ইনিংস ও ১৫৯ রানে জয়ী ইংল্যান্ড

লজ্জার হারে দাবি উঠছে পরিবর্তনের

রবিবার সেই আতঙ্কই যেন ফিরে এসেছিল ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের মাঠে। দুই ইনিংস মিলিয়ে ১০৭ এবং ১৩০ বিদেশের মাঠে সর্বকালের নিকৃষ্টতম ব্যাটিং প্রদর্শনীর তালিকায় ঢুকে তো পড়লই, একটা সময় মনে হচ্ছিল চার-পাঁচ জন না বাকি সিরিজে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। অশ্বিনের ডান হাতের আঙুলে বার বার লাগল। হার্দিক পাণ্ড্য দু’তিন বার কঁকিয়ে উঠলেন। ফিজিয়ো এমন ব্যস্ত থাকছিলেন যে, কেউ কেউ বলতে থাকলেন, আর ড্রেসিংরুমে ফিরে যাওয়ার দরকার নেই। মাঠের ধারে বসে থাকলেই তো পারেন। 

Advertisement

সুমিত ঘোষ

লন্ডন শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০১৮ ০৪:১৮
Share:

ভারত : ১০৭ ও ১৩০ ইংল্যান্ড: ৩৯৬-৭ ডি.

Advertisement

এক-এক সময় গুলিয়েই যাচ্ছিল, কোন যুগ আর কোথায় খেলা চলছে! ২০১৮-র ইংল্যান্ডে না অগ্নিযুগের ওয়েস্ট ইন্ডিজে? যখন চার ফাস্ট বোলারের সামনে ঝাঁঝরা হতে দেখা যেত বিশ্বের সব দলকে? অসহায় প্রতিপক্ষ অধিনায়ক ভাবতেন, জীবন রক্ষা করার জন্য ডিক্লেয়ার করবেন কি না!

লর্ডস না সাবাইনা পার্ক? কোথায় টেস্ট হারল ভারত? তখন ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে খেলা মানে মাঠের আশেপাশে হাসপাতালগুলো রেড অ্যালার্ট জারি করে দিত। আর অঘোষিত সাবধান বাণী ছিল— ক্যারিবিয়ান ফাস্ট বোলাররা যদি তোমার উইকেট নিতে না পারে, হাড়গোড় ভেঙে হাসপাতালে পাঠাবে। মাঠে একটার পর একটা উইকেট পড়ত আর ও দিকে হাসপাতালে বেড তৈরি রাখা হত। অতিথি দলের কে কখন সেখানে উপস্থিত হয়, কে জানে!

Advertisement

রবিবার সেই আতঙ্কই যেন ফিরে এসেছিল ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের মাঠে। দুই ইনিংস মিলিয়ে ১০৭ এবং ১৩০ বিদেশের মাঠে সর্বকালের নিকৃষ্টতম ব্যাটিং প্রদর্শনীর তালিকায় ঢুকে তো পড়লই, একটা সময় মনে হচ্ছিল চার-পাঁচ জন না বাকি সিরিজে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। অশ্বিনের ডান হাতের আঙুলে বার বার লাগল। হার্দিক পাণ্ড্য দু’তিন বার কঁকিয়ে উঠলেন। ফিজিয়ো এমন ব্যস্ত থাকছিলেন যে, কেউ কেউ বলতে থাকলেন, আর ড্রেসিংরুমে ফিরে যাওয়ার দরকার নেই। মাঠের ধারে বসে থাকলেই তো পারেন।

কে বলবে, প্রতিপক্ষের নাম ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ নয়। দলটা আসলে ইংল্যান্ড। যারা মোটেও অপরাজেয় নয়। পাকিস্তান এই লর্ডসেই তাদের হারিয়ে গিয়েছে। আর তাদের দলে আলোকের গতিবেগে বল করার মতোও কেউ নেই। জিমি অ্যান্ডারসন, স্টুয়ার্ট ব্রডদের অস্ত্র সুইং, গতি নয়। তাতেই যে রকম থরহরিকম্প দেখা গেল, অবিশ্বাস্য! সুইং কী ভাবে খেলব, তা নিয়ে কোনও ধারণা নেই। তার উপর ঘণ্টায় ৮০-৮৫ মাইল গতিবেগের বোলারদের খেলতে গিয়েও কখনও হাতে লাগছে, গায়ে লাগছে, মাঠে গড়াগড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ছে।

ধাক্কা লাগার শুরু অবশ্য সকাল থেকেই। পিঠের দিকে যন্ত্রণা যে বেশ উদ্বেগের পর্যায়ে পৌঁছেছে, রবিবারের আনন্দবাজারেই তা লেখা হয়েছিল। সেই আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করে কোহালি সকালে ফিল্ডিং করতেই নামলেন না। সহ-অধিনায়ক অজিঙ্ক রাহানে নেতৃত্বের দায়িত্ব সামলালেন। কোহালিকে ড্রেসিংরুমের ব্যালকনিতেও দেখা যাচ্ছিল না। ব্যথা কমানোর ওষুধ খেয়ে পরে ব্যাট করতে নামলেও একেবারেই স্বচ্ছন্দে ছিলেন না তিনি। ফিজিয়োকে ডেকে শুশ্রূষাও করাতে হল।

বৃষ্টির পূর্বাভাসও কাজে এল না। ইংল্যান্ড ডিক্লেয়ার করে দিল ২৮৯ রানে এগিয়ে থেকে। প্রথম ইনিংসে এত অল্প রানের ‘লিড’ হাতে নিয়ে ডিক্লেয়ার করার ঘটনা খুব বেশি দেখা যাবে না। কিন্তু চলতি সফরে মনে হচ্ছে, এ রকম অনেক লজ্জাই অপেক্ষা করে আছে ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য। কমেন্ট্রি বক্সে ইংল্যান্ডের অনেক প্রাক্তন তারকা রয়েছেন। ডেভিড গাওয়ার, ইয়ান বোথাম, নাসের হুসেন। তাঁরা বলাবলি করছিলেন, বেশি সময় নষ্ট না করে ইনিংস ছেড়ে দেওয়াই ভাল। যদি বৃষ্টি এসে নিশ্চিত জয় আটকে দেয়। গাওয়ার, বোথামরা একটু বেশিই আশা করছিলেন ভারতীয় ব্যাটিংয়ের থেকে। বৃষ্টিতে প্রথম দিনে একটিও বল হয়নি। শেষ দিনের দরকারই হল না। তিন দিনেই টেস্টের ভবলীলা সাঙ্গ এবং ইনিংসে হার। তা-ও তিন দিন নয়, ধরা উচিত আড়াই দিন। আবহাওয়ার জন্য দ্বিতীয় দিনেও অনেকটা সময় নষ্ট হয়। দুই ইনিংস মিলিয়ে ভারত যত ওভার খেলেছে, তার চেয়ে একটা ইনিংসেই বেশিক্ষণ টিকেছে ইংল্যান্ড। লর্ডসে এর আগে ব্যাটিংয়ের লজ্জার অতীত রয়েছে ভারতের। ১৯৭৪-এ ওয়াড়েকরের ভারতের ৪২ অলআউট হওয়া। কিন্তু সেই টেস্টেও প্রথম ইনিংসে তিনশোর উপর তুলেছিল ভারত। এখানে ৪২-এর লজ্জা ফিরে আসেনি। কিন্তু ১০৭ এবং ১৩০ বহুকালের মধ্যে সর্বাধিক লজ্জার তো বটেই। কোহালির ক্যাপ্টেন্সি আমলেরও সব চেয়ে লজ্জার হার।

অধিনায়কের পিঠের যন্ত্রণা কোনও ওষুধে কমবে কি না, কেউ জানে না। কিন্তু যে রকম চোখমুখ নিয়ে তাঁকে বেরিয়ে যেতে দেখা গেল, হারের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনও ওষুধ খুঁজে এখনই পাবেন না, বলে দেওয়া যায়। লর্ডসে ২-০ এগিয়ে গেল ইংল্যান্ড। বাকি থাকা তিন টেস্টে অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন ঘটবে, কেউ আশা করছে না। স্বয়ং অধিনায়কেরই যেখানে চোট। বাকি সিরিজে তিনি থাকতে পারবেন কি না, সেই নিশ্চয়তা নেই। প্রশ্ন উঠছে, তাঁর দলের যোগ্যতা নিয়েও। দু’টো টেস্ট হয়ে গেল, ওপেনারদের ব্যাটে রান নেই। কে এল রাহুল, এম বিজয়দের ব্যাটিং দেখে উল্টে বলাবলি শুরু হয়ে গিয়েছে, বেচারা শিখর ধওয়ন আর কত খারাপ খেলছিল? এ দিন হরভজন সিংহকে ইংল্যান্ডের প্রাক্তন ক্রিকেটারেরা জিজ্ঞেস করছিলেন, ভারতের হাতে আর কারা ওপেনার আছে? চেতেশ্বর পূজারার ইংল্যান্ডে সর্বোচ্চ স্কোর এখনও পর্যন্ত ৫৫। এ দিন ৮৭ বল খেলে করেছেন ১৭। মাত্র একটা বাউন্ডারি। স্ট্রাইক রেট কুড়িরও নীচে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও এক বার বলে গেলেন, ‘‘এত ঠুকঠুক করে খেলার কী আছে, কে জানে!’’ হরভজন বললেন, ‘‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বোলারের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধটাও জিততে হবে। এত ঘাড়ে চাপতে দিলে তো নিজেদের পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে যাবে।’’ অজিঙ্ক রাহানে চার বছর আগে লর্ডসে সেঞ্চুরি করছিলেন। এ বারের সফরে তাঁকেও দিশাহীন দেখাচ্ছে। দীনেশ কার্তিকের টেস্ট কেরিয়ার যদি লর্ডসের ও-পারেও অক্ষত থাকে, তা হলে বুঝতে হবে ভারতীয় ক্রিকেটে ঘোর দুর্যোগ উপস্থিত। কারও কারও মনে হচ্ছে, ট্রেন্ট ব্রিজ থেকেই ঋষভ পন্থকে নামিয়ে দেওয়া হোক। আড়াই দিনে হারের চেয়ে খারাপ আর কী হবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন