Pratika Rawal in Indian Women Cricket

মহিলা ক্রিকেটের শুভমন-যশস্বীকে পেয়ে গিয়েছে ভারত, দ্বাদশে ৯২ শতাংশ নম্বর পাওয়া মেয়ে দেখাচ্ছেন বিশ্বজয়ের স্বপ্ন

জাতীয় দলে তাঁর কেরিয়ার মাত্র ছ’মাসের। তার মধ্যেই বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন প্রতীকা রাওয়াল। দেশের মাটিতে মহিলাদের এক দিনের বিশ্বকাপের আগে ভরসা জোগাচ্ছেন হরিয়ানার ২৪ বছরের মেয়ে।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০২৫ ১০:১০
Share:

প্রতীকা রাওয়াল। ভারতীয় ক্রিকেটকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন হরিয়ানার এই মেয়ে। ছবি: সমাজমাধ্যম।

দেশের মাটিতে মহিলাদের এক দিনের বিশ্বকাপের বাকি আর মাত্র চার মাস। বিশ্বসেরা হওয়ার লড়াইয়ে নামবে আটটি দেশ। আরও এক বার হরমনপ্রীত কউর, স্মৃতি মন্ধানার উপর ভরসা করছে গোটা দেশ। তাঁদের কাঁধেই ভারতকে প্রথম বারের জন্য বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করার গুরুদায়িত্ব। হরমনপ্রীত ও মন্ধানা ভারতের মহিলাদের দলের রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলি। কিন্তু শুধু রোহিত বা বিরাট কি বিশ্বকাপ জেতাতে পারেন? তার জন্য তো শুভমন গিল, যশস্বী জয়সওয়ালদেরও দরকার। মহিলাদের দলে সেই দায়িত্ব কে নেবেন? উঠে এসেছেন হরিয়ানার এক মেয়ে। মাত্র ২৪ বছর বয়স। জাতীয় দলে তাঁর কেরিয়ার মাত্র ছ’মাসের। তার মধ্যেই বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন প্রতীকা। তিনিই ভরসা জোগাচ্ছেন বাকিদের।

Advertisement

বিশ্বকাপের কথা মাথায় রেখেই হয়তো ভারতের মহিলা দলে গত ছ’মাসে ১০ ক্রিকেটারের অভিষেক হয়েছে। প্রতীকা ছাড়াও সেই তালিকায় রয়েছেন বাংলার তিতাস সাধু। বাকিরা হলেন— মিন্নু মণি, তেজল হাসবনিস, সাইমা ঠাকোর, প্রিয়া মিশ্র, কাশভি গৌতম, তনুজা কানওয়ার, সায়ালি সাতঘারে ও শ্রী চরণি। নির্বাচকেরা চেয়েছিলেন হাতে বিকল্প রাখতে। সেই কাজে তাঁরা অনেকটাই সফল। এই ১০ নতুন ক্রিকেটার ছাড়াও স্নেহ রানার মতো অভিজ্ঞের প্রত্যাবর্তন হয়েছে। অর্থাৎ, বিশ্বকাপের ১৫ জনের দল তৈরি করতে বেজায় সমস্যায় পড়তে হবে নির্বাচকদের। কাকে রাখবেন, আর কাকে ছাড়বেন, তা বাছা মোটেও সহজ নয়।

তবে এই ১০ জনের মধ্যে এক জনের জায়গা নিশ্চিত দলে। তিনি ওপেনার প্রতীকা। মন্ধানার সঙ্গে বিশ্বকাপে ভারতকে ভাল শুরু করানোর দায়িত্ব তাঁর উপরেই থাকবে। গত বছর অক্টোবর মাস পর্যন্ত ভারতীয় ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটেই দুই ওপেনারের নাম ছিল স্মৃতি মন্ধানা ও শেফালি বর্মা। ভারতীয় ক্রিকেটে যখন শেফালির অভিষেক হয়েছিল, মনে হয়েছিল মহিলাদের বীরেন্দ্র সহবাগকে পাওয়া গিয়েছে। যিনি তিনটি ফরম্যাটেই একই ভাবে খেলেন। প্রথম বল থেকে চালিয়ে খেলেন। দ্রুত খেলার রং বদলে দেওয়ার কাজে সিদ্ধহস্ত ছিলেন শেফালি। গত বছরই টেস্টে মহিলা ব্যাটারদের মধ্যে দ্রুততম দ্বিশতরান করেছিলেন তিনি। মাত্র ১৯৪ বলে। সহবাগের মতোই ১০০-র বেশি স্ট্রাইক রেটে দ্বিশতরান মুখের কথা নয়। কিন্তু একটা সিরিজ় পুরো ছবিটা বদলে দিল।

Advertisement

শেফালির মারকুটে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি তাঁর একটি খামতিও ছিল। তা হল ধারাবাহিকতার অভাব। গত অক্টোবরে নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে খারাপ খেলে বাদ পড়েন তিনি। সুযোগ পান প্রতীকা। আর প্রথম সিরিজ়েই নজর কাড়েন তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের বিরুদ্ধে অভিষেক ম্যাচে তিনি করেন ৪০ রান। সেই সিরিজ়ে তিনটি ম্যাচেই রান করেন প্রতীকা। পরের সিরিজ়ে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে একটি ম্যাচে করেন ১৫৪ রান। মাত্র আটটি ম্যাচেই ৫৭২ রান করেছেন প্রতীকা। গড় ৮১.৭১। আটটি ম্যাচে একটি শতরান ও পাঁচটি অর্ধশতরান করেছেন। মহিলাদের ক্রিকেটে দ্রুততম ৫০০ রানের রেকর্ড গড়েছেন তিনি। ভেঙেছেন ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়র শার্লট এডওয়ার্ডসের রেকর্ড। পুরুষ-মহিলা ক্রিকেটারদের মধ্যে দ্বিতীয় দ্রুততম ৫০০ রানের মালিক তিনি। এই নিরিখে বিরাট, রোহিতদেরও টেক্কা দিয়েছেন প্রতীকা। তিনি ভারতের তৃতীয় মহিলা ক্রিকেটার, যিনি এক দিনের ক্রিকেটে এক ইনিংসে ১৫০ রানের বেশি করেছেন।

কেরিয়ারে প্রথম শতরানের পর প্রতীকা। ছবি: সমাজমাধ্যম।

হরিয়ানার প্রেম নগরের বাসিন্দা প্রতীকার পরিবারে ক্রিকেটের প্রভাব আগে থেকেই রয়েছে। তাঁর বাবা প্রদীপ রাওয়াল ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের লেভেল ২ শংসাপত্র পাওয়া আম্পায়ার। দিল্লি ক্রিকেট সংস্থায় যুক্ত তিনি। ১০ বছর বয়স থেকে ক্রিকেট শুরু প্রতীকার। বাবা তাঁকে প্রথমে নিয়ে যান জিমখানা ক্রিকেট অ্যাকাডেমির শ্রবণ কুমারের কাছে। সেখানেই ক্রিকেটের হাতেখড়ি তাঁর। পরে প্রাক্তন ক্রিকেটার দীপ্তি ধিয়ানি ও দিল্লির মহিলা দলের কোচ দিশান্ত যাজ্ঞিকের কাছে কোচিং করেছেন প্রতীকা। ২০২১ সালে দিল্লির হয়েই ঘরোয়া ক্রিকেট শুরু তাঁর। মাত্র তিন বছরে ৪২টি লিস্ট এ ও ২৪টি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন প্রতীকা। লিস্ট এ ম্যাচে ১৮১২ ও টি-টোয়েন্টিতে ৫৭৪ রান করেছেন তিনি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পাঁচটি শতরান ও ১০টি অর্ধশতরান তাঁকে জাতীয় দলে সুযোগ করে দিয়েছে। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন তিনি।

খেলার পাশাপাশি পড়াশোনাতেও বেশ মেধাবী প্রতীকা। ছোট থেকেই স্কুলে ভাল ফল করতেন। সিবিএসই দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় ৯২.৫ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলেন। পরে মনোবিদ্যা নিয়ে স্নাতকও হয়েছেন। অর্থাৎ, ক্রিকেট খেললেও পড়াশোনা অবহেলা করেননি তিনি। স্কুলে পড়তে পড়তে বাস্কেটবলও খেলতেন প্রতীকা। ২০১৯ সালে স্কুল স্তরের জাতীয় প্রতিযোগিতায় বাস্কেটবলে সোনাও জিতেছেন এই সোনার মেয়ে। সেই শিক্ষা ক্রিকেটেও কাজে লাগাচ্ছেন প্রতীকা। তিনি জানেন, সুযোগ বেশি পাবেন না। তাই যা পাবেন তা কাজে লাগাতে হবে। প্রতিটি ম্যাচে তাই নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেন। সেই কারণেই অল্প সময়ে সাফল্য পেয়েছেন।

বলের দিকেই সব সময় নজর থাকে প্রতীকার। ছবি: সমাজমাধ্যম।

জাতীয় দলে খেললেও মহিলাদের আইপিএলে এখনও খেলার সুযোগ পাননি প্রতীকা। তবে তাঁকে ট্রায়ালে ডেকেছিল মুম্বই ইন্ডিয়ান্স। সেই দলের বোলিং কোচ বাংলার ঝুলন গোস্বামী। প্রতীকার খেলা তাঁর ভাল লেগেছে। তবে এখন থেকেই তাঁকে ভবিষ্যতের তারকা বলতে চান না ভারতীয় দলে ২০ বছর খেলা ঝুলন। আরও একটু অপেক্ষা করতে চান তিনি। আনন্দবাজার অনলাইনকে ঝুলন বললেন, “প্রতীকার সঙ্গে কোনও দিন কথা হয়নি। দেখাও হয়নি। তবে খেলা দেখেছি। ভাল লেগেছে। কিন্তু এখনই ওকে ভবিষ্যতের তারকা বলার সময় আসেনি। আরও একটু খেলতে দিতে হবে। ও সব ম্যাচই দেশের মাটিতে খেলেছে। ওর আসল পরীক্ষা তো অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের মাঠে। যে ত্রিদেশীয় সিরিজ়টা চলছে, সেখানে খুব ভাল খেলছে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধান বোলার খেলছে না এই সিরিজ়ে। এটাও মাথায় রাখতে হবে।”

প্রতীকার প্রধান শক্তি তাঁর ধারাবাহিকতা। আটটি আন্তর্জাতিক ইনিংসের মধ্যে ছ’টিতে ৫০-এর বেশি রান তাঁর। একটিতে ১০০-র বেশি। এই পরিসংখ্যান দেখে বোঝা যায় কতটা ধারাবাহিক তিনি। শ্রীলঙ্কায় আয়োজিত ত্রিদেশীয় প্রতিযোগিতাতেও নজর কেড়েছেন প্রতীকা। তিনটি ম্যাচে ১৬৩ রান করেছেন, যা এখনও পর্যন্ত সর্বাধিক। প্রতীকার মাথা খুব ঠান্ডা। ব্যাট করতে নেমে সব বলে চালান না। থিতু হওয়ার সময় নেন। খারাপ বলের অপেক্ষা করেন। প্রতীকার এই ঠান্ডা মাথার বিষয়টি খেয়াল করেছেন ঝুলনও। তার নেপথ্যে প্রতীকার শিক্ষার দিকটিও দেখছেন তিনি। ঝুলন বললেন, “ওর মধ্যে একটা আলাদা ব্যাপার আছে। এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের একটা অংশের মধ্যে যে রকম ছটফটানি, উত্তেজনা দেখি, ও সে রকম নয়। ও অনেক শান্ত। জানে নিজের কাজটা কী। জানে কখন কী করতে হবে। হয়ত উচ্চশিক্ষিত বলেই। শিক্ষার তো একটা অবদান আছে।”

প্রতীকা এক দিকে ভরসা দেওয়ায় অন্য দিকে সুবিধা হয়েছে মন্ধানারও। তাঁদের জুটি রান পাচ্ছে। দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ জিততে হলে প্রতি ম্যাচে শুরুটা ভাল করতে হবে ভারতকে। প্রতীকা-মন্ধানার জুটি সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। শুরুটা ভাল হলে ভারতের মিডল অর্ডারে হরমনপ্রীত বা জেমাইমা রদ্রিগেজ়ের উপর চাপ কমবে বলেই মনে করেন ঝুলন। তাতে ভারতীয় ক্রিকেটেরই ভাল হবে। ভারতের হয়ে দু’বার বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা ঝুলন বললেন, “এ রকম ক্রিকেটার যত আসবে ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য তত ভাল। এর ফলে হরমনপ্রীত, রিচা, জেমাইমা, স্মৃতিদের উপর থেকে চাপ কমবে।”

ভারতের নতুন ওপেনিং জুটি। প্রতীকা রাওয়াল (বাঁ দিকে) ও স্মৃতি মন্ধানা। ছবি: সমাজমাধ্যম।

সবেমাত্র ছ’মাসের কেরিয়ার তাঁর। ভারতের হয়ে খেলেছেন সাকুল্যে আটটি এক দিনের ম্যাচ। তাতেই তাঁকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। ভারতের এক দিনের ক্রিকেটে মন্ধানা দীর্ঘ দিন খেললেও কোনও স্থায়ী ওপেনিং জুটি পায়নি ভারত। কখনও শেফালি, কখনও যস্তিকা ভাটিয়া আবার কখনও জেমাইমাকে নামতে হয়েছে। এত দিনে সেই স্থান ভরাট করার মতো এক ক্রিকেটারকে পাওয়া গিয়েছে। প্রতীকা উইকেট ছুড়ে দিয়ে আসেন না। পড়ে থাকেন। তাঁকে আউট করতে হবে। তিনি হবেন না। সেই কারণে এত অল্প দিনে ভরসা জোগাচ্ছেন তিনি। তাঁর কাঁধে আশা দেখছে ভারতের মহিলা ক্রিকেটও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement