সুপার সিরিজে সুপার শ্রীকান্ত

অনেকে বলছেন, শ্রীকান্তদের এই টানা সাফল্যের পিছনে কয়েক মাস আগে জাতীয় দলের কোচ হয়ে আসা ইন্দোনেশিয়ান কোচ মুলয়ো হান্দোয়ো। তাঁর অন্য রকম ট্রেনিং পদ্ধতি, মানসিক শক্তি বাড়ানোর উপরে জোর দেওয়াটাই পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।

Advertisement

মধুমিতা বিস্ত

শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৭ ০৫:১৪
Share:

টেকনিক্যালিও শ্রীকান্তের খেলা আরও উন্নত দেখিয়েছে। ছবি টুইটার।

রবিবার শ্রীকান্তের চ্যাম্পিয়ন হওয়া দেখে গত বছর ডাচ ওপেনের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। অক্টোবরে সেই টুর্নামেন্টটায় কোচ হিসেবে গিয়েছিলাম। এইচ এস প্রণয়রা কথায় কথায় তখন বলছিল, গোপী স্যার প্রচণ্ড ফিটনেসের উপর জোর দিচ্ছেন। আমাদের রোজ রোজ প্রচুর দৌড়তে হচ্ছে। আমি সে দিন ওদের বলেছিলাম, আজ তোরা যে পরিশ্রমটা করছিস, তার ফল এক দিন না এক দিন ঠিক পাবি। তখন বুঝবি এই পরিশ্রমের মূল্য কী!

Advertisement

আজ শুনছিলাম, শ্রীকান্ত ম্যাচের পরে বলেছে, ওর পেটের সমস্যা ছিল। সেটা কাটিয়েই ফাইনালে চেন লং-এর মতো অলিম্পিক্স সেরা, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের চ্যালেঞ্জ সামলেছে। শ্রীকান্তের এই মানসিক জোর, ফিটনেসটা ধরে রাখার পুরো কৃতিত্বটা কিন্তু গোপীর।

সাইনা-সিন্ধুর পরে এ বার কিন্তু বিশ্ব ব্যাডমিন্টন দাপাচ্ছে আমাদের ছেলেরা। শুধু শ্রীকান্তই নয়, এইচ এস প্রণয়ের পরপর দুই বিশ্বসেরাকে ইন্দোনেশিয়ান ওপেনে হারানো, বি সাই প্রণীতের ক’দিন আগে সিঙ্গাপুর ওপেনে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কথাও ধরেই কিন্তু বলছি।

Advertisement

অনেকে বলছেন, শ্রীকান্তদের এই টানা সাফল্যের পিছনে কয়েক মাস আগে জাতীয় দলের কোচ হয়ে আসা ইন্দোনেশিয়ান কোচ মুলয়ো হান্দোয়ো। তাঁর অন্য রকম ট্রেনিং পদ্ধতি, মানসিক শক্তি বাড়ানোর উপরে জোর দেওয়াটাই পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।

অবশ্যই, মুলয়োর অবদান নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। কিন্তু আমার কাছে শ্রীকান্তদের এই সাফল্যের মূলে এক জনই— গোপীচন্দ।

আরও পড়ুন: ‘চোটের সেই সময়েও হার মানেনি ভাই’

কেন বলছি কথাটা?

গোপীকে আমি দীর্ঘদিন ধরে চিনি। যখন আমি ব্যাডমিন্টন খেলতাম তখন গোপী আমার জুনিয়র ছিল। এক সময় ওর চোটের জন্য তিনটে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছিল। সেই ধাক্কা কাটিয়ে ও অল ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন হয়। ওর জেদ, হার না মানসিকতা ঠিক কতটা এতেই স্পষ্ট। আরও একটা জিনিস গোপীর মধ্যে দেখেছি, সেটা হল ধৈর্য।

সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা না রেখে কিন্তু এক লাফে উপরে ওঠা যায় না। একটা গেম জিততে গেলে যে রকম ধৈর্য রাখতে হয়, তেমনই একটা খেলোয়াড়কে তুলে আনতে গেলেও চাই ধৈর্য। গোপী এই কাজটাই সেই ২০০৬ থেকে সামলে আসছে। জাতীয় কোচ হওয়ার আগে থেকেই। আগে গাচ্চিবৌলি স্টেডিয়ামে কোচিং করাতো। পরে নতুন অ্যাকাডেমিতে। আমি ২০১১ থেকে জাতীয় দলে কোচ হওয়ার সুবাদে জাতীয় শিবিরে গোপীর ট্রেনিং পদ্ধতি, ওর দায়বদ্ধতা আর অসীম ধৈর্য দেখেছি। প্রত্যেকটা খেলোয়াড়কে নিয়ে কী ভাবে গোপী দিনের পর দিন পড়ে থাকে সেটা দেখেছি।

ভোর সাড়ে চারটে বাজতে না বাজতেই গোপী কোর্টে নেমে পড়ত। তিনটে সেশনে এর পর চলত প্র্যাকটিস আর ফিটনেস। প্রথমে লম্বা একটা সেশনে কোর্টে প্র্যাকটিস, তার পরে একটু বিশ্রাম দিয়ে ফের দ্বিতীয় পর্ব, শেষে ফিটনেস বাড়ানোর প্র্যাকটিস। এই রুটিন মেনেই, দিনের পর দিন গোপীর পরিশ্রমের ফল আজ দেখা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টনে এই এক ঝাঁক ছেলে-মেয়ের সাফল্যের পিছনে তাই সবচেয়ে বড় হাত গোপীর।

শ্রীকান্তের কথাই ধরুন। ওকে আমি বহু দিন ধরে দেখছি। নিয়মিত যোগাযোগ থাকে। সেই ২০১৩-তে শ্রীকান্তের তাইল্যান্ড গ্রঁ প্রি গোল্ড জেতার সময়ও কোচ হিসেবে আমি ছিলাম। দেখেছি ছেলেটার শটের বৈচিত্র। রিও অলিম্পিক্সের আগেও বলেছি, তুই এ বার পদক জিততে পারিস, তোর মধ্যে সেই জোর আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য অলিম্পিক্সে হেরে যায় লিন ড্যানের কাছে। তার পরেই ও চোট পেয়ে বেশ কিছুদিন কোর্টের বাইরে ছিটকে যায়। সেখান থেকে ফিরে এসে টানা তিনটে সুপার সিরিজের ফাইনালে ওঠা, টানা দুটো টুর্নামেন্ট জেতা সহজ নয়। সেটাই শ্রীকান্ত করে দেখিয়েছে ওর মনের জোর আর ফিটনেসের জন্য।

টেকনিক্যালিও শ্রীকান্তের খেলা আরও উন্নত দেখিয়েছে। না হলে চেন লং-এর মতো প্লেয়ারকে স্ট্রেট গেমে হারানো মুখের কথা নয়। চেন এ দিন বুঝতেই পারছিল না শ্রীকান্তের পরের শট ঠিক কী আসতে চলেছে। কোথায় মারবে ও পরের শটটা সেটাই ‘অ্যান্টিসিপেট’ করতে পারছিল না। শ্রীকান্তের শটের বৈচিত্র এতটাই।

শ্রীকান্তদের এই সাফল্য দেখে অনেকে অগস্টে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে কতগুলো পদক আসতে পারে সেই নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিয়েছেন। অবশ্যই শ্রীকান্তদের উপর আমাদের প্রত্যাশা বেড়ে গেল। কিন্তু এটাও কিন্তু মাথায় রাখতে হবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে আরও তৈরি হয়ে আসবে চেন লং, লি চং উই-রা। এখনও হাতে মাস খানেক সময় আছে। সেই সময়টা ওরা প্রস্তুতিতে কাজে লাগাবে। অন্য স্ট্র্যাটেজি নেবে। তাই বলছি আমাদেরও কিন্তু শ্রীকান্তদের আরও সাফল্যের জন্য রাখতে হবে ধৈর্য। ঠিক গোপীর মতো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন