রোমার ফরোয়ার্ড এদিন জ়েকো।
কত বয়স হবে তখন ছেলেটার? বছর ছয় কি সাত। আর পাঁচটা দিনের মতো সে দিনও ফুটবলটা নিয়ে ছুটেছিল মাঠে। কিন্তু মা আটকে দেন। এর মিনিট দশেক পরে যুদ্ধবিমান থেকে বোমাবর্ষণে ধ্বংস হয়ে যায় সারায়েভোর একটা ফুটবল মাঠ। যে মাঠে খেলতে যাওয়ার কথা ছিল ওই ছেলেটার।
সে দিনের ছেলেটা, আজকের রোমার ফরোয়ার্ড এদিন জ়েকো। যিনি শুধু বসনিয়া-হার্জ়িগভিনার হয়ে বিশ্বকাপেই খেলেননি, বিশ্বের তিনটি সেরা লিগে দাপিয়ে খেলেছেন— ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, বুন্দেশলিগা, সেরি আ। ম্যাঞ্চেস্টার সিটিকে ইপিএল চ্যাম্পিয়ন করেছেন, দেশের হয়ে সর্বোচ্চ গোল করেছেন। রোমার হয়ে এ বারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সব চেয়ে বেশি গোল করেছেন। কিন্তু ফুটবল জীবনের সোনার আলো এখনও মুছে দিতে পারেনি ভয়াবহ যুদ্ধের সেই কালো রাতগুলো।
অতীতের সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দিনগুলোর কথা উঠলেই বিষণ্ণ হয়ে পড়েন জ়েকো। বসনিয়ার সেই স্বাধীনতা যুদ্ধ আপনার জীবনে কতটা প্রভাব ফেলেছে? আনন্দবাজারের প্রশ্নের জবাবে জ়েকো বলেন, ‘‘এখন আর সেই দিনগুলোয় ফিরে যেতে চাই না। ভয়ঙ্কর সব অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে আমাদের যেতে হয়েছিল। শুধু এইটুকু বলব, যুদ্ধ আমাকে মানসিক ভাবে আরও কঠিন করে তুলেছে। আর জীবনের ছোট ছোট দিকগুলোও উপভোগ করতে শিখিয়েছে।’’
ছ’ফুটের ওপর লম্বা এই ফরোয়ার্ড দেশের হয়ে বিশ্বকাপে গোল করেছেন, ম্যাচের সেরা হয়েছেন। ইপিএল জেতা ছাড়াও বুন্দেশলিগায় উলফ্সবার্গকে চ্যাম্পিয়ন করিয়েছেন। সেরি আ, বুন্দেশলিগায় সর্বোচ্চ স্কোরার হয়েছেন। যদিও এ বারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে এফসি পোর্তোর কাছে শেষ মুহূর্তের গোলে হেরে ছিটকে যেতে হয়েছে। তাঁর এই বর্ণময় ফুটবল জীবনে সেরা মাইলফলক কী? জ়েকোর জবাব, ‘‘আমি বিশ্বের সেরা তিনটি লিগে খেলেছি। তিনটে লিগেই প্রচুর গোল করেছি। এটা যে কোনও ফুটবলারের কাছে খুবই কৃতিত্বের ব্যাপার।’’
এর পরে অবশ্য আলাদা করে তিনটি ঘটনার কথা বলছেন বসনিয়ার সর্বকালের সেরা ফুটবলার। যাঁর নামই হয়ে গিয়েছে ‘বসনিয়ার হিরে’। ‘‘ম্যান সিটি আর উলফ্সবার্গকে লিগ চ্যাম্পিয়ন করিয়েছিলাম। ফুটবল জীবনে আমার অন্যতম স্মরণীয় ট্রফি ওই দুটো। তবে দেশের হয়ে বিশ্বকাপ খেলাটা একটা বিশেষ অনুভূতি। বসনিয়া হারজেগোভিনার হয়ে ব্রাজিল বিশ্বকাপে খেলতে নামার মুহূর্তটা কখনও ভুলতে পারব না। ওটাই আমার ফুটবল জীবনের সেরা প্রাপ্তি।’’
তাঁর এই ফুটবল যাত্রায় বাবা-মায়ের অবদানের কথা কখনও ভুলতে পারবেন না জ়েকো। বিশেষ করে মা বেলমার। যিনি না থাকলে হয়তো এদিন জ়েকোর নামটাই কেউ শুনত না। বাবা-মার ভূমিকা কতটা আপনার ফুটবল জীবনে? জ়েকোর জবাব, ‘‘আমার নামটা যে আজ অনেকে জেনেছে, তার পিছনে অবশ্যই আমার বাবা-মা। আমি আজ যা হয়েছি, তার যাবতীয় কৃতিত্ব ওদের। আর আমি শুধু ফুটবল তারকা হয়ে ওঠার কথাই বলছি না। এই তারকার আড়ালে যে মানুষটা আছে, তার কথাও বলছি।’’
এখানেই না থেমে জ়েকো আরও বলেন, ‘‘যুদ্ধের সময় যে ভাবে বাবা-মা আমাকে সব কিছু থেকে আড়াল করে বড় করেছেন, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ থাকব সারা জীবন। ওঁরা আমাকে শিখিয়েছেন, অন্যদের সব সময় সম্মান করা উচিত। অন্যকে সম্মান না দিলে তুমি নিজেও কারও থেকে সম্মান পাবে না।’’ রবিবার তেত্রিশে পা দিলেন জ়েকো। নিজের অধরা স্বপ্ন নিয়ে বলছিলেন, ‘‘মানছি, আমি এখন আর সেই তরুণ ফুটবলার নেই। কিন্তু তাও আমি ক্লাবকে ট্রফি জেতাতে চাই। এমন কিছু দিতে চাই, যা দেওয়া সহজ নয়।’’
কঠিন কাজ সহজ করে দেখাতে পারেন বলেই তো তিনি এদিন জ়েকো!