আশির দশকের শেষ দিকে রাজনৈতিক অস্থিরতায় অগ্নিগর্ভ মণিপুর। সন্ধে নামার আগেই জারি কার্ফু। সাঁজোয়া গাড়ি আর সেনাবাহিনীর ভারী বুটের শব্দে সারাক্ষণই মৃত্যুর আতঙ্ক। কিন্তু ভয় নেই একরত্তি মেয়েটির। সকাল হলেই সকলের চোখ এড়িয়ে ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল নিয়ে নেমে পড়ত মাঠে। কিন্তু এক দিন সে ধরা পড়ে গেল বাবা নাগেশ্বর সিংহের কাছে। সঙ্গে সঙ্গেই ফতোয়া— ফুটবল বন্ধ। লেখাপড়ায় মন দাও।
বাবার ফতোয়া সত্ত্বেও ফুটবলই হয়ে উঠেছিল তার ধ্যানজ্ঞান। মণিপুরের সেই মেয়েটিই একদিন হয়ে উঠলেন ভারতের মহিলা ফুটবল দলের কিংবদন্তি। নির্বাচিত হলেন অর্জুন পুরস্কারের জন্য। তিনি— ওইনাম বেমবেম দেবী।
ভারতীয় ফুটবলের শেষ মহিলা অর্জুন বাংলার শান্তি মল্লিক। তাও সেই ১৯৮৩ সালে। তখন বেমবেমের বয়স মাত্র তিন বছর। ৩৪ বছর পর বেমবেমকে যখন অর্জুন পুরস্কারের জন্য বেছে নেওয়া হল, তত দিনে তিনি অবসর নিয়ে নিয়েছেন! যদিও তা নিয়ে কোনও আক্ষেপ নেই ভারতীয় মহিলা ফুটবল দলের সর্বকালের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডারের। এই মুহূর্তে তিনি প্রতিশ্রুতিমান ফুটবলারের খোঁজে ওড়িশায়। ফোনে বেমবেম বললেন, ‘‘খেলতে খেলতে অর্জুন হলে বেশি ভাল লাগত। তবে তা নিয়ে আমার কোনও আক্ষেপ নেই। আমি গর্বিত, অর্জুন পুরস্কারের জন্য আমাকে নির্বাচিত করায়।’’
বাবাকে এতটাই ভয় পেতেন যে, জাতীয় দলে নির্বাচিত হওয়ার খবরও দেননি। অর্জুন পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়ে বেমবেম যেন ফিরে গিয়েছিলেন শৈশবে। বলছিলেন, ‘‘আমার বাবা কখনওই চাইতেন না মেয়েরা ফুটবল খেলুক। উনি চাইতেন লেখাপড়া করে আমি সরকারি চাকরি করব। কিন্তু আমার পক্ষে ফুটবল ছাড়া বাঁচা সম্ভব ছিল না। দিদি ও মা আমাকে বাঁচালেন।’’ কী ভাবে? ‘‘বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সাইকেল নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করত দিদি। সবচেয়ে শেষে মা কিট ব্যাগ নিয়ে বেরোতেন। দিদিই আমাকে পৌঁছে দিত মাঠে। তাই জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার খবরও বাবাকে জানাইনি,’’ হাসতে হাসতে বললেন বেমবেম। তা হলে কী ভাবে জানলেন? ভারতীয় ফুটবলের প্রাক্তন অধিনায়ক বললেন, ‘‘বাবা সক্রিয় রাজনীতি করতে বলে প্রচুর পরিচিত ছিল। তাঁদের কাছ থেকেই শুনেছিলেন আমার জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার খবর।’’ খুশি হয়েছিলেন? বেমবেম বললেন, ‘‘একেবারেই না। বাড়ি ফিরেই বললেন, মেয়েকে বোঝাও, ফুটবল খেলে কিছু হবে না।’’
চমকের এখানেই শেষ নয়। তেরো-চোদ্দো বছর বয়স পর্যন্ত ছেলে সেজেই খেলতেন বেমবেম! ‘‘ছেলেদের মতো করে চুল কাটতাম বলে কেউ বুঝতে পারত না। এক দিন অবশ্য ধরা পড়ে গিয়েছিলাম। একটা গ্রামে খেলতে গিয়েছিলাম। আয়োজকদের একজন আমাকে চিনে ফেলে। কিন্তু তখন আমার বন্ধুরা বলে, বেমবেমকে ছাড়া মাঠেই নামবে না।’’ বললেন জাতীয় দলের হয়ে ৮৫ ম্যাচে ৩২ গোল করা মণিপুর পুলিশের কর্মী। ছেলেদের দলে খেলতে খেলতেই সুযোগ পান রাজ্য দলে। তার পর জাতীয় দলে। বেমবেম বিদেশের ক্লাবে খেলা ভারতের প্রথম মহিলা ফুটবলার। ২০১৪ সালে মলদ্বীপের নিউ রেডিয়েন্ট ক্লাবে সই করেন তিনি।
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬। শিলংয়ে সাফ গেমস ফাইনালে প্রতিপক্ষ নেপাল। মাঠে নেমে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলেন বেমবেম। ৪-০ নেপালকে উড়িয়ে দেশকে চ্যাম্পিয়ন করলেন। তার পরেই বুট তুলে রাখলেন ভারতীয় ফুটবলের চিত্রাঙ্গদা!