US Open 2025

মাতৃত্বের বিরতি থেকে ফিরে মেয়ের জন্য খেলতে চান ওসাকা, টেনিস কোর্টের ধারে বসিয়ে সন্তানকে দেবেন জীবনের উত্থান-পতনের পাঠ

টানা অফ ফর্মে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন নেয়োমি ওসাকা। টেনিস থেকে সাময়িক দূরে থাকতে বেছেন নেন মাতৃত্ব। মা হওয়ার পর আবার ফিরেছেন কোর্টে। এখন ব্যর্থতা আর তাঁকে হতাশ করে না। জেদ বাড়ায়।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৮:২৯
Share:

নেয়োমি ওসাকা। ছবি: এক্স।

নেয়োমি ওসাকা ফিরে এলেন বিরতির পর। মাতৃত্ব সুখের বিরতি।

Advertisement

পেশাদার টেনিসে আগাগোড়া দাপট ইউরোপীয় এবং আমেরিকানদের। কিছুটা লাতিন আমেরিকানদের। সেই দাপটের মধ্যেও যে এশীয়রা সর্বোচ্চ পর্যায়ে দাপট দেখিয়েছেন, তাঁদের অন্যতম ওসাকা। বিশ্বের প্রাক্তন এক নম্বর। চারটি গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালকিন। জাপানের খেলোয়াড়ের র‌্যাকেটের ধারে এশিয়ার আধুনিক পাওয়ার টেনিসের সূর্যোদয় দেখেছিল বিশ্ব। দু’বার করে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন এবং ইউএস ওপেনজয়ী ওসাকা কয়েক বছর আগেও ছিলেন গ্র্যান্ড স্ল্যামগুলিতে এশিয়ার সেরা বাজি।

আলোর নীচে রয়েছে অন্ধকার। ওসাকা মূলত হার্ড কোর্টের খেলোয়াড়। ফরাসি ওপেন বা উইম্বলনডনে কখনও তৃতীয় রাউন্ডের বাধা টপকাতে পারেননি! গত উইম্বলডনেও তাঁকে থামতে হয়েছে তৃতীয় রাউন্ডে। ২৭ বছরের সেই ওসাকাই ইউএস ওপেনের শেষ আটে। প্রিকোয়ার্টার ফাইনালে হারিয়েছেন তৃতীয় বাছাই কোকো গফকে। ওসাকার পক্ষে ম্যাচের ফল ৬-৩, ৬-২। উড়িয়ে দিয়েছেন বললেও অতিরঞ্জিত হয় না। ৬৪ মিনিটেই শেষ হয়ে গিয়েছে বছরের অন্যতম ফেবারিটের যাবতীয় প্রতিরোধ।

Advertisement

২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর কোনও গ্র্যান্ড স্ল্যামের চতুর্থ রাউন্ডেও উঠতে পারেননি ওসাকা। ফর্ম হারিয়ে ফেলেছিলেন। যে বয়সে পেশাদার খেলোয়াড়েরা সাধারণত জীবনের সেরা সময় কাটান, সেই বয়সেই টেনিস থেকে বিরতি! দীর্ঘ দিন ধরে ফর্মে ফিরতে না পারার হতাশা কাটাতে ‘মা’ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ওসাকা। ২০২৩ সালে খেলেননি কোনও প্রতিযোগিতায়। কোর্টে ফেরেন মেয়ে শাইয়ের বয়স এক বছর হওয়ার পর। ২০২৪ সালের অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন আয়োজকদের আমন্ত্রণে। প্রাক্তন চ্যাম্পিয়নকে ‘ওয়াইল্ড কার্ড এন্ট্রি’ দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার আয়োজকেরা। পেশাদার টেনিসে দ্বিতীয় ‘এন্ট্রি’ সুখের হয়নি। প্রথম রাউন্ডেই হেরে যান। পরের তিনটি গ্র্যান্ড স্ল্যামেও দ্বিতীয় রাউন্ডের বেশি এগোতে পারেননি। সাফল্য আসেনি চলতি বছরের প্রথম তিনটি গ্র্যান্ড স্ল্যামেও।

ফিরে এসে এগোতে পারছিলেন না ওসাকা। বার বার আটকে যাচ্ছিলেন। ব্যর্থতা এ বার আর হতাশ করেনি পরিণত ওসাকাকে। বরং জেদ বাড়িয়েছে। বিরতির আগের আর এখনকার ওসাকার মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে দিয়েছে দু’বছরের শাই। গফকে হারানোর পর ওসাকা বলেছেন, ‘‘অনেকে বলেছিলেন সন্তান আমার টেনিসজীবন শেষ করে দেবে। কিন্তু আমার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। আমাকে আবার টেনিস খেলার উৎসাহ দিয়েছে মেয়েই। আমার এখন কতগুলো পরিচয়! কারও সন্তান, কারও মা, কারও প্রাক্তন বান্ধবী। আবার পেশাদার টেনিস খেলোয়াড়। হ্যাঁ, আমি টেনিস খেলোয়াড়। কিন্তু এক জন অ্যাথলিটের থেকেও আমি খানিকটা বেশি।’’ তিনি আরও বলেছেন, ‘‘টেনিস খেলোয়াড় হিসাবে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার স্বপ্ন দেখতাম। মহিলা হিসাবে মা হওয়ার স্বপ্নও দেখতাম। সন্তানধারণ থেকে মা হওয়া পর্যন্ত সময়টা একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জ এবং আনন্দের। কোর্ট থেকে কয়েক মাস দূরে থাকায় টেনিসের প্রতি আমার আকর্ষণ, ভালবাসা আরও বেড়েছে। জীবন খুব ছোট। কোনও মুহূর্ত অপচয় করতে চাই না। প্রত্যেকটা দিন নতুন। ভবিষ্যতে হয়তো অনেক কিছু দেখব। তবে একটা জিনিস ভীষণ ভাবে দেখতে চাই। মেয়ে আমার খেলা দেখছে। ম্যাচের পর ও আঙুল দেখিয়ে বলছে, এটা আমার মা।’’ কথা শেষ হওয়ার পর শিশুর মতো হেসেছেন ওসাকা। চাপহীন টেনিস খেলতে চাইছেন। ট্রফি জয়ের থেকেও তাঁর মূল লক্ষ্য এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলে যাওয়া। মেয়ের জন্য খেলা। মেয়ের সঙ্গে টেনিসের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য খেলে যাওয়া।

প্রথম স্বপ্নপূরণের পর দ্বিতীয় স্বপ্নপূরণ করেছেন। অকারণ অপেক্ষা করেননি। সময় নষ্ট করতে চাননি। টেনিসজীবনের ক্ষতি হতে পারে বুঝেও দ্বিধা করেননি। নিজের স্বপ্নকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কোর্টে দাপিয়ে খেলার বয়সে চুটিয়ে মাতৃত্ব উপভোগ করেছেন। টেনিসের মতো নিজের সংসার নিয়েও ভীষণ যত্নশীল ওসাকা। অনুশীলনে যেমন পরিপাটি, তেমনই মেয়ের খেয়াল রাখাতেও। এ ক্ষেত্রে কোনও আনফোর্সড এরর করতে চান না।

মেয়ের সঙ্গে নিজের নানা অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান। গল্প বলে রাতে ঘুম পাড়ানোর জন্য নয়। টেনিস কোর্টে তাঁর সাফল্য-ব্যর্থতার সরাসরি সাক্ষী করতে চান সন্তানকে। গ্যালারিতে বসেই যাতে ছোট্ট শাই শিখে নিতে পারে জীবনের উত্থান-পতনের পাঠ। সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে অত্যন্ত কঠোর ওসাকা। মেয়ের কোনও ছবি সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেন না। প্রচারের আলো থেকে দূরে রাখতে মেয়েকে রাখেন গ্রামের বাড়িতে। খেলার জন্য মেয়েকে ছেড়ে থাকতে হয় দীর্ঘ দিন। অসুবিধা হলেও মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। জীবনের নতুন লড়াইয়ের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। সেই লড়াইয়ের ছাপ ফুটে উঠছে টেনিস কোর্টে।

ফিরে আসা ওসাকাকে নিয়ে সংশয়ে ছিলেন টেনিস বিশেষজ্ঞেরা। গফের বিরুদ্ধে দাপুটে জয়ের পর তাঁরাও আত্মবিশ্বাসী। প্রাক্তন গ্র্যান্ড স্ল্যাম চ্যাম্পিয়ন মারিয়ন বার্তোলি বলেছেন, ‘‘ওসাকা চেনা মেজাজে ফিরে এসেছে। আমার মতে, ওসাকা এ বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অন্যতম দাবিদার। আগের মতো খেলছে আবার। গোটা ম্যাচে নিজের দাপট রেখেছিল। ম্যাচটা নিয়ন্ত্রণ করেছে। ওর শক্তিশালী ফোরহ্যান্ডগুলোর সামনে গফকে অসহায় মনে হচ্ছিল।’’ চতুর্থ রাউন্ডে ওসাকার নিখুঁত টেনিসের প্রশংসা করেছেন টিম হেনম্যানও। তিনি বলেছেন, ‘‘ওসাকা দুর্দান্ত। গফ নিজের সেরা টেনিস খেলেনি। তাতে ওসাকার জয় সহজ হয়েছে। আবার এটাও বলা যায়, গফকে সেরা টেনিস খেলতে দেয়নি ওসাকা। এক কথায় অসাধারণ পারফরম্যান্স। কয়েকটা শটের তো কোনও জবাব নেই।’’

গত উইম্বলডন পর্যন্ত ঠিক যে জায়গায় আটকে যাচ্ছিলেন, বছরের শেষ গ্র্যান্ড স্ল্যামে সেই জায়গাটাই টপকে গেলেন। ক্রমতালিকায় প্রথম ১০-১৫ জনকে হারাতে পারছিলেন না। আমেরিকায় পারলেন। তৃতীয় রাউন্ডে হারিয়েছেন ১৫তম বাছাই দারিয়া কাসাটকিনাকে। চতুর্থ রাউন্ডে তৃতীয় বাছাই গফকে। এগোতে শুরু করেছেন ওসাকা।

ওসাকা লড়ছেন মেয়ের জন্য। নিজের টেনিসের জন্য। নিজের দুই ভালবাসাকে আগলে রাখার জন্য। কারণ আর একটা ভালবাসা আগলে রাখতে পারেননি। মেয়ে জন্মের দেড় বছরের মাথায় প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙেছে। গত ৬ জানুয়ারি আমেরিকার র‌্যাপার কর্ডির সঙ্গে বিচ্ছেদের পর থেকে ওসাকা ‘সিঙ্গল মাদার’। সন্তানের বাবার বিরুদ্ধে তাঁর কোনও অভিযোগ নেই। আক্ষেপ নেই ছ’বছরের সম্পর্ক নিয়ে। শুধু মেয়ের জন্য খেলে যেতে চান। মেয়েই এখন তাঁর জীবনের সব উৎসাহের কারণ। ২০১৮ থেকে ২০২১ পর্যন্ত প্রতি বছর একটি করে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতা ওসাকা হয়তো আবার খেতাব জিতবেন। তার নেপথ্যে থাকবে তাঁর জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের গল্প।

বাংলা ভাষায় নেয়োমি শব্দের অর্থ ‘নিখাদ সৌন্দর্য’। বিরতির পর ফিরে আসা ওসাকা সুন্দর। এশীয় টেনিসের স্বার্থে আরও বেশি সুন্দর। ভয়ঙ্কর সুন্দর তাঁর প্রতিপক্ষদের জন্য।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement