লর্ডসে বোল্ড হওয়ার পর সিরাজ। ওভালে বোল্ড করার পর সিরাজ। ছবি: রয়টার্স, পিটিআই
বার্মিংহ্যাম টেস্ট শুরুর দিন মাঠে নামার আগে শুভমন গিল ‘পেপ টক’ দেওয়ার সময় বলেছিলেন, মহম্মদ আর কৃষ্ণই আমাদের জেতাবে। জসপ্রীত বুমরাহের অনুপস্থিতিতে দুই জোরে বোলারের উপর অধিনায়কের ভরসা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। শুভমনের সেই মহম্মদ-কৃষ্ণ জুটিই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভারতের সিরিজ় হার বাঁচিয়ে দিল।
টেস্ট সিরিজ় যত এগিয়েছে, ‘আনফিট’ বুমরাহকে নিয়ে ভারতীয় শিবিরে অসন্তোষ তত বেড়েছে। অস্বস্তির শূন্যতা ঢেকে দিয়েছেন সিরাজ। গোটা সিরিজ়ে ইংরেজদের জ্বালিয়েছেন সিরাজ। কখনও বিষাক্ত আউট সুইং, নিখুঁত ইয়র্কারে। কখনও আগুনে চোখে, রুদ্র মেজাজে। জো রুট, বেন স্টোকসদের বল হাতে চাপে রেখেছেন। আবার বাজ়বল খেলার অনুরোধও করেছেন! গোটা সিরিজ়ে ক্রিকেটটা উপভোগ করেছেন সিরাজ। চুটিয়ে উপভোগ করেছেন। শুধু তা-ই নয়, লাল বলের লড়াইকে সমর্থকদের জন্যও উপভোগ করে তুলেছেন।
গোটা সিরিজ়ে ধারাবাহিক ভাবে ভাল বল করেছেন সিরাজ। নতুন বলে উইকেট নিয়েছেন। পুরনো বলে উইকেট নিয়েছেন। ২৩টা উইকেট নিয়েছেন। আবার ব্যাট হাতেও লড়াই করেছেন। সিরাজ কত রান করেছেন গোটা সিরিজ়ে? আটটা ইনিংসে ব্যাটার সিরাজের অবদান যথাক্রমে অপরাজিত ৩, শূন্য, ৮, অপরাজিত শূন্য, ৪, অপরাজিত ৫, শূন্য এবং শূন্য। কী এমন করেছেন ব্যাট হাতে? আধুনিক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম সারির সব দলের টেলএন্ডারেরা খানিকটা ব্যাট করতে পারেন। কিছু রান করতে পারেন। সেই নিরিখে ব্যাটার সিরাজের পারফরম্যান্স নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু নেই। না, আছে। লর্ডসের ৩০ বলের ইনিংসটা ভুলে গেলে চলবে না। ভারত ১৯৩ রান তাড়া করতে গিয়ে ২২ রানে হেরেছিল। সেই ম্যাচে বেন স্টোকসদের চাপে ফেলে দিয়েছিল সিরাজের ব্যাট। ১১ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ৩০টা বল খেলেছিলেন ব্যাটের মাঝখান দিয়ে। সুযোগ দেননি ইংল্যান্ডের বোলারদের। রবীন্দ্র জাডেজার সঙ্গে জুটিতে দশম উইকেটে যোগ করেছিলেন ২৩ রান। শোয়েব বসিরের যে বলে আউট হয়েছিলেন, সেটাই ব্যাটের মাঝখান দিয়ে খেলেছিলেন। বল পিচের ক্ষতে পড়ে উইকেটের দিকে চলে যায়। বলের আঘাতে উইকেটের বেল পড়ে যাওয়ায় আউট হয়ে যান সিরাজ। ম্যাচ হেরে যায় ভারত। ব্যর্থ হয় শেষ ২ উইকেটে ভারতের ৩৫.২ ওভারের প্রতিরোধ।
সিরাজ হয়তো পারতেন বলটা আটকাতে। উইকেটের দিকে এগিয়ে যাওয়া বলটা ব্যাট বা পা দিয়ে সরিয়ে দিতে পারতেন। পারেননি। আউট হয়ে পিচের উপর বসে কেঁদে ফেলেছিলেন। ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারেরা এগিয়ে এসে তাঁকে সামলেছিলেন। তাঁর লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়েছিলেন। সেই ম্যাচের পর দু’রাত ঘুমোতে পারেননি। নিজেকে ক্ষমা করতে পারেননি।
ভারত সিরিজ় হারলেও সিরাজ় নিশ্চিত ভাবে নিজেকে ক্ষমা করতে পারতেন না। দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে হয়তো সাময়িক অপ্রিয় হয়ে উঠতেন। কারণ ওভাল টেস্টের চতুর্থ দিন হ্যারি ব্রুকের দেওয়া সহজ ক্যাচ তিনি ধরলেও আউট করতে পারেননি। ক্যাচ ধরার পরই সিরাজের পা বাউন্ডারি লাইনের দড়িতে ছুঁয়ে গিয়েছিল। ছক্কা হয়ে যায়। হতাশায় মুখ ঢেকে ফেলেন সিরাজ। তাঁর একটা ভুল ম্যাচের রং বদলে দিয়েছিল। সোমবার ওভাল টেস্ট জয়ের পর সিরাজ নিজেও তা মেনে নিয়েছেন। লন্ডনের দুই মাঠে সিরাজের দু’টি ভুলের চড়া মূল্য দিতে হতে পারত ভারতীয় দলকে। হয়নি। কারণ সিরাজ কখনও হারার কথা ভাবেননি। ইংল্যান্ড ওভালের চতুর্থ ইনিংসে ৩ উইকেটে ৩০০ রান করে ফেলার পরও হাল ছাড়েননি। তাঁর বল গাস অ্যাটকিনসনের উইকেট ছিটকে দিতেই চিৎকার করে উঠেছেন গোটা দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা। কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সব কিছু। জয় যেন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। কারণ সোমবার খেলা শুরুর সময় জয়ের জন্য ইংল্যান্ডের দরকার ছিল ৩৫ রান। ভারতের ৪ উইকেট। প্রায় হারা ম্যাচে রুদ্ধশ্বাস জয়। ৪টে উইকেটের ৩টেই সিরাজের। লর্ডসে বোল্ড হয়ে দলকে সিরিজ়ে পিছিয়ে দেওয়া ক্রিকেটারের হাত ধরেই সিরিজ় ড্র! বিশ্বাস হতে কয়েকটা মুহূর্ত লাগেই।
কয়েকটা মুহূর্তের পর সিরাজই নায়ক। ওভালে জয়ের নায়ক। সিরিজ় ড্রয়ের নায়ক। কেউ বিশ্বাস করুন বা না করুন, বিশ্বাস করেছিলেন শুভমন। সিরাজ নিজেও। লর্ডসের বোল্ড থেকে ওভালের বোল্ড— এই যাত্রা পথে উবে গিয়েছে অবিশ্বাসের বুদবুদ। নির্মাণ করেছে ভরসা, বিশ্বাসের নতুন আধার। মহম্মদ সিরাজ।
বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু, তর্কে বহুদূর।