India VS England Test Series

কেন রবিবার শেষ করা গেল না খেলা, উঠছে প্রশ্ন! গম্ভীরের সঙ্গে বিবাদে জড়ানো ওভালের মাঠকর্মী ফর্টিসই ‘খলনায়ক’

সকলে ভেবেছিলেন রবিবারই শেষ হবে ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজ়। কিন্তু বৃষ্টি ও তার পর ওভালের মাঠকর্মীদের গা-ছাড়া মনোভাবে খেলা গড়িয়েছে সোমবার।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০২৫ ১২:১৯
Share:

বৃষ্টির জেরে ওভালে চতুর্থ দিনের খেলা পুরো হয়নি। ছবি: পিটিআই।

মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে দেখতে চান। পরের বছর আইপিএলে ইডেনে চেন্নাই ম্যাচের টিকিট এখন থেকে চেয়ে রেখেছেন এক ভদ্রলোক। কিন্তু তিনি জানেন না, ভারতের পরের টেস্ট ম্যাচ কবে, কাদের বিরুদ্ধে। উত্তেজনা হারাতে বসা টেস্ট ক্রিকেটের নবজন্ম হয়েছে শুভমন গিল-বেন স্টোকসদের হাত ধরে। আড়াই-তিন দিনে শেষ হয়ে যাওয়া টেস্ট ম্যাচ নিয়ে কারও আর তেমন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজ়ে প্রতিটা টেস্ট পাঁচ দিনে গড়িয়েছে। নাটকীয় টেস্ট সিরিজ়ে উত্তেজনা ফিরেছে।

Advertisement

এই উত্তেজনারই প্রতিফলন দেখা গেল রবিবার আনন্দবাজার ডট কম-এর দফতরের বাইরে। ছুটির দিনে ফাঁকা অফিসপাড়ার রাস্তা দিয়ে দুই বন্ধু নিশ্চিন্তে হেঁটে যাচ্ছিলেন। চোখ মোবাইলে ওভাল টেস্টের দিকে। তখন সবে রবিবারের খেলা ‘শেষ’ ঘোষিত হয়েছে। এক জন আর এক জনকে বললেন, “ধুর, খেলাটা আজ শেষ হল না! সোমবার খেলা দেখব কী করে? সপ্তাহের প্রথম কাজের দিন। দুপুর ২টো থেকে তো পর পর মিটিং আছে। খেলাটাই আর দেখা হবে না।”

এই দুই ব্যক্তির মতো বাকিরাও চেয়েছিলেন রবিবারই শেষ হয়ে যাক ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজ়। কিন্তু বৃষ্টি তাতে জল ঢেলে দিল। বাকি কাজটা করলেন ওভালের মাঠকর্মীদের প্রধান লি ফর্টিস। তিনিই সেই ব্যক্তি, যিনি ভারতের অনুশীলনের সময় গৌতম গম্ভীরের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়েছিলেন। গম্ভীরকে পিচের কাছে যেতে দিচ্ছিলেন না। তা নিয়ে বিবাদ হয়। কোনও রকমে পরিস্থিতি শান্ত করেন ভারতের সহকারী কোচেরা। ওভালে ‘খলনায়ক’ হয়ে উঠলেন সেই ফর্টিস। প্রশ্ন উঠে গেল, ৬.৪২ মিনিটের মধ্যেই খেলা শুরু করতে হবে, এই কঠোর নিয়ম নিয়েও।

Advertisement

ওভালে লি ফর্টিসের (ধুসর জামা পরে) সঙ্গে আঙুল উঁচিয়ে বিবাদ গৌতম গম্ভীরের। ছবি: সমাজমাধ্যম।

সিরিজ়ের শেষ হাসি কে হাসেন তা দেখার অপেক্ষায় ওভালের গ্যালারিতে বসেছিলেন ২৭ হাজার দর্শক। টেলিভিশন, ওটিটি-র পর্দায় চোখ ছিল কোটি কোটি দর্শকের। কিন্তু দিনের শেষে হতাশ তাঁরা। চলতি সিরিজ়ে এর আগের চারটে টেস্টেই পাঁচ দিন করে খেলা হয়েছে। মনে হচ্ছিল, ওভালেই একমাত্র চার দিনে খেলা শেষ হবে। গত কয়েক বছরে যত খেলা হয়েছে, লড়াই, উত্তেজনা ও ক্রিকেটীয় মানের নিরিখে ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজ় উপরের সারিতে থাকবে। তার শেষটাও তেমনই হচ্ছিল। ইংল্যান্ডের টেস্ট ও সিরিজ় জিততে দরকার ছিল ৩৫ রান। ভারতের টেস্ট জিতে সিরিজ় ড্র করতে দরকার ছিল ৪ উইকেট। ঠিক তখনই ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। স্থানীয় সময়ে ঘড়িতে তখন বিকেল ৫.২৯ মিনিট। তার পর আর খেলা শুরু করাই গেল না।

তার আগের কয়েক ঘণ্টা লড়াই দেখেছে ক্রিকেটবিশ্ব। চতুর্থ দিনের খেলা শুরুর আগে কিছুটা এগিয়ে ছিল ভারত। ওভালের সবুজ উইকেটে চতুর্থ ইনিংসে ৩৭৪ রান তাড়া করা সহজ ছিল না। কিন্তু হ্যারি ব্রুক ও জো রুট বুঝিয়ে দিলেন তাঁরা অন্য ধাতুতে গড়া। মাত্র ২১১ বলে ১৯৫ রানের জুটি গড়লেন। ভারতের তিন পেসারকে সামলে দু’জনেই শতরান করলেন। সেখান থেকে আবার ভারতের প্রত্যাবর্তন। চা বিরতির পর নতুন উদ্যমে বল করা শুরু করলেন মহম্মদ সিরাজ, প্রসিদ্ধ কৃষ্ণেরা। ফলে আবার চাপে পড়ল ইংল্যান্ড। যারা প্রথম দুই সেশনে ওভার প্রতি প্রায় ৫ রান করে তুলেছে তারাই একটা করে রান করতে হিমশিম খাচ্ছিল।

ওভালকে তখন দেখে মনে হচ্ছিল ওয়াংখেড়ে। গোটা স্টেডিয়ামে ভারতের নামে জয়ধ্বনি উঠছে। সিরাজ আরও তাতিয়ে দিচ্ছেন সমর্থকদের। উইকেট চাইছেন সমর্থকেরা। প্রতিটা বলে দেখা যাচ্ছে বিষাক্ত সুইং। সিরিজ়ে ৪০০-এর উপর রান করা জেমি স্মিথও ব্যাটে বল লাগাতে পারছেন না। সমর্থকেরা জানেন, আর তিনটে উইকেট নিলেই প্রায় হয়ে যাবে। কারণ, ক্রিস ওকস নামলেও এক হাতে স্লিং বেঁধে নামবেন। ওই অবস্থায় ব্যাট করতে নামতে সাহস লাগলেও বাস্তবে বেশি ক্ষণ টেকা মুশকিল। তাই বৃষ্টি নামলেও আশায় ছিলেন সমর্থকেরা। ইংল্যান্ডে বেশির ভাগ সময়েই ‘পাসিং শাওয়ার’ হয়। অর্থাৎ, কয়েক মিনিটের বৃষ্টি। তাতে বেশি সময় নষ্ট হয় না।

কিন্তু এ বার হল। বৃষ্টি থেমে আকাশ যখন পরিষ্কার হতে শুরু করল তখন স্থানীয় সময় ৬.০৩ মিনিট। অর্থাৎ, নির্ধারিত ৬.৪২ মিনিটের মধ্যে খেলা শুরু হওয়ার জন্য তখনও ৩৯ মিনিট হাতে ছিল। মাঠকর্মীদের প্রধান ফর্টিস এসে আম্পায়ারদের জানিয়ে দিলেন, ৩৯ মিনিটের মধ্যে মাঠ খেলার জন্য তৈরি করতে পারবেন না তাঁরা। ব্যস, বন্ধ হয়ে গেল খেলা।

জায়ান্ট স্ক্রিনে লেখা, বৃষ্টির জেরে চতুর্থ দিনের খেলা স্থগিত। ছবি: পিটিআই।

কিন্তু সত্যিই কি মাঠ তৈরি করা যেত না? ইংল্যান্ডের প্রায় সব মাঠেরই নিকাশি ব্যবস্থা খুব উন্নত। তাই বৃষ্টি হলেও পুরো মাঠ তারা ঢাকে না। শুধু পিচ ও তার আশপাশের এলাকা ঢাকা হয়। রবিবার এক বারই জোরে বৃষ্টি হয়েছে। তাতেই আর মাঠ তৈরি করা গেল না? না কি ইংল্যান্ডের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিলেন ফর্টিস। ওই অবস্থায় খেলা ভারতের দিকে ঝুঁকেছিল। ভারতীয় পেসারেরা ছন্দে ছিলেন। ইংল্যান্ড চাপে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু নতুন দিন নতুন ছবি হতে পারে। খেলা শুরুর আগে ভারী রোলার নেবে ইংল্যান্ড। তাতে ৪০-৪৫ মিনিট পিচ শক্ত থাকে। ব্যাট করা সহজ হয়। তার মাঝেই খেলা জিতে নিতে পারে তারা। সেই কারণেই কি গড়িমসি করলেন ফর্টিস?

তিনি অবশ্য পাশে পেলেন ক্রিকেটের নিয়মকে। ঠিক হয়েছে ওভাল টেস্টে দিনের খেলা শেষের সময় সন্ধ্যা ৬.৪২ মিনিট। তবে যদি কোনও কারণে ওভার নষ্ট হয় তা হলে ৬.৪২ মিনিটের পর আরও এক ঘণ্টা খেলা চলতে পারে। সে ক্ষেত্রে দেখতে হবে আলো পর্যাপ্ত রয়েছে কি না। ওভালেই প্রথম দিন বৃষ্টিতে অনেক ওভার নষ্ট হওয়ায় দ্বিতীয় দিন স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিট পর্যন্ত খেলা চলেছে। তা হলে চতুর্থ দিন কেন সেটা হল না? নেপথ্যে সেই ক্রিকেটেরই নিয়ম। যদি বৃষ্টির কারণে খেলা বন্ধ থাকে তা হলে সর্বশেষ ৬.৪২ মিনিটের মধ্যে খেলা শুরু করতে হবে। না হলে আর সে দিনের খেলা হবে না। তারই ফায়দা তুললেন ফর্টিস।

ঠিক এটাই বলেছেন ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়ক অ্যালিস্টার কুক। সম্প্রচারকারী চ্যানেলে তিনি বলেন, “এতে ইংল্যান্ডের খুব সুবিধা হল। ভারত চাপ বাড়াচ্ছিল। তারাই উপরে ছিল। ইংল্যান্ড শুধু লেগ-বাইয়ে রান করছিল। খেলা পঞ্চম দিনে গড়ানোয় ইংল্যান্ড বিশ্রাম পেল।”

প্রশ্ন উঠছে আম্পায়ারদের নিয়েও। তাঁরা কেন অপেক্ষা করলেন না? স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬.১০ মিনিটে খেলা বন্ধের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন তাঁরা। ইংল্যান্ড সানন্দে তা লুফে নিল। ভারতীয় দল থেকেও বিশেষ আপত্তি হয়নি। পেসারেরা সারা দিন বল করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু স্থানীয় সময় ৬.৪৫ নাগাদ ওভালে ঝকঝকে রোদ। লন্ডনে সন্ধ্যা ৮.৩০ মিনিট পর্যন্ত সূর্যের আলো থাকে। পাশাপাশি দরকার পড়লে বাতিস্তম্ভের আলোও ছিল। কিন্তু সে সবের কথা কেউ ভাবল না। তবে কি টেস্ট ক্রিকেটে খেলা শেষের নিয়মে বদল করা উচিত? একটা নির্দিষ্ট সময় না রেখে যেখানে খেলা হচ্ছে সেখানকার পরিবেশ ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। দরকার পড়লে খেলার সময় বাড়ানোর অধিকার থাকা উচিত ম্যাচ রেফারি ও আম্পায়ারদের হাতে। তা হলে হয়তো এ রকম একটা উত্তেজক দিন এ ভাবে শেষ হত না।

তবে তেমনটা মনে করছেন না বাংলার রঞ্জিজয়ী অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। আনন্দবাজার ডট কম-কে তিনি বললেন, “এত দূর থেকে তো ওখানকার পরিস্থিতি বোঝা সম্ভব নয়। তবে মাঠকর্মীদের নিশ্চয় মনে হয়েছে তাঁরা মাঠ খেলার উপযোগী করে তুলতে পারবেন না। সেই কথাটাই তাঁরা আম্পায়ারকে জানিয়েছেন। তার পর আম্পায়ার খেলা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর মধ্যে বিতর্কের কিছু নেই।” একই মত ইডেনের পিচ প্রস্তুতকারক সুজন মুখোপাধ্যায়ের। দীর্ঘ বছর তিনি মাঠের সঙ্গে যুক্ত। সুজন বললেন, “আম্পায়ার মাঠকর্মীদের জিজ্ঞাসা করেন যে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মাঠ খেলার উপযোগী করে তোলা যাবে কি না। মাঠকর্মীদের মনে হয়েছে, তাঁদের মাঠ তৈরি করতে যা সময় লাগবে তাতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে খেলা শুরু করা যাবে না। তাই খেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।”

বৃষ্টি শুরু হওয়ায় ওভালে মাঠ ঢাকার কাজ চলছে। ছবি: পিটিআই।

তবে চতুর্থ দিনের খেলা এ ভাবে শেষ হওয়ায় হতাশ ইংল্যান্ডের প্রাক্তন ক্রিকেটার স্টুয়ার্ট ব্রড। সমাজমাধ্যমে তিনি লেখেন, “খেলা শুরুর শেষ সময় এখনও ২০ মিনিট বাকি। দর্শকেরা রোদচশমা পরে ঘুরছেন। রবিবারই খেলা শেষ হওয়া উচিত ছিল। দর্শকদের বঞ্চনা করা হল। ৬টা বাজতেই খেলা বন্ধ করে দেওয়া হল। আমার মতে তাড়াহুড়ো করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কারা এ সব সিদ্ধান্ত নেয়?”

গত কয়েক বছরে টেস্ট ক্রিকেটের উত্তেজনা যে ভাবে কমেছে তাতে এই রকমেরই সিরিজ় প্রয়োজন ছিল। প্রথম টেস্ট থেকে নাটক। এজবাস্টন ও ম্যাঞ্চেস্টার বাদে বাকি তিনটে টেস্টের শেষ টান টান হয়েছে। জেতার সুযোগ ছিল দু’দলেরই। ম্যাঞ্চেস্টারে প্রায় দু’দিন ব্যাট করে ম্যাচ বাঁচিয়েছে ভারত। সিরিজ়ে দুই দলের ন’জন ব্যাটার ৪০০ রানের বেশি করেছেন। কোনও সেশনে ভারত এগিয়ে থেকেছে তো ঠিক তার পরের সেশনেই ইংল্যান্ড খেলায় ফিরেছে। এ রকম একটা সিরিজ়ের শেষটা টান টান হল না। হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরলেন দর্শকেরা।

সোমবার হয়তো খেলা শুরুর এক ঘণ্টার মধ্যেই টেস্টের ও সিরিজ়ের ফয়সালা হয়ে যাবে। কিন্তু রবিবার সারা দিন ধরে যে উত্তাপ তৈরি হয়েছিল, তা হবে না। একটা গোটা দিনের লড়াইয়ের পর সাফল্যের তৃপ্তি পাবেন না ক্রিকেটারেরা। ভারত ও ইংল্যান্ড দু’দলই শেষ হাসির যোগ্য। কিন্তু তাতে কোনও ভাবেই রবিবারের হতাশা ঢাকা যাবে না। লন্ডনের ওভালের গ্যালারিই হোক বা কলকাতার অফিসপাড়া, দর্শকেরা যে ভাবে দিনের শেষে হতাশ হয়েছেন সেই ছবিটা থেকেই যাবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement