক শুভমন গিলের। ছবি: রয়টার্স।
মুখের হাসি উধাও শুভমন গিলের। অধিনায়ক হিসাবে নিজের প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় দিনই চাপে পড়লেন তিনি। বুঝতে পারলেন, টেস্ট ক্রিকেটে অধিনায়কত্ব কতটা কঠিন। কত রকম পরিকল্পনা রাখতে হয় অধিনায়ককে। নইলে কী ভাবে খেলার রাশ হাত থেকে বেরিয়ে যায়। হেডিংলেতে প্রথম দিন ভারত যে ভাবে দাপট দেখিয়েছিল, দ্বিতীয় দিন ততটাই হতাশ করল তারা। দিনের খেলা শেষে ইংল্যান্ডের রান ৩ উইকেটে ২০৯। তা-ও শেষ দিকে বুমরাহ দলকে খেলায় না ফেরালে আরও ভাল জায়গায় থাকত তারা। ভারতের থেকে ২৬২ রান পিছিয়ে ইংল্যান্ড। তবে দ্বিতীয় দিন যে ভাবে খেলা হয়েছে তাতে তৃতীয় দিন ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংস শেষ করতে পরিকল্পনা বদলাতে হবে ভারতকে। ইংল্যান্ডের ইনিংস টানছেন ওলি পোপ। ১০০ রান করে অপরাজিত তিনি। দ্বিতীয় দিন আরও বড় ইনিংসের লক্ষ্যে নামবেন ইংরেজ ব্যাটার।
ভারতের এই হতাশার কারণ খুঁজতে বসলে তিনটে প্রধান বিষয় উঠে আসছে। ১) লোয়ার অর্ডারের ব্যর্থতা। ২) জসপ্রীত বুমরাহ ছাড়া ব্যর্থ ভারতের বোলিং আক্রমণ। ৩) ক্যাচ ফস্কানো। এই তিন ভুলের খেসারত দিতে হল শুভমনদের। এই তিন ভুলের জন্য ধীরে ধীরে খেলার রাশ হারিয়ে ফেলল ভারত।
প্রথম দিন যেখানে শেষ করেছিলেন, দ্বিতীয় দিন সেখান থেকেই শুরু করেন শুভমন ও ঋষভ পন্থ। যশস্বী ও শুভমনের পর পন্থও নিজের শতরান করেন। যে ইনিংসে তিন ব্যাটার শতরান করেছেন, সেখানে অন্তত ৫৫০-৬০০ রান হওয়া উচিত। তার বদলে ৪৭১ রানে শেষ হয়ে গেল ভারতের প্রথম ইনিংস। একটা সময় রান ছিল ৩ উইকেটে ৪৩০। পরের ৪১ রানে ৭ উইকেট পড়ল। শুরুটা হল শুভমনকে দিয়ে। বড় শট খেলতে গিয়ে ফিরলেন তিনি। করুণ নায়ার আউট হওয়ার পর সাজঘর থেকে নির্দেশ পাঠালেন কোচ গৌতম গম্ভীর। পন্থকে সাবধানে খেলতে বললেন তিনি। সেখানেই খেই হারিয়ে ফেললেন পন্থ। তিনি এমন একজন ব্যাটার, যিনি নিজের ছন্দে খেলেন। তাঁকে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে বললেন হিতে বিপরীত হয়। সেটাই হল। যে বলে তিনি আউট হলেন সেই বলে কোনও শট খেলারই চেষ্টা করেননি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আউট হলেন তিনি।
তার পরেই দেখা গেল ভারতের সেই পুরনো রোগ। লোয়ার অর্ডারের আয়ারাম-গয়ারাম দশা। শার্দূল ঠাকুর, রবীন্দ্র জাডেজারা রান করতে পারলেন না। টেস্টের ইতিহাসে এক ইনিংসে তিন ব্যাটারের শতরানের পর ভারতের করা ৪৭১ রান সর্বনিম্ন। টেস্টে সেই দলই বড় রান করে যাদের লোয়ার অর্ডার রান পায়। দেশের মাটিতে তা-ও জাডেজা, অশ্বিনেরা রান করতেন। কিন্তু বিদেশে লোয়ার অর্ডারের কাছ থেকে সাহায্য ভারত এখনও পাচ্ছে না। ফলে যে ভিত শুভমনেরা তৈরি করেছিলেন, তা কাজে লাগল না। অন্তত ৫৫০ রান করলে চাপ আরও বেশি থাকত ইংল্যান্ডের উপর।
ভারতের ইনিংস শেষ হওয়ার পর ইংল্যান্ডের ওপেনারেরা নামতে যাওয়ার সময় শুরু হল বৃষ্টি। খেলা বন্ধ থাকল। বৃষ্টি থামার পর বেন ডাকেট ও জ্যাক ক্রলি যখন নামলেন তখনও আকাশে মেঘ। এই আবহাওয়ায় বল স্বাভাবিকের থেকে বেশি সুইং করে। প্রথম স্পেলে বুমরাহ তা করে দেখালেন। দেখে মনে হল, তিনি এক পিচে বল করছেন। বাকিরা অন্য পিচে। বুমরাহের বল খেলতে সমস্যা হচ্ছিল ইংরেজ ব্যাটারদের। প্রথম ওভারেই ক্রলিকে ফেরালেন তিনি। প্রতি ওভারে অন্তত দুটো করে সুযোগ তৈরি করছিলেন বুমরাহ। সেখানে মহম্মদ সিরাজ প্রথম তিন ওভারে দিলেন ২৪ রান। প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ প্রথম চার ওভারে দিলেন ২৮ রান। তাতে ইংরেজ ব্যাটারদের উপর থেকে চাপ কমে গেল। একই অবস্থা জাডেজারও। তাঁর বলে স্পিন বিশেষ হল না। সহজেই প্রায় প্রতি ওভারে বড় শট মারছিলেন ইংরেজ ব্যাটারেরা। রান তোলার গতি কমতে দেননি তাঁরা। ইংল্যান্ডের তিনটে উইকেটই নেন বুমরাহ। দিনের শেষ ওভারে হ্যারি ব্রুককেও আউট করেছিলেন তিনি। কিন্তু নো বলের কারণে ব্রুক আরও এক বার সুযোগ পান। নইলে ৪ উইকেট থাকত বুমরাহের ঝুলিতে।
এই পরিস্থিতিতেও কেন যে শার্দূলকে ৪০তম ওভারে বল করতে দেখা গেল, তার জবাব একমাত্র শুভমনই দিতে পারবেন। শার্দূল রান দিলেও উইকেট নেওয়ার ক্ষমতা আছে তাঁর। প্রস্তুতি ম্যাচে ভাল খেলেছেন। নতুন বলে দু’দিকে সুইং করাতে পারেন তিনি। তার পরেও তাঁকে এত দেরিতে বল দিলেন শুভমন। তত ক্ষণে বল পুরনো হয়ে গিয়েছে। ফলে তিনিও বিশেষ কিছু করতে পারলেন না। বুমরাহ ছাড়া বাকিদের বোলিং দেখে মনে হচ্ছে না ইংরেজ ব্যাটারদের আউট করতে পারবেন তাঁরা। ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে সুনীল গাওস্করও জানালেন, একা বুমরাহের উপর ভরসা করলে কী ভাবে হবে? বাকিদেরও তো তাঁকে সাহায্য় করতে হবে। সেটা দেখা গেল না দ্বিতীয় দিন।
বোলারদের কাজ আরও কঠিন করে দিল ভারতের ফিল্ডিং। বুমরাহের বলে তিনটে ক্যাচ পড়ল। তার মধ্যে ডাকেটেরই দু’বার। এক বার স্লিপে যশস্বী জয়সওয়াল ক্যাচ ছাড়লেন। তাঁর ক্যাচ কঠিন হলেও পয়েন্টে জাডেজা যে ক্যাচ ছাড়লেন তা অন্য সময়ে দশ বারের মধ্যে দশ বারই তিনি ধরবেন। সেই ডাকেট করলেন ৬২ রান। চা বিরতির পর বুমরাহের বলে ক্যাচ তুলেছিলেন ওলি পোপ। সেই ক্যাচও স্লিপে ছাড়েন যশস্বী। গত অস্ট্রেলিয়া সফরে স্লিপে বেশ কয়েকটা ভাল ক্যাচ ধরেছিলেন যশস্বী। সেই কারণেই তাঁকে সেখানে রাখা হয়েছিল। কিন্তু এ দিন তিনি ব্যর্থ। জীবনদান কাজে লাগালেন পোপ। শতরান করলেন তিনি। গত বছর ভারত সফরে এসে প্রথম টেস্টে শতরান করেছিলেন তিনি। এ বারও প্রথম টেস্টে তাঁর ব্যাটিং ভাল দেখাচ্ছে। দিনের শেষে ১০০ রানে অপরাজিত তিনি।
ভারতের ফিল্ডারেরা ক্যাচগুলো ধরতে পারলে হয়তো খেলার ছবিটা অন্য রকম হত। কিন্তু দ্বিতীয় দিন যে ভাবে খেলা হল, তাতে চিন্তা বাড়তে বাধ্য শুভমনের। শুরুতেই চাপ বাড়ল তাঁর উপর। মুখের হাসি উধাও হল শুভমনের।