হরমনপ্রীত কৌর। ছবি: পিটিআই।
জলে গেল বাংলার রিচা ঘোষের ৯৪ রান। দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হারল ভারত। অথচ একটা সময় দেখে মনে হচ্ছিল, হাসতে হাসতে জিতবে ভারত। ২৫২ রান তাড়া করতে নেমে মাত্র ৮১ রানে ৫ উইকেট পড়ে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার। কিন্তু সেখান থেকেও জিততে পারল না তারা। অধিনায়ক লরা উলভার্ট এবং নীচের সারির দুই ব্যাটার ক্লোয়ি ট্রিয়ন ও নাদিন ডি’ক্লার্কের ব্যাটে ভারতকে ৩ উইকেটে হারাল দক্ষিণ আফ্রিকা। জঘন্য বল করল ভারত। ক্রান্তি গৌড়, দীপ্তি শর্মাদের নিয়ে শেষ দিকে ছেলেখেলা করলেন ক্লোয়ি ও ডি’ক্লার্ক। বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ হারল ভারত।
এই হার ভারতের সামনে তুলে দিল অনেক প্রশ্ন। বার বার নীচের সারির ব্যাটারেরা দলকে জেতাবেন না। বার বার বোলারদের হাতেও ম্যাচ জেতা যাবে না। যত দিন না দলের দুই মহাতারকা স্মৃতি মন্ধানা ও হরমনপ্রীত কৌর দায়িত্ব নিয়ে রান করছেন, তত দিন এই ধাক্কা খাওয়ার ভয় ভারতের থাকবেই। বিশাখাপত্তনমের মাঠে হরমনপ্রীতদের বাস্তবের মাটিতে ফেলল দক্ষিণ আফ্রিকা। রবিবার অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে খেলবে ভারত। সেই ম্যাচের আগে ভুল শোধরাতে না পারলে সমস্যা আরও বাড়বে হরমনপ্রীতদের।
ভারতের হয়ে রিচা যে ইনিংস খেলেছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে সেটাই খেললেন ডি’ক্লার্ক। রিচার মতো তিনিও আট নম্বরে নেমেছিলেন। সেখান থেকে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়লেন। ৫৪ বলে ৮৮ রানের ইনিংস খেললেন তিনি। মারলেন আটটি চার ও পাঁচটি ছক্কা। উলভার্ট ও ক্লোয়ি ফিরে গেলেও একাই দলকে জেতালেন ডি’ক্লার্ক। তাঁকে থামাতে পারেননি ভারতের কোনও বোলার। একের পর এক বড় শট খেললেন তিনি। শেষে দুই ছক্কায় খেলা শেষ করলেন ডি’ক্লার্ক।
এক দিনের ক্রিকেটে ২৫২ খুব বড় রান নয়। বিশেষ করে আগের ম্যাচে নিউ জ়িল্যান্ডকে যে ভাবে সহজেই হারিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা, তাতে আত্মবিশ্বাস ছিল ব্যাটারদের। সেই ম্যাচের নায়ক ছিলেন ওপেনার তাজ়মিন ব্রিটস। সেই ব্রিটসকেই শূন্য রানে ফেরালেন ক্রান্তি গৌড়। নতুন বলে ভারতের বোলারেরা ভাল বল করলেন। কিন্তু বল পুরনো হতেই সব উধাও।
ভারতের মতো দক্ষিণ আফ্রিকারও টপ ও মিডল অর্ডার ব্যর্থ। ব্যতিক্রম অধিনায়ক উলভার্ট। একাই খেলছিলেন তিনি। সুনে লুস (৫), মারিজান কাপ (২০), আনেকে বশ (১), সিনালো জ়াফটা (১৪) রান পাননি। ৮১ রানে ৫ উইকেট পড়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকার। ভারতের তিন স্পিনারের সামনে সমস্যায় পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা। উলভার্ট প্রথম বড় জুটি বাঁধেন ক্লোয়ির সঙ্গে। বল হাতে ৩ উইকেট নেওয়ার পর ব্যাট হাতেও নজর কাড়লেন ক্লোয়ি। ধীরে ধীরে রান তুললেও উইকেট ছুড়ে আসেননি তাঁরা। উলভার্টকে ভাল দেখাচ্ছিল। দু’জনের মধ্যে ৬১ রানের জুটি হয়। সেই জুটি ভাঙেন ক্রান্তিই। দ্বিতীয় স্পেলে এসে ৭০ রানের মাথায় উলভার্টকে ফেরান তিনি।
তার পরেও হাল ছাড়েনি দক্ষিণ আফ্রিকা। এ বার জুটি বাঁধেন ক্লোয়ি ও ডি’ক্লার্ক। বল পুরনো হয়ে যাওয়ায় বিশেষ কিছু হচ্ছিল না। ফলে শট খেলতে সমস্যা হচ্ছিল না। জরুরি রান রেট বেড়ে চললেও যত ক্ষণ এই জুটি খেলছিল, নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না ভারত। পায়ে স্ট্র্যাপ বেঁধে খেলছিলেন ক্লোয়ি। একটি রান নিতে গিয়ে পড়ে যান তিনি। তার পর দেখা যায় পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা হচ্ছে। সেই অবস্থাতেও খেলা চালিয়ে যান তিনি। ৪৯ রানের মাথায় ফেরেন ক্লোয়ি। তখনও জিততে চার ওভারে ৪১ রান দরকার ছিল। ক্রান্তিকে নিশানা করলেন ডি’ক্লার্ক। সেই শুরু। আর থামলেন না তিনি। সাত বল বাকি থাকতে ম্যাচ জিতিয়ে মাঠ ছাড়লেন ডি’ক্লার্ক।
প্রশ্ন উঠল হরমনপ্রীতের বোলিং পরিবর্তন নিয়েও। আমনজ্যোৎ, ক্রান্তিরা নতুন বলে যতটা ভাল, পুরনো বলে নন। শুরুতে তাঁরা ভাল বল করছিলেন। তাঁদের দিয়ে আরও কয়েক ওভার করিয়ে দিতে পারতেন তিনি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যেমন শুরুতে টানা ১৫ ওভার বল করেছিলেন ক্রান্তি ও রেণুকা সিংহ ঠাকুর। সেই স্পেলেই হেরেছিল পাকিস্তান। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে কয়েকটি ভুল করলেন হরমনপ্রীত। তার খেসারত দিতে হল ভারতকে।
ব্যাট হাতে ভারতের মহাতারকারা আরও একটি ম্যাচে ব্যর্থ। মন্ধানা করলেন ২৩ রান। যে ৩২ বল তিনি খেললেন তাতে ক’টা বল ব্যাটের মাঝে খেলেছেন তা দেখার বিষয়। হরমনপ্রীতের হাল আরও খারাপ। ৯ রানে আউট হলেন তিনি। যে জেমাইমাকে ভবিষ্যতের তারকা ধরা হয় তিনিও শূন্য রানে আউট হলেন।
এ বারের বিশ্বকাপে আরও একটি ম্যাচে আট নম্বরে নামলেন রিচা। বলা ভাল, নামানো হল তাঁকে। রিচার নাকি ফর্ম ভাল নেই। তাই উপরে নামানো হচ্ছে না তাঁকে। সেই কারণে কি এই ম্যাচকে বদলার মঞ্চ বানিয়ে ফেললেন বাংলার কন্যা? আগের ম্যাচে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শেষবেলায় ঝড় তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু এই ম্যাচে পরিস্থিতি ছিল অন্য রকম। রিচা যখন ব্যাট করতে নামেন তখন ভারতের স্কোর ৬ উইকেটে ১০২ রান। তখনও বাকি ২৪ ওভার। অর্থাৎ, প্রায় অর্ধেক ম্যাচ।
প্রথমে আমনজ্যোৎ কৌর ও তার পর স্নেহ রানার সঙ্গে জুটি বাঁধলেন রিচা। আমনজ্যোতের ব্যাটে-বলে ঠিক মতো হচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে রানের পুরো দায়িত্ব রিচাকে নিতে হচ্ছিল। দৌড়ে রানের দিকেই বেশি নজর দিচ্ছিলেন তিনি। মাঝেমধ্যে বাজে বল পেলে বড় শট খেলছিলেন। ৫৩ বলে অর্ধশতরান করেন তিনি।
অর্ধশতরানের পর গিয়ার বদলালেন রিচা। প্রথম থেকে একেবারে পঞ্চম গিয়ার। পরের ২৪ বলে এল ৪৪ রান। শেষ ১০ ওভারে ভারত করল ৯৮ রান। তার বেশির ভাগটাই রিচার ব্যাটে। যে বোলিং আক্রমণের সামনে মন্ধানা, হরমনপ্রীত, জেমাইমারা খাবি খাচ্ছিলেন, সেই আক্রমণকে নিয়ে ছেলেখেলা করলেন রিচা। এক বার হাত খোলার পর আর থামেননি তিনি। তবে তার মধ্যে সুযোগও দেন রিচা। দু’বার তাঁর ক্যাচ পড়ে। এক বার রান আউটের সুযোগ হাতছাড়া হয়। কিন্তু তার পরেও রিচার ১১ চার ও চার ছক্কার এই ইনিংস বহু দিন মনে থেকে যাবে। কারণ, খাদের কিনারা থেকে দলকে টেনে তুলেছেন তিনি। রিচাকে সঙ্গ দিলেন স্নেহ। ন’নম্বরে নেমে ২৪ বলে ৩৩ রান করলেন তিনি।
শেষ ওভারে শতরানের সুযোগও ছিল রিচার কাছে। ৯৪ রানের মাথায় কোমরের উচ্চতার ফুলটসে ছক্কা মারতে গিয়ে আউট হলেন রিচা। তিনি নো-বলের আবেদন করেন। রিপ্লে-তে দেখা যায় ৪ সেন্টিমিটারের জন্য নো-বল হয়নি। ৭৭ বলে ৯৪ করলেন রিচা। তিনি আউট হওয়ার পরের বলেই শেষ হয়ে যায় ভারতের ইনিংস।