সচিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য: দারুণ খেলেছেন স্যর, এ বার হয়তো স্বর্গে ক্রিকেটের মান আরও বাড়বে

প্রয়াত আচরেকর, শোকস্তব্ধ ক্রিকেট মহল

ছয় বছর আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পরে নিজেকে খেলার মাঠ থেকে প্রায় গুটিয়ে নিয়েছিলন আচরেকর। বুধবার সন্ধ্যায় মুম্বইয়ের শিবাজি পার্কে তাঁর বাসভবনে ঘুমের মধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কিংবদন্তি এই ক্রিকেট কোচ।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৯ ০৪:১৫
Share:

স্মৃতি: দুই প্রিয় ছাত্র সচিন ও কাম্বলিকে নিয়ে আচরেকর। ফাইল চিত্র

বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন গত কয়েকদিন ধরেই। শেষ পর্যন্ত সেই যুদ্ধে হেরেই গেলেন ভারতীয় ক্রিকেটের দ্রোণাচার্য কোচ রমাকান্ত আচরেকর। গত কয়েক দশক ধরে যিনি এ দেশের ক্রিকেটকে উপহার দিয়েছিলেন বলবিন্দর সিংহ সাঁধু, চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত, লালচাঁদ রাজপুত, সচিন তেন্ডুলকর, বিনোদ কাম্বলি, প্রবীণ আমরে, রমেশ পওয়ার, অজিত আগারকরদের মতো তারকা ক্রিকেটারদের।

Advertisement

ছয় বছর আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পরে নিজেকে খেলার মাঠ থেকে প্রায় গুটিয়ে নিয়েছিলন আচরেকর। বুধবার সন্ধ্যায় মুম্বইয়ের শিবাজি পার্কে তাঁর বাসভবনে ঘুমের মধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কিংবদন্তি এই ক্রিকেট কোচ। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত দেশের ক্রিকেট মহল। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের তরফে এক শোকবার্তায় বলা হয়েছে, ‘দ্রোণাচার্য সম্মানপ্রাপ্ত কোচ রমাকান্ত আচরেকরের মৃত্যুতে গভীর শোকাহত ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। এ দেশের ক্রিকেটে তাঁর অবদান বিশাল। দেশকে তিনি কেবল সেরা ক্রিকেটারই উপহার দেননি। একই সঙ্গে সেই খেলোয়াড়দের ভাল মানুষ হওয়ারও শিক্ষা দিয়েছিলেন তিনি।’

ক্রিকেটার হিসেবে মাত্র একটিই প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছিলেন আচরেকর। ১৯৬০ সালে সেই ম্যাচে তিনি খেলতে নেমেছিলেন স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার হয়ে। বিপক্ষে ছিল হায়দরাবাদ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন একাদশ। আচরেকরের জীবনের সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার, কোচ হিসেবে সচিন তেন্ডুলকরকে ছোট থেকে তৈরি করা। বোলার হিসেবে ক্রিকেট শিখতে আসা সচিনকে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান বানিয়েছিলেন তিনি। ক্রিকেট শেখানোর জন্য বান্দ্রার নিউ ইংলিশ স্কুল থেকে তিনি সচিনকে নিয়ে এসেছিলেন সারদাশ্রম বিদ্যামন্দিরে। গুরুর মৃত্যুর খবর পেয়ে সেই সচিনেরও আবেগমথিত প্রতিক্রিয়া, ‘‘এ বার হয়তো স্বর্গে গিয়ে সেখানেও ক্রিকেটের উৎকর্ষ বাড়িয়ে তুলবেন আচরেকর স্যর। তাঁর কাছেই আমার ক্রিকেটের অ, আ, ক, খ শেখা। আমার জীবনে তাঁর অবদান বলে শেষ করা যাবে না। যে ভিত ছোট থেকে স্যর তৈরি করে দিয়েছিলেন। আজ তার উপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছি। উনি আমাদের শিখিয়েছিলেন সোজা ভাবে খেলতে ও জীবনে এগিয়ে যেতে।’’

Advertisement

আচরেকরের আর এক বিখ্যাত ছাত্র বিনোদ কাম্বলিরও শোকার্ত বার্তা, ‘‘আমার ক্রিকেটীয় সত্তার জন্মদাতা ছিলেন আপনি। আপনার অভাব অনুভব করব আচরেকর স্যর। শান্তিতে থাকুন। আচরেকর পরিবারের প্রতি আমার পূর্ণ সমবেদনা রইল।’

এই মুহূর্তে মুম্বইয়ে থাকা বর্তমান ভারতীয় দলের সদস্য রোহিত শর্মার প্রতিক্রিয়া, ‘‘আচরেকর স্যরের প্রয়াণের খবর শুনে ব্যথিত। ইনি সেই ব্যক্তিত্ব যিনি মুম্বই ক্রিকেটে সাহস ও নিয়মানুবর্তিতা সঞ্চার করেছিলেন।’’

শুধু সচিনই নন, আচরেকরের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ দেশের বিভিন্ন খেলার তারকারাও। ভি ভি এস লক্ষ্মণ, মহম্মদ কাইফের সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের শোক ব্যক্ত করেছেন অভিনেতা আমির খানও।

মুম্বইয়ের ক্রিকেট মহলে গত কয়েক দশকে কয়েক হাজার ছাত্র তৈরি করেছিলেন আচরেকর। এ দিন গুরুর প্রয়াণের খবর পেয়েই শেষ শ্রদ্ধা জানাতে তাঁরা দলে দলে ভিড় জমান প্রয়াত এই কোচের বাসভবনে। আশির দশকে দাদারের শিবাজি পার্ক জিমখানায় গেলেই দেখা যেত হাফ হাতা সুতির শার্ট গায়ে মন দিয়ে ছাত্রদের ক্রিকেট শেখাচ্ছেন রমাকান্ত আচরেকর। তিরাশি সালে কপিলদেবের দলের বিশ্বকাপ ক্রিকেট জয়ের পরেই মুম্বইয়ে এ রকম অসংখ্য ক্রিকেট কোচিং শিবির তৈরি হয়েছিল। কিন্তু আচরেকরের কোচিং ছিল সেই সব ক্রিকেট স্কুলের থেকে আলাদা। গুরু হিসেবে তিনি ছিলেন প্রকৃতই অন্য ঘরানার। দেশ তাঁকে সম্মান জানিয়েছিল পদ্মশ্রী দিয়ে।

সচিন তেন্ডুলকর ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায় বার বার বলেছেন, কী ভাবে তাঁর ‘আচরেকর স্যর’ গাছের আড়াল থেকে লুকিয়ে মাস্টার ব্লাস্টারের খেলায় তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন। কী ভাবে পিচের উপর মুদ্রা ফেলে বোল্ড না হওয়ার চ্যালেঞ্জ দিতেন তাঁর কোচ। আউট না হলে সেই মুদ্রা নিয়ে বাড়ি ফিরতেন সচিন। এক বার ম্যাচ না খেলে স্কুলের বড়দের খেলা দেখতে গিয়ে আচরেকরের থাপ্পড় খেয়েছিলেন সচিন। যে কথা স্মরণ করে সচিন এক বার বলেছিলেন, ‘‘সে দিন স্যর আমাকে থাপ্পড় মেরে বলেছিলেন, লোকে তোমার খেলা দেখতে আসে। আর তুমি কি না অন্যদের খেলা দেখে গ্যালারিতে বসে হাততালি দিচ্ছ।’’ আশির দশকে মুম্বই ক্রিকেট মহলের অনেকেই দেখেছেন স্কুটারের পিছনে সচিনকে বসিয়ে মুম্বইয়ের বিভিন্ন ক্রিকেট মাঠে ম্যাচ খেলতে নিয়ে যাচ্ছেন আচরেকর।

যা পরবর্তী জীবনে ভোলেননি সচিন। ২০১৩ সালে নিজের শেষ টেস্ট ম্যাচে বিদায়ী ভাষণে আচরেকরের অবদান স্মরণ করেছিলেন সচিন। জীবনের সেই ২০০তম টেস্টে সে দিন সচিন বলেছিলেন, ‘‘১১ বছর বয়স থেকে উনি আমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন। স্যর কোনও দিন বলতেন না, ভাল খেলেছিস। কারণ উনি ভাবতেন এতে আমি আত্মতুষ্ট হয়ে পড়তে পারি। ভাল খেললে তাঁর হাসিখুশি মেজাজটাই বলে দিত আজ ঠিক খেলেছি। সঙ্গে কখনও কখনও মিলত ভেলপুরি, ফুচকাও। আজকের দিনের পরে আর খেলব না। নিশ্চয়ই উনি আমাকে আশীর্বাদ করছেন...।’’

গুরুর প্রয়াণে শোকাহত সচিন এ দিন বলেন, ‘‘গত মাসে আচরেকর স্যরের কয়েক জন প্রাক্তন ছাত্রের সঙ্গে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। সে দিন দারুণ সময় কাটিয়েছিলাম স্যরের সঙ্গে। পুরনো ঘটনার স্মৃতিচারণ করে বেশ হাসিঠাট্টা হয়েছিল স্যরের সঙ্গে। আজ সেই দিনটা মনে পড়ছে বারবার।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন