magnus carlsen

Magnus Carlsen: যুগাবসান, দাবার ‘একঘেয়ে’ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে আর লড়বেন না পাঁচ বারের চ্যাম্পিয়ন কার্লসেন

দাবার বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে আর লড়বেন না ম্যাগনাস কার্লসেন। এই ম্যাচের জন্য যথেষ্ট অনুপ্রেরণা তিনি আর পাচ্ছেন না।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০২২ ১০:৪১
Share:

ম্যাগনাস কার্লসেন। ফাইল চিত্র

দাবায় একটি যুগের অবসান হতে চলেছে। বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মুকুট ধরে রাখার জন্য আগামী বছর আর লড়াইয়ে নামবেন না ম্যাগনাস কার্লসেন। বিশ্বের অন্যতম সেরা এই দাবাড়ু বুধবার জানিয়ে দিয়েছেন, বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচে তিনি আর খেলবেন না। ২০১৩ সালে ২২ বছর বয়সে প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন নরওয়ের এই দাবাড়ু। তারপর থেকে এই খেতাব তাঁরই দখলে রয়েছে। পাঁচ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কার্লসেন এই বিশেষ ম্যাচটির জন্য এখন আর নিজেকে অনুপ্রাণিত করতে পারছেন না। তিনি বলেছেন, ‘‘এই ম্যাচ খেলার জন্য এখন আর সেই অনুপ্রেরণা পাচ্ছি না। মনে হয় না বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচ থেকে আর কিছু পাওয়ার আছে। ঐতিহাসিক কারণে নিশ্চিত ভাবেই এই ম্যাচের গুরুত্ব আছে। কিন্তু খেলার আর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই।’’

Advertisement

গত বছর দুবাইয়ে ইয়ান নেপোমিয়াচিকে হারিয়ে পঞ্চম বারের জন্য বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরেই মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, কার্লসেন এই বছর আর খেলবেন না। তখনই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, এই বছরও সেই নেপোমিয়াচির বিরুদ্ধেই খেলতে হবে তাঁকে। তাই তিন গেম বাকি থাকতে ৭.৫-৩.৫ ফলে একপেশে ফাইনালে জেতার পরেই কার্লসেন স্বীকার করে নিয়েছিলেন, ‘‘এখনই মোটামুটি বলে দিতে পারি, এটাই আমার শেষ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ। একটা সময় এই প্রতিযোগিতার যতটা গুরুত্ব আমার কাছে ছিল, এখন আর সেটা নেই।’’

তখন এটাও বোঝা গিয়েছিল, এক মাত্র ইরানের ১৯ বছরের আলিরেজা ফিরৌজা যদি তাঁর চ্যালেঞ্জার হতেন, তা হলে কার্লসেন সিদ্ধান্ত বদলাতেন। গত বছর দাবার ইতিহাসে কনিষ্ঠ হিসাবে ২৮০০ রেটিংয়ে পৌঁছনোর কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন ফিরৌজা। নতুন তরতাজা কাউকে চ্যালেঞ্জার হিসাবে খুঁজছিলেন কার্লসেন। সেটা না পাওয়া তাঁর সরে যাওয়ার অবশ্যই একটা কারণ।

Advertisement

বিশ্বনাথন আনন্দের সঙ্গে লড়াইয়ে ম্যাগনাস কার্লসেন। ফাইল চিত্র

একঘেয়েমির আরও একটা কারণ আছে। ফাইনালে নামার আগের প্রস্তুতি পর্বগুলো আর ভাল লাগছিল না কার্লসেনের। গত বছরের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের পরেই বলেছিলেন, ‘‘কার বিরুদ্ধে খেলতে হবে, সেটা জানার পর থেকেই মনের মধ্যে প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। এক বার তো আমার ‘সেকেন্ড’-এর সঙ্গে শুধু ‘ওপেনিং’ নিয়েই তিন মাস ধরে চর্চা করেছিলাম। বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের আগে প্রতিটা ম্যাচে, প্রতিটা প্রতিযোগিতায় মাথার মধ্যে সেই বিপক্ষকে নিয়ে ভাবনা-চিন্তা চলে। ফলে বাকি প্রতিযোগিতাগুলোয় ভাল ভাবে খেলা যায় না। বছরের পর বছর এটা করতে হলে একটা সময়ের পরে বিরক্ত লাগে।’’ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের ফরম্যাট নিয়েও কার্লসেনের অনেক দিনের আপত্তি। এত দীর্ঘ প্রতিযোগিতা তিনি কোনও দিনই পছন্দ করেননি।

কার্লসেনের সঙ্গে ৬৪ খোপের সাদা-কালো বোর্ডের যে ঘনিষ্ঠ প্রেম, তা নয়। দাবাই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান, এটা কখনই বলা যাবে না। ফুটবল থেকে ফ্যান্টাসি ফুটবল, পোকার থেকে প্যাডেল টেনিস— নানা বিষয়ে তাঁর আগ্রহ রয়েছে। তা ছাড়া তিনি সফল ব্যবসায়ী। তাঁর ‘প্লে ম্যাগনাস’ সংস্থা গোটা বিশ্বে একচেটিয়া ব্যবসা করে।

বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে না খেললেও দাবা থেকে পুরোপুরি অবসর নিচ্ছেন না কার্লসেন। প্রতিযোগিতামূলক দাবায় তিনি খেলবেন বলে জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে খেলার থেকেও প্রতিযোগিতামূলক দাবায় খেলা অনেক বেশি উপভোগ করি। তাই সেগুলো খেলব। এখনই অবসর নিচ্ছি না।’’ এই সপ্তাহে ক্রোয়েশিয়ায় একটি প্রতিযোগিতায় খেলবেন বলে ঠিকও করে ফেলেছেন।

১৩ বছর বয়সে গ্র্যান্ডমাস্টার হন কার্লসেন। ১৯ বছর বয়সে বিশ্বের এক নম্বর দাবাড়ু হন। বিশ্বনাথন আনন্দকে হারিয়ে ২০১৩ সালে প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হন। তারপর আরও চার বার তিনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের লড়াইয়ে আনন্দকে দ্বিতীয় বার হারান। তারপর হারান সের্গেই কারিয়াকিন, ফ্যাবিয়ানো কারুয়ানা এবং ইয়ান নেপোমিয়াচিকে।

বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে কার্লসেনের না খেলার সিদ্ধান্ত দাবাজগতে বিরাট শূন্যতা তৈরি করবে। এই মুহূর্তে নিঃসন্দেহে তিনিই দাবার সব থেকে বড় তারকা। দাবার ক্রমতালিকায় তিনি সর্বোচ্চ ২৮৮২ পয়েন্টে পৌঁছেছিলেন। এই কৃতিত্ব আর কারও নেই। চেসডটকম নামে একটি ওয়েব সাইট তাঁকে সর্বকালের সেরা দাবাড়ুদের তালিকায় গ্যারি কাসপারভের পরে দ্বিতীয় স্থানে রেখেছে। তাঁর পরে জায়গা পেয়েছেন ববি ফিশার।

কিছু দিন আগেই কার্লসেন সম্পর্কে কাসপারভ বলেছিলেন, ‘‘মনে হয় না ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আমার মনে হয় অতিরিক্ত ম্যাচ খেলে খেলে ওর মধ্যে একটা একঘেয়েমি কাজ করছে।’’ ক্লান্ত নন বলেই হয়তো শেষে কার্লসেন এটাও বলেছেন, ‘‘ভবিষ্যতে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের লড়াইয়ে ফিরব না, এমন নয়। কিন্তু ফিরবই, সেটাও হলফ করে বলতে পারছি না।’’

কোনও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পরের বছর আর খেলবেন না— এই নিদর্শন এটাই প্রথম নয়। ১৯৭৫ সালে ‘বিদ্রোহী’ ববি ফিশারের প্রতিযোগিতা থেকে সরে দাঁড়ানো তুমুল বিতর্ক তৈরি করেছিল। তার তিন বছর আগে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে বরিস স্প্যাসকির বিরুদ্ধেও সরে দাঁড়িয়েছিলেন ফিশার। তাঁর অভিযোগ ছিল, পুরস্কারমূল্য খুব কম। শেষ পর্যন্ত আমেরিকার এক ধনকুবেরের মধ্যস্থতায় খেলতে রাজি হন ফিশার। এই তালিকায় সবথেকে বড় ‘বিদ্রোহী’ ছিলেন গ্যারি কাসপারভ। বিশ্ব দাবার নিয়ামক সংস্থা ‘ফিডে’-র সঙ্গে সরাসরি সঙ্ঘাতে গিয়ে তিনি ‘ক্লাসিক্যাল ওয়ার্ল্ড চেস চ্যাম্পিয়নশিপ’ নামে বিকল্প একটি প্রতিযোগিতা শুরু করেছিলেন।

কার্লসেনহীন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নিঃসন্দেহে দীন হবে, আকর্ষণ কমবে, লগ্নিও কম হবে। কার্লসেন গত বছর যখন না খেলার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তখনই আনন্দ বলেছিলেন, ‘‘এর অভিঘাত সুদূরপ্রসারী হতে চলেছে। কারণ আমরা এক জন চ্যাম্পিয়নকে হারাচ্ছি। প্রেক্ষাপটটাও একটু অদ্ভুত। যাই হোক, দাবা নিজের মতো এগিয়ে যাবে।’’

কার্লসেনও হয়তো এগিয়ে যাবেন। বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে না খেললেও তাঁর একটি লক্ষ্য এখনও পূরণ হয়নি। সেটি হল ২৯০০ এলো রেটিংয়ে পৌঁছনো, যাকে তিনি এভারেস্ট জয় করার সঙ্গে একই বন্ধনীতে রেখেছেন। এই বছরের শুরুতে টুইট করেছিলেন, ‘২৯০০-তে পৌঁছতে পারলে দারুণ লাগবে। এটাই আমার অনুপ্রেরণা।’’ হয়তো এই অনুপ্রেরণা থেকেই দাবা চালিয়ে যাবেন কার্লসেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন