racism

বর্ণবিদ্বেষ বিতর্কে উত্তাল ক্রিকেট

পুলিশ কর্মীরা দ্রুত গ্যালারিতে অভিযান চালিয়ে ছ’জন দর্শককে তুলে নিয়ে যান।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২১ ০৫:৫০
Share:

আম্পায়ারকে বর্ণবৈষম্যের অভিযোগ জানাচ্ছেন মহম্মদ সিরাজ। রবিবার। গেটি ইমেজেস।

সিডনি মাঠের গ্যালারি থেকে ফের বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য উড়ে আসায় রবিবার আরও তুলকালাম পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেল। তৃতীয় টেস্টের চতুর্থ দিন এমনকি ১০ মিনিটের জন্য খেলাও থামিয়ে দিতে হয়। শনিবারের পরে এ দিনও বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্যের শিকার হয়েছেন ভারতীয় পেসার মহম্মদ সিরাজ।

Advertisement

সেই সময়ে সিরাজ ফাইন লেগ বাউন্ডারিতে ফিল্ডিং করছিলেন। বল করছিলেন যশপ্রীত বুমরা। তিনি যখন বল করতে ছুটে আসছেন, তাঁকে মাঝপথে থামিয়ে দেন ভারত অধিনায়ক অজিঙ্ক রাহানে এবং উইকেটকিপার ঋদ্ধিমান সাহা। দেখা যায়, ফাইন লেগ বাউন্ডারি থেকে হাত নাড়তে নাড়তে এগিয়ে আসছেন সিরাজ। বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারও যে, ফের গুরুতর কিছু ঘটেছে।

ভারতীয় দলের পক্ষ থেকে তৎক্ষণাৎ মাঠের আম্পায়ারের কাছে অভিযোগ জানানো হয়। সিরাজকে দেখা যায় আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন, গ্যালারির ঠিক কোন জায়গা থেকে মন্তব্যগুলি উড়ে এসেছে। অভিনব প্রতিবাদ জানিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটারেরা বাইশ গজের চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকেন একসঙ্গে ‘হাডল’ করে। খেলোয়াড়ি মনোভাবের উদাহরণ রেখে রাহানেদের সঙ্গে সেই প্রতিবাদে শামিল হন অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক টিম পেন।

Advertisement

পুলিশ কর্মীরা দ্রুত গ্যালারিতে অভিযান চালিয়ে ছ’জন দর্শককে তুলে নিয়ে যান। গ্যালারির ওই অঞ্চলে আরও অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু হয়েছে। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ড পুলিশের সাহায্যে পুরো ঘটনা খতিয়ে দেখছে এবং আশ্বাস দিয়েছে, কাউকে ক্ষমা করা হবে না।

শনিবারও খেলা চলাকালীন গ্যালারি থেকে বুমরা এবং সিরাজের দিকেই বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য উড়ে এসেছিল। তা নিয়ে ম্যাচ রেফারি ডেভিড বুনের কাছে অভিযোগ জানায় ভারতীয় শিবির। ২০০৮ সালে অনিল কুম্বলের ভারতীয় দল যখন অস্ট্রেলিয়া সফর করছিল, এই সিডনিতেই ঘটেছিল ‘মাঙ্কিগেট’ মহাবিতর্ক। সে বার যদিও অভিযোগ উঠেছিল এক ভারতীয় ক্রিকেটার হরভজন সিংহের বিরুদ্ধে। এ বারের ঘটনা ক্রিকেটারদের দিক থেকে আসেনি, এসেছে গ্যালারির দর্শকদের থেকে। তবে তা ‘মাঙ্কিগেট’-এর মতো বড়সড় আকার নিলে অবাক হওয়ার নেই।

সিডনিতে দর্শকদের এমন আচরণ নিয়ে উত্তাল ক্রিকেট বিশ্ব। প্রতিবাদে সরব সকলে। বিরাট কোহালি দলের সঙ্গে না-থাকলেও তোপ দেগেছেন অস্ট্রেলীয় দর্শকদের দিকে। বলেছেন, ‘‘অস্ট্রেলীয় দর্শকেরা খুবই অসভ্য আচরণ করে। আমি নিজে বহু বার তা সহ্য করেছি।’’ যোগ করেছেন, ‘‘বর্ণবিদ্বেষমূলক মন্তব্য কোনও ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’’ কোহালি না থাকলেও দলের সঙ্গে সিডনিতে খেলছেন অশ্বিন। তিনিও দিনের খেলা শেষে মারাত্মক অভিযোগ তুলে বলেছেন, ‘‘অস্ট্রেলিয়ায় আমি অনেক বার এসেছি। বিশেষ করে সিডনিতে এমন আচরণ কিন্তু নতুন নয়। আগেও বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য শুনেছি আমরা।’’

কোহালি এবং অশ্বিনের অভিযোগের পরে অস্ট্রেলিয়ায় দর্শক আচরণ নিয়ে নতুন করে বিতর্কের ঝড় উঠতে পারে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে আগাম ক্ষমা চেয়ে রেখেছে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ড। ঘটনার তীব্র নিন্দা করে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কর্তারা দোষীদের শাস্তির দাবি তুলেছেন। খেলাধুলোর ইতিহাসে বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ব্যাপারে ভারতের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় চলতে থাকা বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ ১৯৭৪ সালে ডেভিস কাপ ফাইনালে উঠে সে দেশে খেলতে যায়নি ভারত। ডেভিস কাপ ট্রফি না খেলে তুলে দিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার হাতে।

এ দিনের ঘটনার সূত্রপাত অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসে ৮৬ ওভার শেষ হওয়ার পরে। ওই ওভারের পঞ্চম ও ষষ্ঠ বলে সিরাজকে পর পর দু’টি ছক্কা মারেন অস্ট্রেলীয় অলরাউন্ডার ক্যামেরন গ্রিন। তার পরেই ফাইন লেগ অঞ্চলে ফিল্ডিং করতে যান সিরাজ। অভিযোগ, সেই সময়েই সংলগ্ন গ্যালারি থেকে তাঁর উদ্দেশে ভেসে আসতে থাকে বর্ণবৈষম্যমূলক মন্তব্য।এর পরেই সিরাজ এসে অভিযোগ করেন আম্পায়ারের কাছে।

ভারতীয় ক্রিকেটারেদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে অনেকটা সময় আলোচনা করেন আম্পায়ার। এর পরে দেখা যায়, নিরাপত্তারক্ষীরা সংশ্লিষ্ট গ্যালারির নির্দেশিত অঞ্চলে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন চার দর্শককে। কিছু পরে আরও দু’জনকে নিয়ে মোট ছ’জনকে স্টেডিয়াম থেকে বার করে দেওয়া হয়।

অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ডের নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান শন ক্যারল ক্ষমা চেয়ে লেখেন, ‘‘এই ধরনের আচরণের কড়া নিন্দা করে অস্ট্রেলিয়া। কেউ যদি বর্ণবিদ্বেষমূলক আচরণ ও মন্তব্য করে থাকে, তাকে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া স্বাগত জানায় না।’’ যোগ করা হয়েছে, ‘‘ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া অপেক্ষা করছে শনিবারেও বর্ণবিদ্বেষমূলক মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে যে তদন্ত চলছে, তার রিপোর্টের জন্য। যারা এই ঘটনায় দোষী প্রমাণিত হবে, তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেবে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ড। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ক্রিকেট মাঠে ঢোকা দীর্ঘকালের জন্য বন্ধ হতে পারে। আসতে পারে আরও অনেক বিধিনিষেধ। এ ছাড়াও নিউ সাউথ ওয়েলস পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হবে দোষীদের।’’ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘‘সিরিজের আয়োজক হিসেবে ভারতীয় ক্রিকেট দলের বন্ধুদের কাছে আমরা ক্ষমা চাইছি। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, এই ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

শনিবারও একই ধরনের বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য উড়ে এসেছিল বলে ভারতীয় ক্রিকেটারেরা জানিয়েছিলেন। এমনও বলা হয়েছে যে, দর্শকেরা মদ্যপ অবস্থায় সেই সব মন্তব্য করেছেন। আপত্তিজনক কথার মধ্যে অনেক কিছুই রয়েছে বলে অভিযোগ, যার বেশিটাই ছাপার অযোগ্য। সিরাজকে ‘বিগ মাঙ্কি’ বলা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। যা ভীষণ ভাবেই বর্ণবিদ্বেষমূলক মন্তব্য।

সিডনি টেস্টে অস্ট্রেলীয় দর্শকদের এই বর্ণবিদ্বেষমূলক আচরণের তীব্র নিন্দা করেছে আইসিসিও। এমনকি দোষী প্রমাণিত হলে আয়োজক দেশের ক্রিকেট বোর্ডের বিরুদ্ধেও কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে তারা। আলাদা বিবৃতিতে আইসিসি জানিয়েছে, ‘‘সিডনি ক্রিকেট মাঠে ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়ার তৃতীয় টেস্টে দর্শকদের বর্ণবিদ্বেষমূলক মন্তব্য ও আচরণের তীব্র নিন্দা করা হচ্ছে। এই ঘটনার তদন্তের জন্য ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকে যাবতীয় সাহায্য করা হবে।’’

আইসিসির চিফ এগজিকিউটিভ মনু সাহনি বলেন, ‘‘ক্রিকেটে এই ধরনের অপরাধীদের কোনও স্থান নেই। আমরা এ ব্যাপারে সব সময়েই কড়া পদক্ষেপ করি। স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষ এবং ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার দ্রুত পদক্ষেপ করার ঘটনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। আইসিসি খেলার মাঠে বর্ণবিদ্বেষ বরদাস্ত করে না। দোষীদের চিহ্নিত করার জন্য ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকে সব রকমের সাহায্য করা হবে।’’

আইসিসি-র আইন অনুযায়ী, এ বার ঘটনার তদন্ত করে তাদের কাছে রিপোর্ট পাঠাবে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ড। তার পরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, তা দেখবে ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন