ক্রান্তি গৌড়কে (মাঝে) জড়িয়ে উল্লাস হরমনপ্রীত কৌর (বাঁ দিকে) ও স্মৃতি মন্ধানার। ছবি: পিটিআই।
রবিবার ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ শুরু হওয়ার আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল দেওয়াল লিখন। সম্প্রচারকারী চ্যানেলে সূর্যকুমার যাদব বলছিলেন, মহিলাদের এক দিনের ক্রিকেটে ১১-০ ব্যবধানে এগিয়ে ভারত। কোথায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা? কোনও লড়াই নেই। একদম একপেশে। বাস্তবেও সেটাই দেখা গেল। কোথায় লড়াই? ভারতের একপেশে দাপটে ৮৮ রানে হারল পাকিস্তান। একাই লড়লেন সিদরা আমিন। কাউকে সঙ্গে পেলেন না তিনি। ১১-০ হল ১২-০। এশিয়া কাপে তিন বার পাকিস্তানকে হারিয়েছিল ভারত। মহিলাদের বিশ্বকাপেও সেই ধারা দেখা গেল। চার রবিবার চার বার পাকিস্তানকে হারাল ভারত।
তবু কি খুব খুশি হতে পারবেন হরমনপ্রীত কৌর? বোধহয় না। শ্রীলঙ্কার মাঠে পাকিস্তানকে হারালেও চিন্তা থেকেই গেল ভারতের। একটা নয়, তিন তিনটে ক্ষেত্রে। প্রথমত, আরও এক ম্যাচে ব্যাটারেরা শুরু করেও বড় রান করতে পারলেন না। দ্বিতীয়ত, আরও এক ম্যাচে স্পিনারেরা সেই দাপট দেখাতে পারলেন না। তবে সবচেয়ে বেশি চিন্তায় রাখল ভারতের ফিল্ডিং। যে ভাবে ক্যাচ পড়ল, তা অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের মতো দলের বিরুদ্ধে হলে খেসারত দিতে হবে ভারতকে।
ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ কি বিতর্কের বাইরে থাকে? টস থেকেই শুরু বিতর্ক। পাকিস্তানের অধিনায়ক ফাতিমা সানা ‘টেল’ বলেছিলেন। হল ‘হেড’। অথচ, সকলকে অবাক করে দিয়ে সঞ্চালক বললেন, হেড বলেছিলেন ফাতিমা। তিনিই টস জিতেছেন। ম্যাচ রেফারিও কোনও আপত্তি করলেন না। সবচেয়ে আশ্চর্যের ঘটনা ঘটালেন হরমনপ্রীত। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। ভারত অধিনায়কও বললেন না ফাতিমা ‘টেল’ বলেছেন। তিনিও মেনে নিলেন। নাকি হাত না মেলানোর দিকে তাঁর এতটাই মন ছিল যে টসের কলই শুনতে পাননি।
প্রথমে ব্যাট করতে নেমে শুরুটা খারাপ করেনি ভারত। দুই ওপেনার স্মৃতি মন্ধানা ও প্রতিকা রাওয়াল ভাল খেলছিলেন। বিশেষ করে প্রতিকা। পাওয়ার প্লে কাজে লাগাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু আরও একটি ম্যাচে শুরু পেয়েও উইকেট ছুড়ে দিয়ে এলেন দুই ওপেনার। ফাতিমার বলে লাইন মিস্ করে এলবিডব্লিউ হলেন স্মৃতি (২৩)। অস্ট্রেলিয়া সিরিজ়ের ফর্ম হয়তো মাঠের বাইরে নেমেছেন তিনি। প্রতিকা ৩১ রান করে সাদিয়া ইকবালের সোজা বলে বোল্ড হলেন।
হরলীন দেওল তিন নম্বরে নেমে দলের হাল ধরেন। অধিনায়ক হরমনপ্রীত আরও একটি ম্যাচে রান পেলেন না। ১৯ রান করে লেগ স্টাম্পের বলে খোঁচা মেরে ফিরলেন তিনি। জেমাইমা রদ্রিগেজ়ও তাড়াতাড়ি আউট হতেন। তাঁর ক্যাচ উইকেটরক্ষক ধরলেও নো বল করেন ডায়ানা বেগ। জীবন পেয়ে তা কাজে লাগান জেমাইমা। দুই ব্যাটার জুটি বাঁধেন। তবে রান তোলার গতি খুব বেশি ছিল না। গতি বাড়াতে বড় শট মারার চেষ্টা করেন হরলীন। ৪৬ রান করে আউট হন তিনি। শ্রীলঙ্কার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অর্ধশতরান পেলেন না ভারতীয় ব্যাটার। জেমাইমা করে ৩২ রান।
পর পর উইকেট পড়ায় রিচা ঘোষকে আগে নামায়নি ভারত। তাঁর বদলে দীপ্তি শর্মা নামেন। স্নেহ রানার সঙ্গে জুটি বাঁধেন তিনি। আগের ম্যাচেও কঠিন পরিস্থিতি থেকে দলকে বার করেছিলেন দীপ্তি। এই ম্যাচে চেষ্টা করলেও বেশি রান করতে পারেননি। দীপ্তি ২৫ ও স্নেহ ২০ রান করেন।
দেখে মনে হচ্ছিল, ২২০ রানের বেশি হবে না ভারতের। সেখান থেকে দলকে টানলেন রিচা। যে কারণে তাঁকে আগে নামানো হয়নি, সেটাই করলেন তিনি। আট নম্বরে নেমে ঝোড়ো ইনিংস খেললেন বাংলার মেয়ে। ২০ বলে ৩৫ রান করলেন তিনি। মারলেন তিনটি চার ও দু’টি ছক্কা। তাঁর ব্যাটে ২৪৭ রান করল ভারত। শেষ বলে অল আউট হল দল। এক দিনের ক্রিকেটে এই প্রথম ভারতকে অল আউট করল পাকিস্তান। আরও এক নজির হল। কোনও ব্যাটার অর্ধশতরান না করলেও মহিলাদের এক দিনেক ক্রিকেটে এই প্রথম কোনও দল এত রান করল।
পাকিস্তানের সামনে ২৪৮ রান বড় লক্ষ্য ছিল। ভারতের দুই পেসার ক্রান্তি গৌড় ও রেণুকা সিংহ ঠাকুরের সামনে সেই লক্ষ্য আরও বড় হয়ে দেখা দিল। দুই পেসারের সামনে হাত খুলতেই পারছিলেন না পাকিস্তানের ব্যাটারেরা। প্রথম ওভারেই উইকেট পেতে পারতেন রেণুকা। কিন্তু রিচার কথায় রিভিউ নেননি হরমনপ্রীত। চতুর্থ ওভারে আবার নাটক। ক্রান্তির বল মুনিবা আলির প্যাডে লাগে। এলবিডব্লিউয়ের আবেদন করেন ভারতীয় ক্রিকেটারেরা। আম্পায়ার আউট দেননি। ভারত রিভিউ নেয়নি। কিন্তু সেখানেই ঘটনা থেমে থাকেনি। পয়েন্টে দাঁড়িয়ে ছিলেন দীপ্তি শর্মা। তিনি বল ধরে উইকেটে ছোড়েন। বল উইকেটে লাগে। কিন্তু মাঠের আম্পায়ার জানিয়ে দেন, মুনিবা ক্রিজ়ে ছিলেন।
মাঠের আম্পায়ারকে থামিয়ে দেন তৃতীয় আম্পায়ার কেরিন ক্লাস্তে। তিনি রিপ্লে দেখেন। তাতে দেখা যায়, মুনিবার ব্যাট ক্রিজ়ের ভিতরে থাকলেও ঠিক যে মুহূর্তে দীপ্তির থ্রো উইকেটে লেগেছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই মুনিবার ব্যাট হাওয়ায় উঠেছে। অর্থাৎ, রান আউট হয়েছেন তিনি। তৃতীয় আম্পায়ার আউটের সিদ্ধান্ত জানান।
তৃতীয় আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের পরেও মাঠে দাঁড়িয়েছিলেন মুনিবা। তাঁর দাবি, বল ডেড হয়ে গিয়েছে। তার পর কী ভাবে আউট হবেন তিনি? সাজঘর থেকে বেরিয়ে এসে ডাগ আউটের কাছে দাঁড়িয়ে তৃতীয় আম্পায়ারের সঙ্গে তর্কে জড়ান ফাতিমা। পাকিস্তানের অধিনায়কও বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে, বল ডেড হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তৃতীয় আম্পায়ার নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। ফিরতে হয় মুনিবাকে। প্রথম ১০ ওভারে মাত্র ২৫ রান করে পাকিস্তান। সেখানেই হেরে যায় তারা।
পাকিস্তানের টপ অর্ডারে সিদরা আমিন ছাড়া কেউ রান পাননি। তাঁকে অবশ্য সুবিধা করে দেন রিচা। দু’বার তাঁর ক্যাচ ফস্কান ভারতীয় উইকেটরক্ষক। জীবন পেয়ে তা কাজে লাগান সিদরা। নাতালিয়া পারভেজের সঙ্গে চতুর্থ উইকেটে ৬৯ রানের জুটি বাঁধেন তিনি। স্নেহের বলে একটি ছক্কাও মারেন তিনি। ভারতের বিরুদ্ধে এক দিনের ক্রিকেটে এটি কোনও পাকিস্তানি ক্রিকেটারের মারা প্রথম ছক্কা। নাতালিয়া ৩৩ রানে আউট হলেও সিদরা ক্রিজ়ে ছিলেন। অর্ধশতরান করেন তিনি। জরুরি রানরেট ক্রমশ বাড়লেও যত ক্ষণ সিদরা ছিলেন তত ক্ষণ নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না ভারত।
৩৫ ওভারের মধ্যে ভারতের দুই পেসারের ২০ ওভার শেষ করে দেন হরমনপ্রীত। ক্রান্তি ১০ ওভারে মাত্র ২০ রান দিয়ে ৩ উইকেট নেন। রেণুকা দেন ২৯ রান। ক্যাচ না ফস্কালে তিনিও উইকেট পেতে পারতেন।
অপর প্রান্তে উইকেট পড়ায় চাপ বাড়ছিল পাকিস্তানের উপর। বাধ্য হয়ে বড় শট মারতে হয় সিদরাকে। সেটা করতে গিয়েই ৮১ রান করে স্নেহের বলে আউট হলেন তিনি। মহিলাদের এক দিনের ক্রিকেটে এটি ভারতের বিরুদ্ধে কোনও পাক ব্যাটারেরা করা সর্বাধিক রান। সিদরা আউট হওয়ার পর পাকিস্তানের জয়ের সব আশা শেষ হয়ে যায়।
শেষ পর্যন্ত ৪৩ ওভারে ১৫৯ রানে অল আউট হয়ে যায় পাকিস্তান। ভারতের বোলারদের মধ্যে ক্রান্তি বাদে দীপ্তিও ৩ উইকেট নেন। ২ উইকেট নেন স্নেহ।