ফেভারিট কে দেখালেন মলিনা, হিউম হুঙ্কারে ফোরলানের দর্পচূর্ণ

সোনার বলের মালিকের ফকির হয়ে ফেরার দিনটি উপভোগই করল কলকাতার ‘নিষ্ঠুর’ দর্শক। আবেগ আর উত্তেজনার আগুনে পুড়তে পুড়তে। দিয়েগো ফোরলানের মতো মহাতারকা লালকার্ড দেখে বেরিয়ে যাচ্ছেন মাথা নিচু করে।

Advertisement

রতন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:২৮
Share:

নায়কের প্রবেশ। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

কলকাতা-৩ (ডিকা, হিউম পেনাল্টি-সহ ২)

Advertisement

মুম্বই-২ (কোস্টা, গারসন)

Advertisement

সোনার বলের মালিকের ফকির হয়ে ফেরার দিনটি উপভোগই করল কলকাতার ‘নিষ্ঠুর’ দর্শক। আবেগ আর উত্তেজনার আগুনে পুড়তে পুড়তে।

দিয়েগো ফোরলানের মতো মহাতারকা লালকার্ড দেখে বেরিয়ে যাচ্ছেন মাথা নিচু করে। অপ্রত্যাশিত এই দৃশ্য দেখার জন্য যেন প্রস্তুত ছিলেন না রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে উপস্থিত সাড়ে বারো হাজার দর্শক। ঘটনার রেশ তাই ছিল মাত্রাছাড়া। একসঙ্গে জ্বলে ওঠা হাজার হাজার মোবাইলের আলোয় ম্যাচের পর তাই ফিরল অকাল দিওয়ালি রাত। এ বারের আইএসএলের সেরা ম্যাচের উত্তেজক পরিসমাপ্তি এবং আটলেটিকো দে কলকাতার চমকপ্রদ জয়কেও এ ভাবেই যেন বরণ করে নিলেন এটিকে সমর্থকরা।

নব্বই মিনিটের ম্যাচে রয়ে গেল আরও কত ঘটনা আর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কোলাজ!

একটা লালকার্ড, সাতটা হলুদ কার্ড। ধাক্কাধাক্কি, তেড়ে যাওয়া। পেনাল্টি। বিরতির আগেই পাঁচ-পাঁচটা গোল। পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা চূড়ান্ত আক্রমণাত্মক এবং চড়া মেজাজের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই—সবই ঘটল সরোবরে। যার জেরে হিউমদের টিম বাস স্টেডিয়াম ছেড়ে বেরোনোর সময় তাতে আছড়ে পড়লেন এটিকে সমর্থকরা। টুর্নামেন্টে প্রথম বার দেখা গেল এই দৃশ্য। স্লোগান আর হুল্লোড়ে যেন সবাই বলতে চাইলেন, ‘জয়যাত্রায় যাও হে’। যে আবহে ধুলো উড়িয়ে ‘মিশন মুম্বই’ অভিযানে চলে গেল আটলেটিকো দে কলকাতার টিম বাস।

টুর্নামেন্টের হটফেভারিট ফোরলান-সুনীলদের মুম্বইকে হারিয়ে একই সঙ্গে জোড়া উপহার শনিবাসরীয় রাতে পেয়ে গেল জোসে মলিনার কলকাতা। তীব্র উত্তেজক ম্যাচ জিতে এক গোলের অ্যাডভান্টেজে অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলার সুযোগ তো পাচ্ছেনই পস্টিগারা। সঙ্গে ফোরলান নামক টুর্নামেন্টের ইউএসপি-কে নিয়ে আর ভাবতে হবে না কলকাতার ডিফেন্সকে। বিশ্বের অন্য টুর্নামেন্টের মতো অ্যাওয়ে গোলের নিয়ম নেই আইএসএলে। আন্ধেরি স্পোর্টস কমপ্লেক্সে তাই মঙ্গলবার সুনীল-সনিদের বিরুদ্ধে ড্র করতে পারলেই আন্তোনিও হাবাসকে ছুঁয়ে ফেলবেন মলিনা। পৌঁছে যাবেন ফাইনালে। এ দিন এটিকে যা খেলল সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেই কোচির টিকিট পাওয়া আটকাবে না দ্যুতি-ডিকাদের। ম্যাচের পর তৃপ্ত দেখালেও কলকাতা কোচ অবশ্য বলে দিয়েছেন, ‘‘জিতে আছি ভেবে অ্যাওয়ে ম্যাচে মাঠে নামব না আমরা। আমাদের মাথায় থাকবে আরও একটা ম্যাচ খেলতে নামছি এবং সেটায় জিততে হবে।’’

ফোরলান, ফোরলান করে গত কয়েক দিন এত প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়েছিল মলিনাকে যে, বিরক্ত হচ্ছিলেন কলকাতা কোচ। এ দিন তিনি প্রমাণ করে ছাড়লেন, সাঁইত্রিশের কোনও ফুটবলার নিয়ে সাধারণ লোকজন মাতামাতি করতে পারে কিন্তু বিশেষজ্ঞ কোচ সেই স্রোতে গা ভাসানোর বান্দা নন। বরং ফেভারিট তকমা নিয়ে নামা কোনও টিমকে কোন অস্ত্রে বধ করতে হয় সেই টোটকা মলিনার ঝুলিতে মজুত।

নায়কের প্রস্থান। ছবি: উৎপল সরকার।

দেশের এক নম্বর স্ট্রাইকার সুনীল ছেত্রীকে নড়তে দেননি স্প্যানিশ কোচ। তিয়াত্তর মিনিট পর্যন্ত মাঠে ছিলেন উরুগুয়ের সুপারস্টার ফোরলান। একটা চমৎকার ফ্রিকিক ছাড়া গোটা তিনেক ভাল পাস বাড়াতে পেরেছেন শুধু। হিউমরা আক্রমণের ঝড় তুলে নড়বড়ে করে দিয়েছেন আলেজান্দ্রো গুইমারেসের গর্বের রক্ষণ। এ সবই হয়েছে মলিনার নিখুঁত স্ট্র্যাটেজির জন্য। রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে তুলে এনে জুয়েল রাজার মতো দৌড়বাজকে ঝুঁকি নিয়ে ব্যবহার করেছেন বিপক্ষের মাঝমাঠকে ঘেঁটে দিতে। টিমের সবথেকে অভিজ্ঞ মিডিও বোরহা ফার্নান্ডেজকে পিভট করে দিয়ে মাঝমাঠ থেকে ফোরলানদের সাপ্লাই লাইন কেটে দিয়েছেন কলকাতা কোচ। আর দু’প্রান্ত নিয়ে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন দ্যুতি আর ডিকার মতো দুই টাট্টু ঘোড়াকে। যাঁদের দাপটে লিগ টেবলের এক নম্বর দলের ঘরে নেমে এল অন্ধকার।

পরিবেশ আদালতের নির্দেশে সরোবর স্টেডিয়ামে বাজি পোড়ানো নিষিদ্ধ। তাই গোলের পর বা ম্যাচ শুরুর আগে-পরে দেশের অন্য মাঠের মতো এখানে বাজি পোড়াতে পারছেন না সংগঠকরা। কিন্তু গোলের বারুদে আগুন লাগানোর জন্য যে এত লোক মজুত আছেন কলকাতা এবং মুম্বইয়ের জার্সি গায়ে সেটাই বা জানত কে? বিরতির আগেই সেই গোল-বাজিতে রঙিন হয়ে উঠল স্টেডিয়াম। ১-০ থেকে ১-১, ১-২, ২-২, ৩-২— একটা সময় তো মনে হচ্ছিল, টেনিসেই তো এ রকম হয়!

ফোরলানের কম্পাস মাপা ফ্রি কিক থেকে মুম্বইয়ের কোস্টার হেডের গোল বা দ্যুতির বাড়ানো পাসে হিউমের ২-২ করে কলকাতাকে সমতায় ফেরানোর গোল রামধনুর রং ছড়িয়ে দিল। খেলার আগে যে ম্যাচের আবহ দেখে মনে হয়েছিল, সতর্কতার মোড়কে ঢাকা থাকবে, বাস্তবে দেখা গেল উল্টোটা। আক্রমণের ছররায় ঝাঁঝরা হল দু’দলের ডিফেন্সই।

বিরতির আগেই গ্রুপ লিগের সবথেকে কম গোল খাওয়া শক্তপোক্ত মুম্বই রক্ষণ হজম করে ফেলল তিন-তিনটে গোল। গোলে যে ছিলেন সেই অমরিন্দর সিংহ! গত বার এটিকের গোলে দাঁড়িয়ে তিনটে গোল খেয়েছিলেন। এ বার মুম্বইয়ের গোলে দাঁড়িয়েও একই কলঙ্কের স্মৃতি ফিরে এল তাঁর জীবনে। এবং সেই সেমিফাইনালেই!

আর কলকাতার গোল খাওয়া দেখে গ্যালারিতে বসে থাকা অর্ণব মন্ডল নিশ্চয়ই আরও একটা নতুন যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন। হয়তো এটা ভেবে যে, কী সব গোল খাচ্ছে তাঁর টিম! টিম সূত্রের খবর, অর্ণবের যা চোট তাতে হয়তো অস্ত্রোপচার করতে হবে। এবং সেটা হলে বাকি আইএসএলে তিনি আর নেই। অর্ণব বাইরে চলে যাওয়ায় এমনিতেই সমস্যায় পড়েছিলেন মলিনা। কিংশুককে দিয়ে সেটা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেন। সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলেন সেরেনোকে। নতুন দুই স্টপার জুটি জমাট বাঁধতে বাঁধতেই জোড়া গোল খেয়ে বসল মলিনার রক্ষণ। তবে মলিনার টিমের সুবিধা হয়ে গিয়েছিল, বোরহা সেরা ফর্মে থাকায়। অসাধারণ ফুটবল খেললেন স্প্যানিশ মিডিও। যা এককথায় অধিনায়কোচিত। ব্লকার থেকে পাসার— সব ভূমিকায় তাঁকে পাওয়া গেল। এবং বিরতির পর কলকাতা যে বুলডোজার চালানোর ভঙ্গিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল নীল জার্সির উপর তাঁর ভগীরথ যদি হন বোরহা, তা হলে তা বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন হিউম আর সমিঘ দ্যুতি। এ দিনের পেনাল্টি-সহ জোড়া গোলের জন্যই শুধু নয়, গত বারের চেয়েও ভাল ফর্মে স্কটিশ স্ট্রাইকার। টুর্নামেন্টে দলের সেরা স্কোরার হিউম এ বার তো পেনাল্টি স্পেশ্যালিস্ট হয়ে উঠেছেন! তাঁর করা সাতটা গোলের চারটিই পেনাল্টি থেকে।

হিউমের পেনাল্টি গোলটা দেখে লাফিয়ে উঠেছিলেন ভিভিআইপি বক্সে বসে থাকা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ভাগ্যিস রণবীর কপূর মাঠে ছিলেন না। সেটা থাকলে দাদা হয়তো লর্ডসের মতোই কিছু ঘটিয়ে ফেলতেন!

আটলেটিকো দে কলকাতা: ড্যানিয়েল, প্রবীর, কিংশুক, সেরেনো, কিগান, জুয়েল, বোরহা, দ্যুতি (বেলেনকোসো), ডিকা (অবিনাশ), পস্টিগা (জাভিলারা), হিউম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন