মঙ্গলবার আবু ধাবিতে আইপিএলের নিলাম সঞ্চালনা করছেন মল্লিকা সাগর। ছবি: এক্স।
আইপিএলের নিলাম মানেই বিদেশি ক্রিকেটারদের পিছনে দৌড়াদৌড়ি, এই ছবি দেখতেই অভ্যস্ত ভারতীয় ক্রিকেট। বিশেষ করে ছোট নিলামে তো সব নজর বিদেশিদের দিকেই থাকত। স্যাম কারেন, ক্রিস মরিসেরা তার উদাহরণ। এ বারও তা দেখা গিয়েছে। ক্যামেরন গ্রিনকে কিনতে ২৫ কোটি ২০ লক্ষ টাকা খরচ করেছে কলকাতা নাইট রাইডার্স। তবে সার্বিক ছবিটা বদলেছে। বিদেশিদের তুলনায় ঘরোয়া অনামী ভারতীয় ক্রিকেটারদের নিতে ঝাঁপিয়েছে ১০ দল। কেন হঠাৎ ঘরোয়া ক্রিকেটারদের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে?
মঙ্গলবার আবু ধাবিতে নিলামে মোট ৭৭ জন ক্রিকেটার বিক্রি হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৩৯ জন ঘরোয়া ভারতীয় ক্রিকেটার। অর্থাৎ, যাঁরা এখনও পর্যন্ত ভারতীয় দলে সুযোগ পাননি। ভারতীয় দল তো দূর, এই ৩৯ জনের মধ্যে অনেকেই রঞ্জি পর্যন্ত খেলেননি। তাঁরাই টেক্কা দিয়েছেন রঞ্জি, এমনকি, জাতীয় দলে খেলা ক্রিকেটারদের।
এ বারের নিলামে আট জন ঘরোয়া ক্রিকেটার কোটিপতি হয়েছেন। তাঁরা হলেন— কার্তিক শর্মা (১৪ কোটি ২০ লক্ষ), প্রশান্ত বীর (১৪ কোটি ২০ লক্ষ), আকিব দার (৮ কোটি ৪০ লক্ষ), মঙ্গেল যাদব (৫ কোটি ২০ লক্ষ), তেজস্বী সিংহ (৩ কোটি), অক্ষত রঘুবংশী (২ কোটি ২০ লক্ষ), সলিল অরোরা (১ কোটি ৫০ লক্ষ) ও নমন তিওয়ারি (১ কোটি)। কার্তিক ও প্রশান্ত দু’জনকেই কিনেছে চেন্নাই সুপার কিংস। যে চেন্নাইকে এক সময় ‘ড্যাডিজ় আর্মি’ বলা হত তারাই এখন দুই ‘বাচ্চার’ পিছনে ২৮ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা খরচ করেছে।
এই পরিকল্পনার নেপথ্যে যে যুক্তি রয়েছে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন চেন্নাইয়ের কোচ স্টিফেন ফ্লেমিং। তিনি বলেন, “যদি দলে ভাল ঘরোয়া ক্রিকেটার থাকে তা হলে শক্তি বাড়ে। কখনও কখনও ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ করতে হয়। আমরা সেটাই করেছি।” হঠাৎ করে কার্তিক ও প্রশান্তকে কেনেননি ফ্লেমিংয়েরা। তিনি বলেন, “গোটা বছর ধরে আমাদের স্কাউট দল ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিযোগিতার উপর নজর রাখে। সেখানে কারা ভাল খেলছে দেখে। তাদের এখনকার পারফরম্যান্সের পাশাপাশি ভবিষ্যতে তারা কতটা ভাল হতে পারবে, সেই বিশ্লেষণও করা হয়। তার পরে আমরা কাউকে নিই। ওরা সকলে ভবিষ্যতের সম্পদ।”
আসলে গত কয়েক বছরে ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের ছবিটা বদলে গিয়েছে। বিশেষ করে টি-টোয়েন্টির ক্ষেত্রে। মহারাষ্ট্র, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কেরল, পঞ্জাব-সহ মোট ১০টা রাজ্যে লিগ চলে। সেখান থেকেই এই প্রতিভাদের খুঁজে বার করা হয়। গত বারই দেখা গিয়েছে তার ফসল। দিল্লি প্রিমিয়ার লিগে ভাল খেলে আইপিএলে জায়গা পেয়েছিলেন দিগ্বেশ রাঠী ও প্রিয়াংশ আর্য। আইপিএলেও নজর কেড়েছিলেন তাঁরা। সেই পথেই এগোচ্ছে আইপিএল।
১৪ কোটি ২০ লক্ষ টাকা পাওয়া প্রশান্ত এ বার ইউপি টি২০ লিগে আট ম্যাচে ৩২০ রান করেছেন। নিয়েছেন ৮ উইকেট। ব্যাটে গড় ৬৪। বলে ইকোনমি ৬.৬৯। কার্তিক আবার শের-ই-পঞ্জাব লিগে ১০ ইনিংসে ৪৫৭ রান করেছেন। ১৬৮.০১ স্ট্রাইক রেটে রান করেছেন তিনি। কেকেআরের কেনা তেজস্বীও ঘরোয়া লিগে নজর কেড়েছেন। দিল্লির হয়ে চারটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ৫৬.৫০ গড়ে করেছেন ১১৩ রান। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল তেজস্বীর স্ট্রাইক রেট। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তাঁর স্ট্রাইক রেট ১৭০। দিল্লি প্রিমিয়ার লিগে ১২ বলে অর্ধশতরান করে নজর কাড়েন। এই প্রতিযোগিতায় তাঁর স্ট্রাইক রেট ১৯০। করেছেন ৩৩৯ রান। এই প্রতিযোগিতায় তিনি ২০টি চার এবং ২৯টি ছক্কা মারেন। এ ছাড়া দিল্লির একটি প্রতিযোগিতায় ওভারের ছয় বলে ছ’টি ছক্কা মারারও নজির রয়েছে তেজস্বীর। সেই কারণেই তাঁর পিছনে ৩ কোটি খরচ করেছে কলকাতা। কেকেআরের সার্থক রঞ্জন আবার দিল্লি প্রিমিয়ার লিগে দ্বিতীয় সর্বাধিক (৪৪৯) রান করেছেন।
শুধু তাঁরাই নন, ৮ কোটি ৪০ লক্ষে কেনা জম্মু-কাশ্মীরের আকিব এ বারের রঞ্জিতে ২৯ উইকেট নিয়েছেন। মুস্তাক আলিতে ৭.৪১ ইকোনমিতে ১৫ উইকেট নিয়েছেন। তাই তাঁকে কিনেছে দিল্লি। বেঙ্গালুরু ৫ কোটি ২০ লক্ষে কিনেছে মঙ্গেশকে। মধ্যপ্রদেশের এই বাঁহাতি পেসার ইয়র্কারের জন্য ইতিমধ্যেই ঘরোয়া ক্রিকেটে নাম করেছেন। ভারতে এমনিতেও বাঁহাতি পেসারের সংখ্যা কম। ফলে মঙ্গেশকে তৈরি করতে চাইছে বেঙ্গালুরু।
এই ক্রিকেটারেরা খবরের শিরোনামে কম আসেন। তাই সাধারণ মানুষ তাঁদের খবর বেশি জানেন না। কিন্তু যাঁদের কাজ ক্রিকেটার খোঁজা, তাঁরা তো জানবেনই। ফ্লেমিংয়ের কথায়, “ওরা বাকিদের কাছে অপরিচিত হতে পারে, কিন্তু আইপিএলে ১০ দলের কাছে নয়। ওদের কে কেমন খেলে, কতটা প্রতিভা তা দলগুলো জানে। সেই কারণেই ওদের নিতে তাড়াকাড়ি হয়।”
এক সময় ফুটবলে এই ছবি দেখা যেত। বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের মতো দল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ফুটবলার তুলে আনত। সেই ছবিটা এখন আইপিএলে। মুম্বই অবশ্য আগেই তা করে দেখিয়েছে। জসপ্রীত বুমরাহ, হার্দিক পাণ্ড্যদের তুলে এনেছে তারা। আইপিএল না থাকলে হয়তো ভারতীয় দলে দু’জনের খেলাই হত না। ভারত পেত না দু’জন ম্যাচ উইনারকে। মুম্বইয়ের পথেই হাঁটতে শুরু করেছে বাকি ন’দল। ভবিষ্যতের হার্দিক, বুমরাহদের তুলে আনার কাজ শুরু করে দিয়েছে তারা।